আই এম এ ডটার অফ জয় বাংলা: মনোয়ারা ক্লার্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ১১:৩১:৪৭,অপরাহ্ন ১৫ ডিসেম্বর ২০১৪
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল
আমি বাংলাদেশের মেয়ে:
ভ্যাঙ্কুভার বিশ্বের সেরা শহরের শীর্ষে। তাই কানাডার বৃটিশ কলম্বিয়ার ভ্যাঙ্কুভারকে বলা হয় ভূস্বর্গ! ভূস্বর্গ থেকে নেমে আসা বিশ্বের অন্যতম নোংরা শহর ঢাকাকে মনোয়ারার কিছুতেই ‘নরক’ মনে হচ্ছে না। বরং প্রতি মূহুর্তেই এই শহর, এই দেশ, এই দেশের মানুষগুলোকে তাঁর আরো আপন, আরো কাছের স্বজন মনে হচ্ছে। এতোদিন শাদা স্রোতের বিপরীতে ছিলো, আজ যেনো নিজের বাদামী স্রোতে মিশে গেছে মনোয়ারা। মুগ্ধ হতে দেখছে- নানা ধরণের মানুষ। মানুষের আচার-আচরণ, মানুষের ভীড়-ব্যস্ততা, মানুষের ভালোবাসা-কষ্ট। জটিল জ্যাম। ট্রাফিকবিহীন রিকশা-গাড়ির ধাক্কাধাক্কি। উদ্ভট হর্ণের চিৎকার! শিকড়ের সন্ধানে এসে মনোয়ারার কিসের এক টানে কোথায় যেনো কি গেঁথে যাচ্ছে। বুকের ভেতর কি যেনো কি আটকে যাচ্ছে, টের পাচ্ছে!
বসুন্ধরা সিটিতে এসেছে কিছু দেশি জামা কাপড় কিনতে। জীবনে কোনো দিন সে শাড়ি পরেনি। অথচ বাঙালি মেয়েদের প্রধান পোষাক শাড়ি। শাড়ি তো এক অসাধারণ ড্রেস। দীর্ঘ দশ হাত লম্বা একটা কাপড়- যাতে কোনো সেলাই নেই, কোনো বোতাম নেই। কি অদ্ভূত ভাবে জড়িয়ে থাকে শরীরে। এক বার এক বাঙালি বোন কানাডায় তাকে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছিলো। এবার কিছু শাড়ি কিনে নিয়ে যাবে। আজ আপাততঃ দু’একটা সুঁতির ফতুয়া নিবে।
বসুন্ধরা সিটির সিঁড়িতে পা দিয়েই দেখে রাস্তার ওপাশ থেকে একটা কুকুরের বাচ্চা করুণ চিৎকার দিয়ে প্রাণপন দৌঁড়ে আসছে। কিন্তু কেউ বাচ্চাটিকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে আসছেনা। বরং যার পায়ের একটু আশ্রয়-মনতি চাচ্ছে; সে-ই দূরদূর করে লাত্থি দিয়ে তাড়িয়ে দিচ্ছে। অসহায় ছোট বাচ্ছাটি মাটিতে শুয়ে পড়ে আকাশের দিকে পা তুলে যেনো প্রভুর কাছে প্রার্থণা করছে- আমাকে বাঁচাও, আমাকে বাচাঁও…
মনোয়ারা ছুটে গিয়ে কুকুরের বাচ্চাটিকে জড়িয়ে ধরে, কোলে তুলে নেয়। আদর করে ডাকে- পপি। পপি মানে কুকুরছানা। আর পথের পিতামাতাহীন অবহেলিত পপিটি যেনো মাদার তেরেসার আশ্রয় পেয়ে যায়। পপির গা থেকে রক্ত ঝরছে। কে যেনো ইট-পাথরের ঢিল ছুঁড়েছিলো। পিঠের একটা জায়গা থেতলে গেছে। লোমে জমাট রক্ত!
নিজের স্কার্ফ দিয়ে আলতু করে রক্ত পরিষ্কার করে। তার এই আচরণ দেখে আরিফ খুব বিরক্ত হয়। আর মনে মনে বলে, কুত্তার বাচ্চা নিয়ে এই বাড়বাড়ি একেবারেই অসহ্য!
মনোয়ারা কাপড়চোপড় কেনা বাদ দিয়ে পাশের সেবা ফার্মেসিতে ছুটে যায়। ফার্মেসিতে ডাক্তার নেই। কম্পাউন্ডার জানায়, তারা মানুষের চিকিৎসা দেয়, মানুষের জন্য ঔষধ বিক্রি করে। এখানে কুত্তার চিকিৎসা নাই, কুত্তার ঔষধ নেই। এমন ভাবে ‘কুত্তা’ শব্দ উচ্চারণ করে, তাতে মনে হয়- গালি দিচ্ছে।
মনোয়ারা বাংলা না বলতে পারলেও কিছুটা বুঝতে পারে। সে ইংরেজিতেই বলেঃ
-এটা তো কুত্তা নয়; কুকুরের ছানা। পপি। আমার পপি।
-হ। নায়িকা পপি। নিয়ে সিনেমা বানান। হাহাহাহা…
-হোয়াট!
মনোয়ারা এবার আর কিছুই বুঝতে পারলোনা। আরিফ বললো, তোমার পপিকে পশু হাসপাতালে নিতে হবে। পশুর ডাক্তার দেকাহতে হবে। পশু হাসপাতাল তো মনে হয়- শ্যামলীতে কোথায় যেনো আছে। শুনেছে। মনে করতে পারছেনা।
একজন পথচারী বললো, কাটাবনে যান। সেখানে অনেক পশু-পাখি, কুকুর-বিড়াল, বেজি-বানরের দোকান আছে। তারা খোঁজ খবর দিতে পারবে। হয়তো কিছু প্রাথমিক চিকিৎসাও থাকতে পারে।
মনোয়ারা আরিফকে নিয়ে ছুটে যায় শাহবাগের কাটাবনে। পথের নামহীন গোত্রহীন পপির পিঠের রক্তাক্ত ক্ষতচিহ্নের সাথে মনোয়ারা নিজের পিঠের ক্ষতাক্ত দাগ মিলাতে থাকে।
আমি বীরঙ্গনার মেয়ে:
পপি আর মনোয়ারা যেনো এতিমের প্রতীক! পৃথিবীতে এদের কেউ নেই। এরা এভাবেই বেড়ে উঠে, এভাবেই বড় হয়। জন্মই তাদের আজন্ম পাপ। আহ, স্বাধীনতা কি সুন্দর! আর সেই সুন্দরের ভেতর একটি কালো দাগ চাঁদের কলঙ্কের মত। তাই যুদ্ধোত্তর দেশে জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু বীরঙ্গনা আর যুদ্ধশিশু নিয়ে ভীষণ সমস্যায় ছিলেন। তাই যুদ্ধশিশু তথা অবৈধ জারজ সন্তানদেরকে দ্রুত দেশ বিতাড়িত করার জন্য বিদেশের কাছে দত্তক দেয়ার আহবান জানিয়ে ছিলেন। সেই ডাকে সাড়া দিইয়েছিলো- কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, সুইডেন, নরওয়ে। আর তার আগেই কলকাতার মা মাদার তেরেসা দায়মার ভূমিকা নিয়েছিলেন।
৪৩ বছর পর মাতৃভূমিতে মায়ের সন্ধানে এসে অনেক ইতিহাস জানছে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে অনেক কিছু দেখছে। দেখছে ১৯৭১। দেখে দেখে কেঁদেছে। নির্যাতিত নারীদের মাঝে মাকে খুঁজেছে। এরাই মনোয়ারার মা। তার এক মা এখন হাজার হাজার মা হয়ে গেছে। সন্তান প্রসবিত মৃত মায়ের ঐতিহাসিক ছবিটাই কি তার মা? আজ তার মনে নানান প্রশ্ন উদয় হচ্ছে। যে সব প্রশ্নের উত্তর নেই!
-তার মায়ের কি নাম ছিলো? আনোয়ারা।
-মা কি দেখতে তার মতো ছিলো? যেমন জুলিয়া নিজের মতো।
-তার অবৈধ বাবা ছাড়াও কি মার সুখের জীবনে আমার আরেক জন মুক্তিযোদ্ধা বাবা ছিলো? সেই অপরাধে রাজাকারেরা মা আনোয়ারাকে খান সেনাদের হাতে তুলে দিয়েছে। সেই বাবা কি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছে?
গল্প-উপন্যাসের চেয়েও বীরঙ্গনা আনোয়ারা আর যুদ্ধশিশু মনোয়ারাদের জবাবহীন জীবন আরো অনেক বেশি জটিল। আনোয়ারা আজ কোথায়? মনোয়ারারা দেশ থেকে দূরে থাকলেও ইতিহাস থেকে দূরে নয়।
এখন অনেক রাত। ডিসেম্বর মাস। বাইরে বেশ শীত। যদিও কানাডার মত না। তবু মনোয়ারা একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে নিয়ে ছাদে যায়। তার আগে দেখে নেয় পপি ঘুমুচ্ছে। নির্জন ছাদে শীতের হালকা কুয়াশা আর চাঁদের আলো মিলেমিশে একাকার! আহ, গায়ে জড়ানো চাদর যেনো মায়ের আদর। কুয়াশা আর জোছনার মিললিশ যেনো আনোয়ারা-মনোয়ারা মহা মিলন! ইশ, এখন যদি আকাশ থেকে পরী হয়ে চুপিচুপি আমার মা আমার কাছে চলে আসতো। শুধু একটি বারের জন্য। শুধু একটি বার। পাশের বাড়ির নিমফুল নাকি শিউলি ফুলের হালকা মিষ্টি সুবাস ভেসে আসছে। মনে হচ্ছে- আমার মায়ের চুলের ঘ্রাণ!
মা, আমি তো তোমার কাছে এসেছি। তুমি আমার কাছে আসো। আমাকে প্রাণ ভরে একটু আদর করো, একটু স্নেহ দাও। জননী আমার আমাকে তোমার বুকের মাঝে জড়িয়ে নাও। মা, মা গো, ও মা; আমি চির দুঃখিনী এক মেয়ে। এই বিশাল পৃথিবীতে আমার কেউ নেই। কিচ্ছু নেই। আমি বড় তৃষ্ণার্ত মা। তোমার বুকের দুধ দিয়ে আমার তৃষ্ণা মিটাও।
বুক ভেঙে কান্না আসে। হু হু করে কেঁদে উঠে মনোয়ারা।
আই এম এ ডটার অফ জয় বাংলা!:
সমাজের শুদ্ধতা বজায় রাখার জন্যই কি মনোয়ারাদের বিতাড়িত করা হয়েছিলো? তারা তো বাংলাদেশেরই সন্তান। শুধু সন্তানই নয়, এই দেশের রক্তাক্ত জন্ম প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশও তাঁরা। কিন্তু কেন তাঁদের জায়গা হলো না এদেশে।
তবু দেশ কেন তাঁকে থাকতে দিল না, কেন এই দেশের কোথাও জায়গা হলো না মনোয়ারার?
মনোয়ারা বড় সরল। সবকিছু বোঝেন সরলরেখায়। কিন্তু তার জীবনটা বাংলাদেশের ‘বা’, আর কানাডার ‘কা’ যুক্ত হয়ে বাঁকা হয়ে গেছে। আর বাঁকার মাখখানে পাকিস্তানের ‘চন্দবিন্দু’ চাঁদের কলঙ্কের তিলক হয়ে আছে। মনোয়ারার জীবনে এক জটিল অংক! গল্প-উপন্যাসের চেয়েও বীরঙ্গনা আনোয়ারা আর যুদ্ধশিশু মনোয়ারাদের জবাবহীন জীবন আরো অনেক বেশি জটিল। আনোয়ারা আজ কোথায়? মনোয়ারারা দেশ থেকে দূরে থাকলেও ইতিহাস থেকে দূরে নয়।
মনোয়ারা মা নেই। মাতৃভূমি বাংলাদেশই তো তার মা। জন্মভূমিই আজ জননীর মাত্রা পেয়েছে। তাই জন্মভূমি এসে মনোয়ারা আজ তৃপ্ত, ধন্য। সারা জীবনের বেদনা, বুকের ভার অনেকটা হালকা হয়ে যাচ্ছে। দেশের মানুষ তাকে এতো আপন করে নিয়েছে। সবাই যেনো তার আপনজন, আত্মীয়! প্রত্যেকের আতিথিয়তা আর আন্তরিকতায় সে মুগ্ধ। সে সেখানে যাচ্ছে, সেখানেই মনে হচ্ছে ফুলের বাগান। আর সে যেনো স্বপ্নের ফুলপরী হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে!
কখনোই ভাবতে পারেনি- দেশের মানুষ তাকে এ ভাবে বরণ করে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করবে! মনে হচ্ছে, এই বিজয়ের মাসে তার আগমন যেনো সবার হৃদয়ে নাড়া দিয়েছে। মিডিয়া তাকে সে সন্মান দিয়েছে, তা ভাবলে চোখে জল এসে যায়।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সহায়তায় অবশেষে মনোয়ারা তাঁর জন্মসনদ পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে। জন্মসনদটা বুকে নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে কাঁদে উঠে। বুকের প্রেশার কুকার থেকে শব্দ আর ধোঁয়ার বের আসে দীর্ঘ ৪৩ বছরের কষ্টগুলো, বেদনাগুলো!
এতো দুঃখ কষ্টের পরো ১২ বছর আগে ফিনল্যান্ডের এক যুবকে বিয়ে করেছিলো। তাঁদের প্রতিবন্ধী সন্তান জুলিয়েটের জন্মের পরই স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে যায় তার। এই অটিস্টিক বেবির জন্য মনোয়ারাকে অভিযুক্ত করে তার স্বামী বলেছিলো, তুমিই এর দায়ী। কারণ, আমার পরিবারের পরিচয় আছে। তোমার কোন পরিচয় নেই-মা নেই, বাবা নেই-তুমি একটা ওয়ারবেবি আর সেকারণেই তোমার বেবিটা অটিস্টিক হয়েছে।”
শুধু প্রাক্তন স্বামীই নয়; বিশ্ববাসীকে আজ তার খুব জানাতে ইচ্ছে করে- আমি আমার জন্ম স্বীকৃতি পেয়েছি। আমি বাঙালি, আমি আজ স্বীকৃত বাংলাদেশি।
সেই কথা মনে করে মনোয়ারা এক বার আনন্দে হাসে, আবার বেদনায় কাঁদে। হাসতে হাসতে, কাঁদতে কাঁদতে বলেঃ “মাই হোল লাইফ ইজ ফুল নেগলিজেন্সিস, আপস অ্যান্ড ডাউন, ব্রোকেন রিলেশনশিপ, অল দিজ মেইড মি সো স্যাড। সো স্যাড। আই জাস্ট ওয়ান্ট মাই বার্থ সার্টিফিকেট। আই ওয়ান্ট টু লিভ মাই লাইফ অ্যাজ বাংলাদেশি। আই এম এ ডটার অফ- জয় বাংলা!”