৫ জানুয়ারি গণতন্ত্র হত্যা না গণতন্ত্র রক্ষা দিবস?
প্রকাশিত হয়েছে : ৪:৪৭:১৭,অপরাহ্ন ০৬ জানুয়ারি ২০১৫
আবদুল গাফফার চৌধুরী
দীর্ঘ কয়েক সপ্তাহ ‘কালের কণ্ঠের’ পাতায় অনুপস্থিত থাকার পর ইচ্ছা ছিল বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে কয়েক দিন অবস্থানের অভিজ্ঞতা নিয়ে কিছু লিখব। কিন্তু পাঠকদের তাগাদা, ৫ জানুয়ারি নিয়ে কিছু লিখতে হবে। পাঠকদের হুকুমই শিরোধার্য করে নিলাম। ২৭ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে লন্ডনে ফিরে এসেছি। তখনই শুনে এসেছিলাম, ৫ জানুয়ারি এবার দেশে একটা হুড়হাঙ্গামা হবে। হাসিনা সরকারের পদত্যাগ এবং নতুন নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি এবার একটা শোডাউন করবে।
২১ থেকে ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমি ছিলাম পশ্চিমবঙ্গে। তখন দু-দুটো হরতাল হয়ে গেছে ঢাকায়। একটা ডেকেছিল বিএনপি, অন্যটি জামায়াত। দুটিই ফ্লপ হরতাল। মানুষ সাড়া দেয়নি। সুতরাং ৫ জানুয়ারি নিয়েও বিএনপি দেশে বড় রকমের হুড়হাঙ্গামা করতে পারবে এ আশঙ্কা আমি কলকাতায় বসেও করিনি। ৫ জানুয়ারি এখন আর আন্দোলনের কোনো ইস্যু নয়। অন্তত দেশের মানুষের কাছে নয়। গত বছর ৫ জানুয়ারি বিএনপি বর্জন করা সত্ত্বেও দেশে যে নির্বাচন হয়েছে তার বৈধতা নিয়ে বিএনপি দেশে-বিদেশে বহু হইচই সৃষ্টির চেষ্টা করেছে। তা হালে পানি পায়নি।
দেশে-বিদেশে যে নির্বাচনটি নিয়ে এখন আর কোনো বিতর্ক নেই, দেশের মানুষও যে নির্বাচনটি মেনে নিয়েছে, তা নিয়ে নতুন করে পানি ঘোলা করার কোনো অর্থ হয় না। বিএনপি স্বেচ্ছায় গত পাঁচ বছরের নির্বাচন বর্জন করেছে। এখন তাকে পরবর্তী নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তার আগে আন্দোলন করতে হলে জনগণের আশু দাবিদাওয়াভিত্তিক ইস্যু নিয়ে আন্দোলনে নামতে হবে। তাতেও জনগণের সম্মতি চাই। জনগণের ইচ্ছার বাইরে আন্দোলনে কী হয় তা তো বিএনপি গত এক বছর ধরে দেখছে।
আমি লন্ডনে ফিরে আসার পর শুনলাম, খালেদা জিয়া একটি সাত দফা দাবি ঘোষণা করেছেন। দফাগুলো পড়ে দেখলাম, তাতে নতুন কোনো কথা নেই। বড় দাবি হাসিনা সরকারের পদত্যাগ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠান। সেই থোড় বড়ি খাঁড়া। এটা মামার বাড়ির আবদার। যে দাবির পেছনে জনসমর্থন নেই, তা কোনো সরকার মানতে যাবে কেন?
আওয়ামী লীগের নেতা তোফায়েল আহমেদ যথার্থই বলেছেন, ‘ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণার পর তার পেছনে জনমত তৈরি করার জন্য উল্কার মতো সারা দেশ ঘুরেছেন। জেল-জুলুম সহ্য করেছেন। আর বেগম জিয়া ঘরে বসে সাত দফার পুরনো কেচ্ছা নিয়ে বেরিয়েই ভাবেন জনসমর্থন পাবেন? তিনি তাঁর সাত দফা নিয়ে জনগণের কাছে যান, তাদের সমর্থন আদায় করুন। তারপর আন্দোলনে যান। তারপর সরকার তাঁর কথা শুনবে।’
তোফায়েল আহমেদের এই উপদেশটি খালেদা জিয়া কানে নেননি। কারণ তাঁর কান এখন একজন মাত্র লোকের উপদেশ শোনার জন্য খোলা থাকে। তিনি তাঁর ‘সুপুত্র’ তারেক রহমান। তিনি দেশের আদালতের দণ্ড থেকে বাঁচার জন্য অসুস্থতার ভান করে দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে আছেন। তিনি বিদেশে বসে কলকাঠি নাড়েন, আর দেশে বসে তাঁর মা তাতে নড়েন-চড়েন। তাতে জনগণ সাড়া দেয় না।
এখন তো ফাঁস হয়ে গেছে, গত বছরের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনের যে নির্বুদ্ধিতা বিএনপি দেখিয়েছে, তা এই তারেক রহমানের পরামর্শের ফল। জাতিসংঘের দূতের মাধ্যমে ঠিক হয়ে গিয়েছিল, শেখ হাসিনা নির্বাচনকালীন সরকারে প্রধানমন্ত্রী থাকলেও তাঁর কোনো নির্বাহী ক্ষমতা থাকবে না। বিএনপি মন্ত্রিসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদসহ যেকোনো পদ চায়, আওয়ামী লীগ তা মেনে নেবে। আওয়ামী লীগ তা মেনে নিয়েছিল এবং বিএনপিও নির্বাচনে যোগ দিতে মত দিতে যাচ্ছিল। ঠিক এই সময় লন্ডন থেকে মায়ের কাছে তারেক রহমানের টেলিফোন। শেখ হাসিনার পদত্যাগ ছাড়া নির্বাচনে অংশগ্রহণ নয়। অমনি খালেদা জিয়ার মত পাল্টে গেল। তিনি নির্বাচনে যাবেন না বলে জানিয়ে দেন।
ফলে বিএনপিকে ছাড়াই নির্বাচন হয়েছে। এই অপরাধ কি শেখ হাসিনা বা তাঁর সরকারের? পাকিস্তান আমলে ১৯৭০ সালের ক্রুশিয়াল সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের তখনকার অন্যতম বৃহত্তম দল ভাসানী ন্যাপ ‘ভোটের আগে ভাত চাই’ স্লোগান তুলে নির্বাচন বর্জন করেছিল। তাতে কি ১৯৭০ সালের নির্বাচনটি অবৈধ হয়ে গিয়েছিল, না সেই হাস্যকর দাবি কেউ তুলেছিল?
৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচনে দেশের ছোট-বড় কোনো দলকে যোগ দিতে বাধা দেওয়া হলে বলা যেত নির্বাচনটি অবৈধ, একতরফা। বিএনপি নিজে আত্মহত্যা করে যদি খুনের দায় অন্যের ওপর চাপায় তা তো কেউ মেনে নিতে পারে না। বিগ এনজিওর পৃষ্ঠপোষকতায় ও অর্থানুকূল্যে সৃষ্ট একটি তথাকথিত সুধীসমাজ এবং দু-একটি তথাকথিত নিরপেক্ষ মিডিয়া তাতে সমর্থন জানাতে পারে; দেশের মানুষ তাতে সমর্থন দেয়নি এবং বিএনপি এক বছর ধরে আন্দোলনের নামে খোঁড়া পায়ে ঘোড়ার নাচন নেচেছে।
বিএনপি-জামায়াত জোট দেশে আন্দোলনের ডাক দিলে আন্দোলনের নামে কী ভয়াবহ সন্ত্রাস সৃষ্টি করে তার প্রমাণ দেশের মানুষ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগের ছয় মাস ধরে দেখেছে। সুতরাং বিএনপি যখন বলে ৫ জানুয়ারি তারিখটিকে তারা গণতন্ত্র হত্যা দিবস হিসেবে পালন করবে, তখন দেশের মানুষ জানে, ৫ জানুয়ারি গণতন্ত্র হত্যা দিবস নয়, গণতন্ত্র রক্ষা দিবস। গত বছর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি যদি না হতো, বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাস যদি সফল হতো, তাহলে দেশে যা প্রতিষ্ঠিত হতো তা গণতন্ত্র নয়, তালেবানতন্ত্র।
বিএনপি-জামায়াতের গত সরকারের সময় বাংলাভাইদের অভ্যুত্থানের মতো সিরিয়া-ইরাকের আইসিসের রক্তাক্ত থাবা সম্প্রসারিত হতো বাংলাদেশ পর্যন্ত। তাকে অনুসরণ করত মার্কিন ড্রোন হামলা। ইসলামী স্টেট প্রতিষ্ঠার নামে গলাকাটা বর্বরতার দৃশ্য দেখতে হতো বাংলাদেশেও। তল্পিবাহক সুধীসমাজটি হয়তো এই গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাই বাংলাদেশে দেখতে চেয়েছিল। এই ‘গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হলে তারা আর দেশে থাকত না। আইসিস আর ড্রোন হামলার শিকার হতো বাংলার হতভাগ্য সাধারণ মানুষ। গণতন্ত্রের কিছুটা ছাঁটকাট হলেও হাসিনা সরকার যে গত বছর ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠানে অটল থেকে দেশকে এবং দেশের গণতন্ত্রকে রক্ষা করেছে এই সত্যটা এখন স্বীকৃত হওয়া প্রয়োজন। আসলেই ৫ জানুয়ারি গণতন্ত্র হত্যার দিবস নয়, গণতন্ত্র রক্ষার দিবস।
এ বছরও সাত দফা দাবি ঘোষণার পর সেই দাবি নিয়ে ঘোষণা করে এই দিবসটিতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জনসমাবেশ ঘটানোর চেষ্টা করে। সরকার ঢাকায় এই জনসমাবেশ ঘটানোতে বাধা দিয়েছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় অফিসে তালা মেরে দেওয়া হয়েছে। তাদের মিছিল বের করার চেষ্টা সফল হয়নি। রাজশাহীতে আওয়ামী লীগ অফিসে আগুন দেওয়া হয়েছে। নাটোরে দুই ব্যক্তি গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন। সেখানে আজ (মঙ্গলবার) বিএনপি হরতাল ডেকেছে। এক কথায় আমি এই নিবন্ধ লেখার সময় পর্যন্ত বিএনপি তার শক্তি প্রদর্শনের মহড়ায় সফল হয়নি।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, বিএনপির পেছনে জনসমর্থন নেই জেনেও সরকার কেন তাদের ঢাকায় জনসমাবেশ করতে দিল না? কী হতো একটি জনসমর্থনহীন দলকে একটি জনসমাবেশ করতে দিলে? সরকার হয়তো এই জনসমাবেশ করতে দিত; যেমন দিয়েছিল ছাত্রদলকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার অনুমতি। তারা পারেনি। অফিসে বসে কেক কেটে বিদায় নিয়েছে। ৫ জানুয়ারি বিএনপিকে জনসমাবেশ করতে দিলে কি তাই ঘটত? দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তা মনে করে না।
গোয়েন্দা সংস্থার সংগৃহীত খবর হলো, ৫ জানুয়ারি জনসমাবেশ করার নামে বিএনপির দেশব্যাপী অরাজকতা সৃষ্টির সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছিল। নির্দেশ এসেছিল লন্ডন থেকে তারেক রহমানের কাছ থেকে। তারেক রহমান ৫ জানুয়ারির আগের দিন ৪ জানুয়ারি লন্ডনে এক সভা করেন। তাতে হুংকার দিয়ে বলেন, ‘শেখ হাসিনাকে গদি থেকে টেনে না নামানো পর্যন্ত বিএনপির নেতা-কর্মীরা ঘরে ফিরবে না।’ বাস্তবে ঢাকায় সরকার হার্ডলাইন নেওয়ায় বিএনপির নেতা-কর্মীরা (খালেদা জিয়াসহ) ঘর থেকেই বেরোতে পারেননি।
গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যে তথ্য ফাঁস করেছে তা সত্য হলে জননিরাপত্তার স্বার্থে সরকারের কঠোর অবস্থান না নিয়ে উপায় ছিল না। ৫ জানুয়ারি ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ পালনের নামে দেশময় অরাজকতা সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপ জেএমবি, হুজি ও উলফার নেতাদের সঙ্গে বিএনপি নেতারা গোপন বৈঠক করেন এবং তাঁদের পরিকল্পনা নাকি ছিল ৫ জানুয়ারি জনসমাবেশ ঘটানোর নামে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও মন্ত্রীদের টার্গেট করে হামলা চালানো এবং সারা দেশে ধারাবাহিকভাবে বিস্ফোরণ ঘটানো।
গোয়েন্দা পুলিশ যে তথ্য উদ্ধার করেছে তা হলো, গত শনিবার রাতে খালেদা জিয়া বিএনপির নয়াপল্টনের অফিসে যাওয়ার নাম করে গুলশান অফিস থেকে বেরোচ্ছিলেন। আসলে তাঁর গন্তব্য ছিল জাতীয় প্রেসক্লাব। সেখানে ঢুকে তিনি অবস্থান নিতেন। যেহেতু জাতীয় প্রেসক্লাব শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত, তিনি সেখানে অবস্থান নিয়ে অনবরত সভা করা ও অরাজকতা সৃষ্টির উসকানি দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হতো। গোয়েন্দা সংস্থা আগেভাগে এ খবর জেনে তাঁর গুলশান অফিস থেকে বাইরে আসা আটকে দেয়।
আন্দোলন করা আর নাশকতামূলক কাজ এক ব্যাপার নয়। বিএনপি-জামায়াত জোট অতীতে বারবার আন্দোলনের নামে দেশময় নাশকতামূলক কাজে নেমেছে। সুতরাং এ বছর ৫ জানুয়ারিতেও জনসমাবেশ ঘটানোর নামে দেশময় সন্ত্রাস ও অরাজকতা সৃষ্টির প্রচেষ্টায় তারা নামতে চাইলে বিস্ময়ের কিছু নেই। বিএনপির অতীতের কার্যকলাপ থেকে তার বর্তমান অভিসন্ধি সম্পর্কেও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর রিপোর্ট তাই অসত্য মনে করার কোনো কারণ নেই।
৫ জানুয়ারির জনসমাবেশের উদ্দেশ্য যে ছিল সন্ত্রাস ও অরাজকতা সৃষ্টি করে সরকারের পতন ঘটানো তার আগের দিন লন্ডনের সভায় তারেক রহমানের হুংকার থেকেই তা বোঝা যায়। বিএনপির এই পলাতক নেতা লন্ডনের নিরাপদ আশ্রয়ে বসে হুংকার দিচ্ছেন, ‘হাসিনা সরকারের পতন না ঘটিয়ে তাঁর দলের নেতা-কর্মীরা ঘরে ফিরবে না।’ এই হুমকির মুখে দেশের সরকার কঠোর অবস্থান নেওয়ায় মাতা-পুত্রের গোপন ষড়যন্ত্র সফল হয়নি; বিএনপির নেতা-কর্মীরা ঘরে ফেরা দূরের কথা, ঘরের বাইরেই বেরোতে পারেনি।
৫ জানুয়ারি বাংলাদেশে গণতন্ত্র হত্যা দিবস নয়, গণতন্ত্র রক্ষা দিবস। গণতন্ত্রকেও আত্মরক্ষার জন্য কখনো কখনো কঠোর অবস্থান নিতে হয়। দেশের চিহ্নিত অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সেই কঠোর অবস্থান নিয়ে হাসিনা সরকার গণতন্ত্র রক্ষারই কাজ করেছে।- লেখাটি দৈনিক কালের কণ্ঠে প্রথম প্রকাশিত