সাকিবের খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি
প্রকাশিত হয়েছে : ১১:৪৩:০৯,অপরাহ্ন ১৩ জুন ২০১৫
চট্টগ্রাম:: বাড়ি থেকে মুঠোফোনে সাকিবকে ডেকে পাঠালো চাচা সরোয়ার। চাচা জানায় সাকিবকে নিয়ে সে শশুর বাড়ি যাবে বেড়াতে। সাকিব রাজি হয়। তৈরী হয়ে ঘর হতে বের হয়। ৬ জুনের ঘটনা এটি। সেদিন সাকিব জেবি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফেরার পর চাচা সরোয়ার মুঠোফোনে সাকিবকে ডেকে নিয়ে যায়। এই যাওয়াই ছিল সাকিবের শেষ যাওয়া।
প্রতিবেশী সরোয়ারের একটি গ্রাম্য দোকান আছে সাকিবদের বাড়ির কাছে। সদা হাস্যোজ্জল কিশোর সাকিব সেখানে যাওয়া আসা করতো মাঝে মাঝে। এভাবেই সারোয়ারের সাথে সাকিবের আলাপ, পরিচয়। এভাবে ঘনিষ্টতাও বাড়ে। গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠদের যেভাবে বয়োকনিষ্ঠরা চাচা সম্বোধন করে সেভাবেই সরোয়ারকে চাচা বলে ডাকতো সাকিব। সে ডাকে ছিল শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, বিশ্বাস। এই বিশ্বাসই কাল হলো সাকিবের। চাচা সরোয়ারের ডাকে সাড়া দিয়ে শুধু বিশ্বাসের ওপর ভর করে ঘর থেকে বের হয় সাকিব। মনে প্রশ্ন জাগে তাহলে কী কাউকেই বিশ্বাস করা যাবেনা? সমাজের এই অবক্ষয় কেন?
সাকিবকে ডেকে নেয়ার ছয়দিন পর মিললো জবাই করা মথা বিচ্ছিন্ন গলিত লাশ। শুক্রবার (১২ জুন) দুপুরে উপজেলার করেরহাট এলাকার গহীন পাহাড়ের ৭০ ফুট নিচ (স্থানীয় ভাষায় কানাল) থেকে পুলিশ লাশটি উদ্ধার করে ময়নাতদন্তে পাঠিয়েছে। শনিবার (৬ জুন) বিকালে তাকে অপহরণ করে তারই প্রতিবেশী সরোয়ার আলম। ফারহান সাকিব স্থানীয় জোরারগঞ্জ জেবি উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র।
পুলিশ জানায়, শুক্রবার (১২ জুন) দুপুরে উপজেলার করেরহাট ইউনিয়নের নয়টিলা মাজার এলাকায় পাহাড়ের নিচ থেকে সাকিবের লাশ উদ্ধার করে জোরারগঞ্জ থানা পুলিশ। বিকালে ময়না তদন্তের জন্যে লাশ চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে (চমেক) মর্গে পাঠানো হয়। সে উপজেলার ধুম ইউনিয়নের উত্তর মোবারকঘোনা গ্রামের নাছির আহম্মদের তৃতীয় সন্তান।
এ ঘটনায় হোসেন মোবারক শহীদ ও রুবেল হোসেন নামে দুই ঘাতককে গত বুধ ও বহস্পতিবার আটক করা হয়েছে। আটককৃতরা পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অপহরণ ও হত্যাকন্ডের কথা স্বীকার করেছে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত অপহরণের মূল পরিকল্পনাকারী নিহত সাকিবের প্রতিবেশি সরোয়ার আলমকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
নিহতের বড় ভাই ব্যবসায়ী শহীদুল ইসলাম জানান, গত ৬ জুন স্কুলের সাময়িক পরীক্ষা দিয়ে সাবিক বাড়ি ফেরে। বিকালে ঘরে কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর মাকে ফোন করে জানায় সে পাশের বাড়ির সরোয়ারের সঙ্গে তার এক আত্মীয় বাড়িতে যাচ্ছে। পথে (করেরহাট এলাকায়) দেখা হয় আমাদের এক পরিচিতের সঙ্গে। তাকেও সাকিব বলেছিল সরোয়ারের সাথে বেড়াতে যাচ্ছে। এরপর থেকে সাকিবের মোবাইলফোন বন্ধ থাকে। কোনভাবে তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে গত ০৭ জুন সাকিব নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে জোরারগঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী করা হয়।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জোরারগঞ্জ থানার এসআই (উপ-পরিদর্শক) মো. আব্দুল হামিদ জানান, সাকিব নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় বুধবার (১০ জুন) পুলিশ সরওয়ারের ছোট ভাই রুবেলকে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করে। রুবেলের দেয়া তথ্য ও প্রযুক্তিগত সুবিধা ব্যবহার করে বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ফেনী থেকে উপজেলা অলিনগর এলাকা কামাল মেম্বারের ছেলে হোসেন মোবারক শহীদকে আটক করা হয়।
আটককৃত শহীদ পুলিশকে জানায় গত ০৬ জুন বিকাল প্রায় ৩টায় সাবিককে টাকার জন্য সরওয়ার অপহরনের পরিকল্পনা করে বাড়ি থেকে নিয়ে আসে। কিন্তু সাকিব কার সাথে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে এ তথ্য তার পরিবারকে জানিয়ে দেয়ায় মুক্তিপণ দাবি না করে ওইদিন বিকাল সাড়ে ৫ টায় তাকে হত্যা করা হয়।
এসআই হামিদ জানান, সাকিবের মাথা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। হাত ও দুই পায়ের গোড়ালী পঁচে শরীর থেকে আলাদা হয়ে গেছে। এরপর লাশ আড়াল করতে পাহাড়ের প্রায় ৭০ ফুট নিচে ফেলে দেয়া হয়। আটককৃত শহীদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী শুক্রবার সাকিবের গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়।
জোরারগঞ্জ থানার ওসি লিয়াকত আলী জানান, ঘটনার সাথে জড়িত দুই অপহরণকারীকে আটক করা হয়েছে। প্রাথমকি জিজ্ঞাসাবাদে আটককৃতরা অপহরণ ও হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। অন্যদের গ্রেফতারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। হত্যা অপহরণ ও নির্যাতনের ঘটনায় নিহতের বড় ভাই শহীদুল ইসলাম বাদি হয়ে থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন।
এদিকে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে জে.বি উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির ছাত্র ফারহান সাকিবকে নির্মমভাবে জবাই করে হত্যার প্রতিবাদে এবং খুনীদের ফাঁসির দাবিতে কালো ব্যাজ ধারণ করে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে শিক্ষার্থীরা।
শনিবার দুপুরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পুরাতন সড়ক জোরারগঞ্জ বাজার এলাকায় স্কুল প্রাঙ্গনে মানববন্ধন কর্মসূচিতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন সহপাঠীরা। শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন কর্মসূচিতে অংশ গ্রহন করে সাধারণ জনতা, শিক্ষক ও অভিভাবকেরা। অবিলম্বে সাকিব হত্যার সাথে জড়িত প্রধান আসামী সরওয়ারকে গ্রেপ্তারের দাবি জানানো হয় কর্মসূচি থেকে। অন্যথায় বৃহত্তর আন্দোলনের ঘোষণা দেয়ার হুমকি দেয় শিক্ষার্থীরা।
নৃশংসভাবে খুনের শিকার স্কুল ছাত্র সাকিবের সহপাঠী নুসরাত জাহান, সানজিদা তাবাচ্চুম, সীমা চক্রবর্তী, তুহিন, তারেক, হৃদয়, ইমন কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, ‘সাকিব নেই এটা ভাবতেই পারছিনা। সে আছে স্মৃতিতে। ক্যাম্পাসের হাস্যেজ্জ্বল বন্ধুটি আমাদের পাশে নেই এটা কোন ভাবেই মানতে পারছিনা। সাকিবকে খুব মিস করছি। সাকিবের খুনীদের ফাঁসি চাই।’
হত্যাকারীদের শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচিতে সহকারি প্রধান শিক্ষক সুভাষ সরকারের সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন স্কুলের সভাপতি চেয়ারম্যান মকছুদ আহম্মদ চৌধুরী, প্রধান শিক্ষক তুষার কান্তি বড়ুয়া, বাজার কমিটির সভাপতি প্রসার কান্তি বড়ুয়া, নিহত স্কুল ছাত্র সাকিবের বড় ভাই শহীদুল ইসলাম রুবেল, প্রাক্তন ছাত্র পরিষদের উপদেষ্টা টুইংকেল বড়ুয়া, মোঃ জাবেদ, সাধারণ সম্পাদক ইমাম হোসেন, যুগ্ন সম্পাদক মানারাত আহম্মদ চৌধুরী বাবু প্রমুখ। – মাসিক মীরসরাই