ইয়াবার পর মানবপাচারে অভিযুক্ত এমপি বদি
প্রকাশিত হয়েছে : ১১:০৩:০৭,অপরাহ্ন ১৭ মে ২০১৫
নিউজ ডেস্ক::
সাগর বিধৌত কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে অবাধে অবৈধ ইয়াবার ব্যবসার পর সম্প্রতি আলোচিত সাগরপথে সর্বনাশা মানবপাচারের সিন্ডিকেটের সঙ্গেও সরকার দলীয় স্থানীয় এমপি বদির সম্পৃক্ততার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মানবপাচারের সিন্ডিকেট ও এদের গডফাদাররা এমপি বদির সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট। এদের বেশিরভাগই বদির স্বজন ও অনুসারী। অনুসন্ধানে উঠে আসে, অবৈধ এসব চক্রের সামনে-পেছনে থেকে মদদ যোগান কক্সবাজার-৪ আসনের এমপি বদি।
সাম্প্রতিক সময়ে সমুদ্রপথে রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশিদের নিয়ে অবৈধ মানবপাচারের ঘটনা ও সাগরে ভেসে বেড়ানো অবৈধ অভিবাসীদের জীবন-মরণ সংকট সারা বিশ্বকে কাঁপিয়ে তুলেছে। মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত অসংখ্য অসহায় রোহিঙ্গা আর লোভে পড়া ও অপহরণের শিকার বাংলাদেশি যুবকরা এই সর্বনাশা মানবপাচারকারীদের খপ্পড়ে পড়ে জীবন ক্ষয় করছে।
২০০০ সাল থেকে প্রকাশ্যে চলছে মানবপাচার। রোহিঙ্গা নাগরিক তজর মুল্লুকের দেখানো পথ ধরে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি স্বেচ্ছায় এবং অপহরণের শিকার হয়ে সাগরে ভাসতে থাকা ট্রলারে চড়ে বসে। জলপথে এভাবে মানবপাচার করে এ পর্যন্ত অন্তত তিন হাজার ৩০০ কোটি টাকার মুক্তিপণ লেনদেন করেছে পাচারকারীরা। পাচারের শিকার লোকজনের অনেকেই পথেই মারা গেছে। কারো সলিল সমাধি হয়েছে, কারো কারো ঠাঁই হয়েছে থাইল্যান্ডের গহিন জঙ্গলের গণকবরে।
তবে বরাবরই কক্সবাজার জেলা পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের কৌশলের কারণে আড়ালেই থাকছে গডফাদাররা। মানবপাচারের পেছনের মূল হোতা ও তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতার নাম আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানলেও তা গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলোয় আসছে না। তবে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এমপি বদির ঘনিষ্ঠজন ও অনুগতরাই মানবপাচার ও হাজার কোটি টাকার হুন্ডি ব্যবসার সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত।
নগদের পাশাপাশি পাচারের টাকা লেনদেন হয় বিকাশ, হুন্ডি ও ব্যাংকের মাধ্যমেও। স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও পুলিশের পকেটেও যায় সেই টাকার ভাগ।
সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির আত্মীয়স্বজন, উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা এবং পুলিশ সদস্যদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদ কাজে লাগিয়ে কক্সবাজার থেকে প্রায় প্রতি রাতেই মালয়েশিয়ায় পাচারের উদ্দেশ্যে ট্রলারে তোলা হচ্ছে বিপুলসংখ্যক মানুষ।
মানবপাচার প্রতিরোধে গঠিত পুলিশের সেই কমিটির অনুসন্ধানে উঠে আসা পাচারকারীদের বিষয়ে খোঁজখবর নিতে গিয়ে সুনির্দিষ্ট এসব তথ্য পাওয়া গেছে। অনুসন্ধান কমিটির তালিকায় পাচারকারী হিসেবে টেকনাফ ও উখিয়া আওয়ামী লীগ-যুবলীগের অনেক নেতার নাম উঠে এলেও পুলিশ কৌশলে নামের পাশে তাদের রাজনৈতিক পরিচয় উল্লেখ করেনি।
তবে অনুসন্ধানে দেখা যায়, পাচারে সহায়তাকারী হিসেবে কিংবা পাচারের টাকা লেনদেনে জড়িতদের বেশির ভাগ লোকই স্থানীয় আওয়ামী লীগ-যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আবার আর্থিক বিষয় জড়িত থাকায় বিএনপির অনেক স্থানীয় নেতাও পাচারের সঙ্গে জড়িয়েছেন। রাজনীতির মাঠে বিরোধিতা থাকলেও মানবপাচারের ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের নেতারা হাতে হাত রেখে চলেন।
পুলিশের অনুসন্ধান প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী ২০১৪ সালে ১৫ থেকে ২০ হাজার লোক অবৈধভাবে সমুদ্রপথে পাচার হয়েছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রায় দেড় লাখ মানুষ অবৈধভাবে যাত্রা করেছে।
তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে দুই লাখ থেকে দুই লাখ ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত মুক্তিপণ আদায় করে দালালরা। মুক্তিপণ পাওয়ার পর কিছু মানুষ মালয়েশিয়া গিয়ে চাকরি পেয়েছে। সে কথা জানার পর আরো অনেকে মালয়েশিয়ায় যেতে স্বেচ্ছায় ট্রলারে উঠেছে।
আবার পাচারকারীরা শত শত সাধারণ মানুষকে অপহরণের পর বিক্রি করে দিয়েছে। পরে তাদের পরিবারের কাছ থেকেও মুক্তিপণ আদায় করা হয়। প্রতিজনের কাছ থেকে গড়ে দুই লাখ ২০ হাজার টাকা করে দেড় লাখ মানুষের কাছ থেকে প্রায় তিন হাজার ৩০০ কোটি টাকা আদায় করেছে পাচারকারীরা। পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতারা ওই টাকার ভাগ পান।
গডফাদাররা আড়ালে
উখিয়ার জালিয়াপালং ইউপির ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আবু তাহের ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে পরিচিত। যদিও আওয়ামী লীগের কোনো কমিটিতেই তার নাম নেই। তার বিরুদ্ধে পাচারকারীদের সহযোগিতা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তিনি এ বছরের শুরুতে স্থানীয় বিজিবির ক্যাম্পে হামলার মামলারও আসামি।
তবে আবু তাহের বলেন, ‘আমি মানবপাচার, হুন্ডি ব্যবসা কিংবা ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নই। এসব মিথ্যা অভিযোগ।’ বিজিবির ক্যাম্পে হামলা ও মামলার আসামি বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি বিজিবির ক্যাম্পে হামলা করিনি, মামলার আসামিও নই।’ যদিও বিজিবি ক্যাম্পে হামলা মামলার এজাহারে তার নাম আছে।
পুলিশের অনুসন্ধান কমিটির তালিকায় পাচারকারী হিসেবে ১০৭ নম্বরে আছে টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি আক্তার কামাল (৩৫)। এ বিষয়ে কথা বলতে তার মোবাইলে ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। তালিকায় আক্তার কামালের ভাই সাইদ কামালের নাম আছে ১০৮ নম্বরে।
স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, টেকনাফ উপজেলা যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক নূর হোসেন আক্তার ও সাইদের কাছের আত্মীয়। তাদের চাচা পুলিশ পরিদর্শক আবদুর রহমান এমপি বদির ছোট বোনের স্বামী। ফলে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় তারা এলাকায় দাপটের সঙ্গে অবস্থান করছেন। পুলিশ পরিদর্শক আবদুর রহমানের সৎভাই হামিদ হোসেন পাচারকারীর তালিকায় ১৩৭ নম্বরে আছে।
আক্তার ও সাঈদকে সহযোগিতা দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে নূর হোসেন বলেন, ‘তাদের সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক সম্পর্ক আছে। তার মানে এই নয়, পাচারকারীদের আমরা সহযোগিতা দিই। আর রাজনৈতিক কারণে আবদুর রহমান বদির সঙ্গে যোগাযোগ আছে। কিন্তু মানবপাচার বিষয়ে তিনি (বদি) কিছুই জানেন না।’
তালিকার ২০৯ নম্বরে আছেন শাহপরীর দ্বীপের মোহাম্মদ ইসমাইল। ২১০ নম্বরে আছেন শাহপরীরের দ্বীপের বাজারপাড়ার ফিরোজ আহম্মদ। উভয়েই আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতা হিসেবে পরিচিত।
উখিয়ার আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে পরিচিত রেবি আক্তার ওরফে রেবি ম্যাডাম তালিকার ১৬৪ নম্বরে এবং তার স্বামী নূরুল কবির তালিকার ১৬২ নম্বরে আছেন। রেবি গ্রেপ্তারের পর জামিন পেয়েছেন। যুবলীগের নেতা মাহমুদুল করিম ওরফে মাদু আছেন তালিকার ১৬৮ নম্বরে।
বিএনপির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে তালিকায় রয়েছেন— রুস্তম আলী প্রকাশ রুস্তম মাঝি (১৬৫), বেলাল ওরফে লাল বেলাল (১৭১), মফিজুর রহমান মফিজ (১৬৯), মোহাম্মদ সৈয়দ আলম (১৭৩), নূরুল আবছার (১৬৭), মফিজ ওরফে মালয়েশিয়া মফিজ (১৭৪), জয়নাল আবেদীন (১৭৫), যুবদলের নেতা আক্তার আহমদ ওরফে আক্তার (১৭২), শাহ আলম (১৭০) ও লালু মাঝি (১৬৬)। তারা বর্তমানে পলাতক।
হুন্ডি ব্যবসা সম্পর্কে জানতে চাইলে টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর নূরুল বশর বলেন, ‘আওয়ামী লীগের কিছু নেতা মানবপাচারকারী, হুন্ডি ব্যবসায়ী ও ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন, এটা অস্বীকার করা যাবে না। কারা, কাদের, কিভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে সেটা পুলিশ, কোস্টগার্ড, বিজিবি ছাড়াও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জানে। আপনি তাদের জিজ্ঞেস করুন সব জানতে পারবেন। আমি নিজের মুখে বলে বিপদে পড়তে চাই না।’
এমপি বদির আত্মীয়স্বজনের মানবপাচার ও হুন্ডি ব্যবসায়ীদের প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এসব বিষয়ে আমি বক্তব্য দেব না।’
স্থানীয়রা জানিয়েছে, আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে যারা জড়িত তারা স্থানীয় এমপি বদির সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। কিন্তু বদির নাম তালিকায় নেই। মূলত রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ার কারণে পুলিশ কৌশলে তা এড়িয়ে গেছে।তবে অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে এমপি বদির মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও ওপাশ থেকে কেউ ফোন ধরেনি।