আবারও ভারতের দিকে তাকিয়ে বিএনপি
প্রকাশিত হয়েছে : ১২:০৮:২৯,অপরাহ্ন ০৩ জুন ২০১৫
নিউজ ডেস্ক::
ভারতবিরোধী মনোভাব যে দলটির পুঁজি ছিল এক সময়, সেই বিএনপিই এখন ভারত বিদ্বেষ পুরোপুরি বাদ দিয়ে এক বছরের মধ্যে তৃতীয়বারের মতো ভারতের সাহায্য চাইছে। বলতে গেলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে সামনে রেখে দলটি এখন ভারতের কাছে সহায়তা পাওয়ার আশায় তাকিয়ে আছে।
সাক্ষাতের সুযোগ পাওয়া গেলে মোদিকে বিএনপি কী বলতে পারে এ ব্যাপারে জনমনে আগ্রহের কমতি নেই। সেই উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ভারত যেন উদ্যোগ নেয় এবং হাসিনা সরকারকে চাপ দেয় সেই অনুরোধই মোদির কাছে করতে পারেন খালেদা জিয়া। এমনকি এ প্রশ্নে ভারতের মধ্যস্থতাও মেনে নিতে বিএনপি রাজি আছে বলে মোদিকে জানানো হবে।
মোদির সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সম্ভাব্য সাক্ষাৎ বা বৈঠককে সামনে রেখে দলটি এমনই প্রস্তুতি নিয়েছে বলে আলোচনা করে জানা গেছে। যদিও ওই সাক্ষাতের সময়সূচি এখনও নির্ধারিত হয়নি। তবে দিল্লি ও ঢাকায় ভারতীয় কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী বিএনপি নেতা ও বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, আগামী ৭ জুন বিকেলে কোনও এক সময় মোদির সঙ্গে খালেদা জিয়ার দেখা হতে পারে। আর দেখা হলে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত সময়ে বিএনপির পক্ষ থেকে যাতে গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো বলা যায় দলটি তার জন্য সব প্রস্তুতি আগে-ভাগেই নিয়ে রাখছে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, ভারত আমাদের নিকটতম বৃহৎ প্রতিবেশী গণতান্ত্রিক দেশ। সুতরাং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারা অক্ষুণ্ণ রাখতে আমরা তাদের অনুরোধ জানাতে পারি। তিনি বলেন, অতীতে কার কী ভুল সে বিতর্কে না গিয়ে এ অঞ্চলে যাতে শান্তি ও গণতন্ত্র রক্ষা হয় মোদির সফরের মধ্য দিয়ে আমরা এমন বার্তাই আশা করবো।
এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক এই সেনা প্রধান বলেন, বর্তমান বিশ্ব-বাস্তবতায় ভারত বিরোধিতা করে লাভ নেই। বরং দু’দেশের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখে কী করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া যায় সে চিন্তাই করা উচিৎ।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে অবস্থানরত বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. ওসমান ফারুকের মতে, অত্যন্ত পরিণত গণতান্ত্রিক একটি দেশ ভারত নিশ্চয়ই বাংলাদেশেও গণতন্ত্রের পক্ষে থাকবে। সুতরাং এদেশে কোন ধরনের গণতন্ত্র এখন চালু আছে মোদি সরকারের তা অজানা নয়। তাই আমরা আশা করতে পারি, মোদির সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ গণতন্ত্রের পথে উত্তরণের সুযোগ পাবে।
এক প্রশ্নের জবাবে ড. ওসমান ফারুক জানান, বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে সাক্ষাতের সময়সূচি আনুষ্ঠানিকভাবে জানা যায়নি। তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে শোনা যায় ৭ জুন মোদি-খালেদা সাক্ষাৎ হতে পারে।
দলের পক্ষে কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী বিএনপি চেয়ারপারসনের আরও দুই উপদেষ্টা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও ইনাম আহমেদ চৌধুরী এ প্রতিবেদকের কাছে স্বীকার করেন, কিছু কিছু ঘটনায় বিএনপির সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে কিছুটা ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এখন তা শোধরানোর চেষ্টা চলছে। তবে মোদির সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের ইতিবাচক বার্তা পাওয়া যাবে বলে ওই দু’নেতাও আশা প্রকাশ করেন। তাদের মতে, বাংলাদেশের জনগণের মত বা সেন্টিমেন্টের বিরুদ্ধে ভারত যাবে না।
৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকানোর ব্যর্থ আন্দোলনের পর এর আগে গত বছর মে মাস পর্যন্ত ভারতের লোকসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে ছিল বিএনপি। দলটি মনে করেছে, কংগ্রেসের জায়গায় বিজেপির নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় এলে পরিস্থিতি বদলাবে এবং বিএনপির অনুকূলে যাবে। পরবর্তীতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় এলে দলটির মধ্যে স্বস্তি তৈরি হয় এবং দ্বিতীয় দফা সরকারবিরোধী আন্দোলনের প্রস্তুতি নেয়। অবশ্য ভারতে কেন্দ্রীয় সরকারে পরিবর্তন এলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলের পক্ষ থেকে দিল্লির সমর্থনের আশায় বেশ কিছুদিন লবিং পাল্টা লবিং চলতে থাকে। এক পর্যায়ে নভেম্বর-ডিসেম্বর নাগাদ বিএনপি মনে করতে থাকে; ভারত বিএনপির পক্ষে না থাকলেও অন্তত ‘নিরপেক্ষ’ থাকবে। এ পরিস্থিতিতে সরকারের এক বছর পূর্তি অর্থাৎ ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে দলটি আন্দোলনে নামে। কিন্তু সাংগঠনিক শক্তির অভাবসহ বিভিন্ন কারণে তিন মাসের লাগাতার ওই আন্দোলন ব্যর্থ হয়। এ পরিস্থিতিতে বিএনপির এখনকার মূল্যায়ন হলো; ভারতের সঙ্গে তাদের সুসম্পর্ক এখনও তৈরি হয়নি। বিভিন্ন কারণে দেশটি হয়তো এখনও তাদের বিশ্বাস করছে না। ফলে যেসব ইস্যুতে বিএনপির সঙ্গে ভারতের ভুল বোঝাবুঝি রয়েছে সেগুলো দূর করে তৃতীয়বারের মতো মোদির সফরের দিকে মুখিয়ে আছে বিএনপি।
আলোচনায় যেসব ইস্যু বিএনপির সামনে:
দলটির নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে জানা যায়, ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে এমন কোন কাজকে বিএনপি ভবিষ্যতে কখনোই উৎসাহ যোগাবে না বলে ভারতকে আশ্বস্ত করতে চায়।
এ ছাড়া প্রসঙ্গ উঠলে ভারতকে ট্রানজিট ও পোর্ট ব্যবহার করতে দেওয়ার প্রশ্নে বিএনপি তাদের অনাপত্তির কথাও জানাবে। বলা হবে, এক্ষেত্রে মাশুল বা চার্জ নির্ধারণের বিষয়টি দু’দেশের সম্মতিতে হওয়া বাঞ্ছনীয়।
এসব ইস্যুতে সংশ্লিষ্ট এবং আলোচনার জন্য ‘হোমওয়ার্ক’ করছেন এমন বিএনপি নেতারা স্বীকার করেন, ক্ষমতায় থাকতে এসব ইস্যুতে বিএনপি ভারতের জন্য তেমন কিছুই করেনি বলে দেশটির ক্ষমতার কেন্দ্রগুলোতে অসন্তুষ্টি রয়েছে। প্রয়োজন হলে এগুলোর জন্য ‘দুঃখপ্রকাশ’ করে ভবিষ্যদের জন্য বিএনপি আরও বেশি ইতিবাচক বলে ভারতকে আশ্বস্ত করা হবে।
সূত্রমতে, ২০১৩ সালের মার্চে বাংলাদেশ সফরের সময় ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর সঙ্গে সময়সূচি নির্ধারণ করা থাকতেও তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়ার সাক্ষাৎ না করতে বিষয়টি নিয়ে গত দু’বছর যাবত অস্বস্তিতে আছে বিএনপি। নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলোর দাবি, দেশটির কূটনীতিকদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় দলটি এ প্রশ্নে অনেকবার দুঃখ প্রকাশ করেছে। এখনও দলটির নেতারা এজন্য অনুতপ্ত। তবে বিজেপির প্রধানমন্ত্রী মোদি কংগ্রেস রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঘটনাটির উত্থাপন করবেন না বলেই ধরে নিয়েছেন বিএনপি নেতারা।
তবে মোদির সঙ্গে আলোচনায় বিএনপি সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে চায় বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পথে উত্তরণের ইস্যুটি। কীভাবে বাংলাদেশে গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে; তার প্রেক্ষাপট এবং ঘটনা-প্রবাহ নিশ্চয়ই ভারতের অজানা নয় এমন যুক্তি তুলে ধরে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচনের জন্য বিএনপি ভারতের সহায়তা কামনা করবে। বলবে, এ প্রশ্নে সংলাপের উদ্যোগ নেয়া হলে ভারতের মধ্যস্থতা বিএনপি মানতে রাজি আছে।
এ প্রশ্নে বিএনপির সামনে সবচে বড় যুক্তি হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব এবং বিশ্বের খুব কম দেশই এ নির্বাচনকে সুষ্ঠু বলেছে। সর্বশেষ তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন ‘ভোট ডাকাতি’র বড় উদাহরণ বলে বিএনপি তুলে ধরবে।
পাশাপাশি বাংলাদেশে কোনও বিশেষ সরকার বা বিশেষ দল নয়; এদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষারও আহ্বান জানাবে বিএনপি। এগুলোর বাইরে দলীয় নেতা সালাউদ্দিন আহমেদকে দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনায় নেওয়ার দাবি জানাবে বিএনপি।
সূত্র : ট্রিবিউন