কী নাম নেবে জামায়াত?
প্রকাশিত হয়েছে : ৬:৩৭:২১,অপরাহ্ন ০৪ জুন ২০১৫
নিউজ ডেস্ক :: যুদ্ধাপরাধী রাজনৈতিক দল হিসেবে নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। গঠনতন্ত্র সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় ২০১৩ সালের আগস্টে হাইকোর্ট এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে দলটির নিবন্ধন অবৈধ বলে রায় দেন। পরে জামায়াত অবশ্য এ রায়ের স্থগিতাদেশ চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করেছে। সে মামলার এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।
তবে হাইকোর্ট রায় ঘোষণার পর জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করা হবে কি না সে ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন সুস্পষ্ট কোনো বক্তব্য দিচ্ছিল না। দীর্ঘ প্রায় দেড় বছর পর চলতি সংসদ অধিবেশনে প্রশ্নোত্তরে বিষয়টি জানতে চাওয়া হলে ‘জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল’ বলে জানায় কমিশন। তবে আপিল বিভাগে জিতলে তারা নিবন্ধন ফিরে পাবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
এদিকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে দলটি ও তার অঙ্গসংগঠনগুলো নিষিদ্ধের ব্যাপারে একটি বিল অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। আইনমন্ত্রী বলেছেন, সরকার চাইলেই এ ব্যাপারে এখনি পদক্ষেপ নেয়া হবে।
ধরে নেয়া যাক, এ অধিবেশনে জামায়াত নিষিদ্ধের বিল পাস হচ্ছে। কিন্তু তাতেই কি জামায়াতের রাজনীতির ইতি ঘটবে?
না, ব্রিটিশ শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত ধর্মভিত্তিক দলটি একটা আইনের জোরেই নির্মূল হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। একাত্তরে মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডিত ও অভিযুক্তদের বাদ দিয়ে নতুন নামে আসবে তারা। একাত্তরে বিতর্কিত ভূমিকার জন্য পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে ভিন্ন নামে রাজনীতিতে সক্রিয় হলেও অতি আত্মবিশ্বাসের জোরে স্বনামে ফেরে জামায়াত। এখন আবার সেই কৌশলেই এগুতে চায় তারা।
জামায়াত ও তার সহযোগী ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের কয়েক জন শীর্ষস্থানীয় নেতার সঙ্গে কথা বলে এমনটিই জানা গেছে।
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপির প্রধান শক্তি জামায়াতকে কোনোভাবেই ছাড় দেবে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এছাড়া আন্দোলন সংগ্রামের নামে রাজপথে সহিংসতা মোকাবেলা, যুদ্ধাপরাধের বিচারসহ আইনগত দিক থেকে দলটির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে থাকবে সরকার। এজন্যই পর্যায়ক্রমে দলটির বিরুদ্ধে সব পদক্ষেপ নেয়ার প্রস্তুতি চলছে।
তবে এতে চিন্তিত নয় জামায়াত। তারাও চাচ্ছে সরকার এমন কিছু করুক! কারণ জামায়াত নিষিদ্ধ হলেই দলটি নতুন নামে আসতে পারবে। তখন কেউ নতুন দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধপরাদের অভিযোগের আঙ্গুল তুলতে পারবে না।
তৎকালীন ছাত্রসংঘ নাম পরিবর্তন করে ছাত্রশিবির নাম ধারণের অভিজ্ঞতাকেই সফল বলেই মনে করে জামায়াত। এবার দলের ক্ষেত্রে সেটাই করার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।
১৯৭২ এর সংবিধানে বঙ্গবন্ধু ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার পর জামায়াত ও তার সহযোগী ছাত্র সংগঠন ছাত্রসংঘও নিষিদ্ধ হয়। এসময় জামায়াত গোপনে তৎপর থাকে। তবে পঁচাত্তরের পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে সবার জন্য রাজনীতি উন্মুক্ত করলে ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ছাত্রসংঘ নাম পাল্টে আগের কাঠামোতেই ছাত্রশিবির নামে আত্মপ্রকাশ করে।
এর আগে ১৯৭৬ সনের ২৪ আগস্ট সাবেক জামায়াতে ইসলামী, নিজামে ইসলামীসহ সাতটি দল নিয়ে ‘ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ’ (আইডিএল) নামে একটি নতুন দল গঠন করেন জামায়াতের তৎকালীন নায়েবে আমির মাওলানা আব্দুর রহীম। তবে পরে জামায়াতের কতিপয় নেতা নিজ নামে আত্মপ্রকাশের পাঁয়তারা করলে আব্দুর রহীম জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দলটির এক কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য বলেন, ‘পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে জামায়াত যে লক্ষ্যে দীর্ঘ পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, তা বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে সহজে স্থান করে নিতে পারেনি। তাছাড়া স্বাধীনতাকালীন সময়ের অবস্থান নিয়েও রয়েছে ব্যাপক সমালোচনা। এ অবস্থায় হাজার প্রতিকূলতার মধ্যেও জামায়াত আজ দেশ ও বহির্বিশ্বে ইসলামি দল হিসেবে পুরোপুরি স্বীকৃতি পাচ্ছে না। তাই জামায়াতের পুনর্গঠন ও নতুন কৌশল নেয়া প্রয়োজন।’
এ ব্যাপারে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক মনির আহমেদ বাংলামেইলকে বলেন, ‘সরকার জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করুক আর যাই করুক ইসলামি আন্দোলন চলছে, চলবেই। বাকি পদক্ষেপ সরকারের সিদ্ধান্তের পর পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে নেয়া হবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সরকার ও প্রগতিশীল দলগুলোর পক্ষ থেকে দলটি নিষিদ্ধের কথা জোরালোভাবে উচ্চারিত হচ্ছে। একই সঙ্গে একাত্তরে মানবতা বিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের বিচার শুরু হওয়ায় জামায়াতের সব শীর্ষ নেতা হয় কারাগারে নয় ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত। এই প্রক্রিয়া শুরুর পর থেকেই জামায়াত নাম পরিবর্তনের বিষয়ে আলোচনা করছে। সম্প্রতি ফাঁসি কার্কর হওয়া সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামানও নআম পরিবর্তনের প্রস্তাব করেছিলেন বলে জানা যায়। তবে কেউ কেউ বলছেন, সরকার যেহেতু নিষিদ্ধই করবে তাহলে করুক। তখন নতুন নামে এলে কেউ আর তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অপবাদ দিতে পারবে না। এতে বরং বেকায়দায় পড়বে আওয়ামী লীগ।
জামায়াত আরো মনে করে, জামায়াত নিষিদ্ধ হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আওয়ামী লীগই। কারণ জামায়াত শেষ হবে কিন্তু দলের নেতারা তো আর শেষ হয়ে যাবে না। এদের কেউ কেউ সমমনা বিএনপিসহ বিভিন্ন দলে যোগদান করলেও কিন্তু ভোটের রাজনীতিতে বেকায়দায় পড়বে আওয়ামী লীগই।
জামায়াতের ঢাকা মহানগরের এক নেতা এমনটিই বলেছেন। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ জামায়াত ইস্যু নিয়ে রাজনীতি করছে করবে। কিন্তু নিষিদ্ধ করা হবে তাদের জন্য ভুল। কারণ জামায়াত নিষিদ্ধ করে দিলে তাদের সামনে আর প্রধান কোনো ইস্যু থাকবে না।’
নাম পরিবর্তনের বিষয়ে ইঙ্গিত করে তিনি আরও বলেন, ‘জামায়াত একটি নাম। কিন্তু এর শক্তি কর্মীবাহিনী। এর আগেও জামায়াত ও তার অঙ্গ সংগঠন নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু তাতে কী লাভ হয়েছে? জামায়াত নিষিদ্ধ হবে। কিন্তু কর্মী বাহিনীতে আর নিষিদ্ধ হবে না।’
ঢাকা মহানগর জামায়াত ও শিবিরের দুই নেতাও ঠিক একই কথা বলেছেন।
তবে জামায়াতের নতুন এ কৌশলটির প্রতিও নজর রাখছে সরকার। তারা নতুন নামে আর কোনো দলকে নিবন্ধ দিতে চাইবে না। জামায়াতও অবশ্য এই মুহূর্তে নতুন নামে নিবন্ধনের আশাও করছে না। তারা শুধু দলীয় কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাবে।
এর আগে একাত্তরে গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধের জন্য জামায়াতে ইসলামী ও এর তৎকালীন সহযোগী সংগঠন ও নেতাকর্মীদের দায়ী করে সংশ্লিষ্টদের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধের সুপারিশ জানায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা। এরপর গত ২৭ মার্চ জামায়াতের বিরুদ্ধে ৩৭৩ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদনসহ ৯ হাজার ৫৫৭ পৃষ্ঠার নথিপত্র চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুর কাছে দাখিল করেন তারা। কিন্তু আজ পর্যন্ত তা ট্রাইব্যুনালে চূড়ান্তভাবে উপস্থাপন করা হয়নি।
অবশ্য ট্রাইব্যুনাল এ বিষয়ে কোনো আইন না থাকায় আইসিটি আইন-১৯৭৩ এ একাত্তরে মানবতা বিরোধী অপরাধের কারণে দল নিষিদ্ধের কোনো বিধান না থাকায় এ বিষয়ে এগুতে পারছে না। এসময় ট্রাইব্যুনাল থেকে আইন সংশোধনের জন্য বলা হলেও তা করা হয়নি।
এ বিষয়ে গত সোমবার আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক জাতীয় সংসদে জানিয়েছেন-যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে আইন করে জামায়াত ও এর অঙ্গসংগঠনগুলো নিষিদ্ধের ব্যাপারে একটি বিল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে রয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অনুমোদন পেলে সেটি সংসদে উত্থাপন করা হবে।