শিকল বন্দী সুজিতের জীবন!
প্রকাশিত হয়েছে : ১১:১৪:৫৯,অপরাহ্ন ১১ জুন ২০১৫
নিউজ ডেস্ক::
সহপাঠিরা যখন বিদেশে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন আর বড় বড় প্রতিষ্ঠানে চাকরী করছে সেই মুহুর্ত্বে পায়ে শিকল পরে ছোট্ট একটি কক্ষে অনিশ্চিত জীবনের বৃত্তে বন্দী হয়ে আছে সুজিত বড়ুয়া। তারও স্বপ্ন ছিলো পড়ালেখা করে প্রতিষ্ঠিত হবে সমাজে। হাল ধরবে সংসারের। সে স্বপ্ন আজ দুঃস্বপ্নে পরিনত হয়েছে। ভাগ্যের নির্মমতায় সুজিতের জীবন এখন শিকল বন্দী। ১৯৯৮সালে এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার পর ছাত্র আন্দোলনের জেরে গ্রেফতারের পর পুলিশি নির্যাতন সইতে না পেরে স্মৃতিভ্রস্ট হয়ে যায় সুজিত।
মিরসরাইয়ের হাইতকান্দি উচ্চ বিদ্যালয়ের ১৯৯৮ এসএসসি ব্যাচের বিজ্ঞান বিভাগের রোল নং ২ ছিলো সুজিত বড়ুয়ার। সে বছর এসএসসির সব প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যায়। সরকার অংক পরীক্ষা পুনরায় গ্রহনের সিন্ধান্ত নিলে ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করে। পরীক্ষা শেষে মিরসরাই উপজেলায় ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কে গাড়ি অবরোধ করলে এক পর্যায়ে পুলিশ বাসট্যান্ড থেকে গ্রেফতার করে সুজিতকে।
সুজিতের মা নিভা রানী বড়ুয়া জানান, আমার ছেলে খুবই শান্তশিষ্ট স্বভাবের ছিলো। পড়ালেখা ছাড়া আর কিছু চিন্তায় ছিলোনা তার। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করে। সে নির্যাতন সইতে না পেরে অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। বছরের পর বছর চিকিৎসা চালিয়ে গেলেও ভালো হয়নি সুজিত। গত ৩ বছর ধরে একেবারেই স্মৃতিভ্রস্ট হয়ে যাওয়ায় তার পায়ে শিকল পরিয়ে রাখা হয়। ছেলের এমন পরিনতি তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না।
চিকিৎসার ব্যয় নির্বাহ করতে করতে এখন অনেকটা নিঃস্ব। মিরসরাইয়ের হাইতকান্দি ইউনিয়নের দমদমা গ্রামে সুজিতের বাড়ীতে গিয়ে কথা হয় তার পরিবারের সদস্যদের সাথে। যে ঘরে সুজিত পড়লেখা করতো সেই ঘরেই চৌকিতে পায়ে শিকল পরা অবস্থায় বসে আছে সে। রাস্তায় বেরুলে অস্বাভাবিক আচরণ করে তাই পায়ে শিকল পরিয়ে রাখা হয়েছে। কোন ঔষধ খেতে রাজী না হওয়ায় গত তিন বছর ধরে বন্ধ আছে তার চিকিৎসা। এতে শারীরিক অবস্থা দিন দিন অবনতি হচ্ছে তার।
সুজিতের আত্মীয় নিজামপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের প্রভাষক স্বাগতম বড়–য়া বলেন, ১৯৯৮ সালে এসএসসি পরীক্ষার প্রায় শেষ পর্যায়ে ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করে। সুজিত পরীক্ষা শেষে করে বাস স্টপেজে অপেক্ষা করছিলো বাড়ী ফেরার জন্য। সে মিছিলে যোগ না দেওয়া স্বত্ত্বেও পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়। মাথায় আঘাত এবং কারেন্টের শর্ট দেওয়ার ফলে তার স্মৃতি নষ্ট হয়ে যায়। বাকী পরীক্ষাগুলো দেওয়ার জন্য বার বার চেষ্টা করা হলেও আর সম্ভব হয়নি। তখন সে আমার কাছে বলেছিলো পুলিশ তাকে মেরেছে। এর বেশি কিছু আর বলেনি।
সুজিতের ছোট বোন মুন্নি বড়–য়া বলেন, সে দিন থানা থেকে আমার ভাইকে নিয়ে আসার পর সে খুবই অসুস্থ হয়ে পড়ে। সে খুব ভয় পেতো। নিজেকে লুকিয়ে রাখতো। আর পুলিশ তাকে মেরে ফেলবে এসব বলে চিৎকার করতো। তার মুক্তিযোদ্ধা বাবা জগদিস বড়–য়া ২০০১ সালে মৃত্যুবরণ করার পর সুজিতকে নিয়ে বিপাকে পড়ে তার পরিবার। তবুও অনেক কষ্ট করে চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটানা ৩ মাস চিকিৎসা চলে সুজিতের। ডাক্তাররা বোর্ড় বসিয়েছিলে সুজিতের চিকিৎসার জন্য। তাতেও কোন প্রতিকার মেলেনি। ডাক্তারদের আশ্বাসের পরও পুরোপুরি ভালো হয়নি সে। যতদিন ঔষুধ সেবন করতো ততদিন কিছুটা ভালো থাকতো সে। এখন আর ঔষধ সেবন করেনা সুজিত। উন্নত চিকিৎসায় সুজিত ভালো হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও আর্থিক সংকটের কারনে সেটিও সম্ভব হচ্ছে না।
হাইতকান্দি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোঃ গিয়াস উদ্দিন বলেন, একজন আদর্শ ছাত্রের যতগুলো গুন থাকা দরকার তার সবটুকুই ছিলো সুজিতের। তার এমন পরিনতি দেখে শিক্ষক হিসেবে আমার খুবই ভালো লাগে। এমন দূর্ঘটনা না হলে সুজিত দেশের সম্পদে পরিনত হতো।
সুজিতের পরিবারের সদস্যরা জানায়, উন্নত চিকিৎসা পেলে হয়তো ভালো হয়ে উঠবো। এজন্য প্রয়োজন বিত্তবানদের সহযোগীতা। সুজিতের উন্নত চিকিৎসায় তার পরিবারের পক্ষ থেকে সহযোগীতা প্রত্যাশা করা হয়।