জঙ্গিদের পরিকল্পনা ছিল বাংলাদেশ দখলের!
প্রকাশিত হয়েছে : ৮:৩৭:৫৩,অপরাহ্ন ১১ নভেম্বর ২০১৪
পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে বিস্ফোরণের পর থেকে একের পর এক জঙ্গি তৎপরতার চাঞ্চল্যকর সব তথ্য বেরিয়ে আসছে। দেশটির গোয়েন্দারা বলছেন, বিস্ফোরণে অংশ নেয়া জঙ্গিদের শীর্ষস্থানে রয়েছেন বাংলাদেশের জঙ্গিরা। তাদের দাবি, পশ্চিমবঙ্গে জামাআ’তুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) এর ‘শেষ কথা’ হচ্ছে সাজিদ, যিনি একজন বাংলাদেশি এবং অতিসম্প্রতি আটক হয়েছেন। বর্ধমানের এই জঙ্গিচক্রটি বাংলাদেশের দুনেত্রী শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়াকে হত্যার পরিকল্পনাও করেছিল। এর চেয়েও বড় লক্ষ্য রয়েছে তাদের। তারা তালেবানি ধাচের রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ দখলের পরিকল্পনা করেছিল।
বর্ধমান বিস্ফোরণে জড়িত অন্যতম জঙ্গি সাজিদ আটক হওয়ার পর এ চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে।
খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পর জঙ্গিদের ধরতে সবদিকে জাল ছড়িয়ে দেয় এনআইএ। তাদের জালে একে একে কয়েকজন জঙ্গি ধরাও পড়ে। সর্বশেষ ধরা পড়লেন বর্ধমান বিস্ফোরণে জড়িত অন্যতম জঙ্গি কাজল শেখ ওরফে আমজাদ। অব্শ্য তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেন তারা পিতা নিজেই। বাবা শুকুরের বিশ্বাস, ছেলে কাজল নির্দোষ।
তবে শুকুর শেখের এই দাবি মানতে নারাজ এনআইএ। তাদের বক্তব্য, আমদাজকে ধরতে টানা কয়েক দিন ধরে গোয়েন্দাদের একটি দল বীরভূমে পড়ে ছিল এবং শেষমেশ সোমবার দুপুরে তারা সাফল্য পায়। এনআইএ বলছে, ‘আমজাদকে আমরাই অনেক খেটেখুটে ধরেছি।’
কাজলকে জালে আটকানো বর্ধমান বিস্ফোরণের তদন্তে একটি বড় ধরনের সাফল্য। এই সাফল্যের দিনেই আটক সাজিদকে জেরা করে বিস্ফোরণের মতো তথ্য পেয়েছে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)। তাদের জেরায় বাংলাদেশের জেএমবির অন্যতম মাথা সাজিদ স্বীকার করেছেন, ইসলামিক স্টেট অফ বাংলাদেশ গঠনের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রথম ধাপে তালেবানি ধাচে রাজশাহী জেলা নিজেদের দখলে নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন তারা। সাজিদ এ-ও স্বীকার করেছেন, পশ্চিমবঙ্গের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী জেলা মালদহ, মুর্শিদাবাদ এবং নদিয়াকে দ্রুত তাদের ‘সাম্রাজ্যের’ অন্তর্ভুক্ত করতে অস্ত্র প্রশিক্ষণে আরাকানের রোহিঙ্গাদের সাহায্য নিচ্ছেন।
ভারতীয় গোয়েন্দাদের দাবি, আল কায়েদা মদদপুষ্ট ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের সঙ্গে গাঁটছড়া রয়েছে জেএমবির। এই জঙ্গিরা যে বাংলাদেশ দখলের চেষ্টা চালাচ্ছে, সে খবর আগেই জানতে জেনেছে এনআইএ। তদন্তকারীদের দাবি, দীর্ঘমেয়াদি সেই পরিকল্পনার প্রথম ধাপেই রাজশাহীকে নিজেদের দখলে নিতে বেশ কয়েক কদম এগিয়ে গিয়েছিল জেএমবি।
সাজিদকে জেরা করে পাওয়া তথ্য ইতিমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে এনআইএ। সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশে এনআইএ এর যে দল গেছে, তারা সাজিদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য সেখানে আটক জেএমবির অন্য সদস্যদের কোছ থেকে পাওয়া তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে পারবেন।
উল্লেখ্য, আজ মঙ্গলবারই দিল্লি থেকে ঢাকায় এসে পৌঁছার কথা এনআইএ’র একটি দল। আর এদিনই নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার ফরাজীবান্দা গ্রাম থেকে সাজিদের এক ভাইকে আটক করেছে বাংলাদেশের গোয়েন্দা পুলিশ। তবে পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, এরকম কোনো তথ্য তাদের জানা নেই। নারায়ণগঞ্জ পুলিশও এ ব্যাপারে অন্ধকারে রয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, সাজিদের ভাই মনা সাজিদের কর্মকাণ্ডে সায় দিতে। তবে ওয়েল্ডিং মিস্ত্রি মনার বক্তব্য, সাজিদের সঙ্গে তাদের পরবারের কারো যোগাযোগ নেই।
এদিকে, বীরভূমের কীর্ণাহারের কাজি মার্কেটের বাসিন্দা, তিরিশ বয়সী যুবক কাজলকে ধরতে পারাটা বড় সাফল্য হিসেবেই দেখছেন তদন্তকারীরা। বর্ধমানে বিস্ফোরক তৈরির কাঁচামাল সরবরাহের মূল দায়িত্বে ছিলেন কাজলই। তার বাবা শুকুর শেখ জানান, কাজল রোববার রাতেই বাড়ি ফিরেছিলেন। সোমবার সকালে তিনি পাড়ার লোকদের সঙ্গে নিয়ে তাকে নানুর থানার পুলিশের কাছে দিয়ে আসেনর। শুকুর শেখ বলছেন, তার বিশ্বাস, ছেলে নির্দোষ।
এনআইএ এর তদন্তকারীরা মনে করছেন, কাজল এ রাজ্যে জেএমবির অন্যতম ‘মাথা’। শেক্সপিয়ার সরণিতে একটি ওষুধ লেবেল প্রিন্টিং সংস্থায় কাজ করতেন কাজল। তিনিই কলকাতা থেকে জেএমবির জন্য বিস্ফোরক তৈরির কাঁচামাল কিনে পাঠাতেন বর্ধমানে। এনআইএ তার কলকাতার আখড়ায় হানা দিয়ে বিস্ফোরক তৈরির রাসায়নিক কেনার রসিদও উদ্ধার করেছে। জেএমবির হয়ে এ রাজ্যের দুটি মাদরাসায় প্রশিক্ষণের বিষয়েও যাবতীয় তথ্য ছিল কাজলের কাছে। সে কারণেই ১২ জন পলাতক জঙ্গির মধ্যে চারজনের সঙ্গে তার মাথার দামও এনআইএ ঘোষণা করেছিল ১০ লাখ টাকা।
গত ২ অক্টোবর খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণের পরই কাজল গা-ঢাকা দেন দিল্লিতে। পরে এক পুলিশ সদস্যের সঙ্গে যোগসাজশ করে তিনি উত্তরপ্রদেশের কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলের বস্তিতে লুকিয়েছিল বলে জানতে পেরেছে এনআইএ। মাত্র কয়েক দিন আগেই তিনি পশ্চিমবঙ্গে ফিরে আসেন। কিন্তু কেন ফিরলেন এরকম প্রশ্নের উত্তর খুজতে চাননি গোয়েন্দারা।
পাশাপাশি, এ দিন তদন্তকারীদের দুটি দল বর্ধমানে জেলখানা মোড়ে একটি শপিং কমপ্লেক্সে তিনটি মোবাইলের দোকান ও তালিতে জিয়াউল হকের স্কুলেও হানা দেয়। ওই দোকান তিনটি থেকে মোবাইল এবং সিম কার্ড কেনাবেচা তো বটেই, ওই এলাকাতেই ফেরার কওসর, হাবিবরা আড্ডা মারতেন বলেও জেনেছেন তদন্তকারীরা। এক দোকান-মালিকের কথাবার্তায় কিছুটা অসঙ্গতি পাওয়ায় তার ভোটার কার্ডের জেরক্স নিয়ে যান তদন্তকারীরা।
এদিনই বর্ধমানের কাঁকসা থেকে দুই মহিলাকে আটক করেছে এনআইএ। রহিমা খাতুন এবং ইউসুফা খাতুন নামে ওই দুই মহিলাকে লক্ষ্মীপূজার আগে এক মৌলবি কাঁকসার মোল্লাপাড়ার ওই বাড়িতে আনেন। সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে তারা বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করেন। রহিমা-ইউসুফার মধ্যে কোনো একজনের স্বামী খাগড়াগড়ের ওই বাড়িটিতে (যেখানে বিস্ফোরণ ঘটে) ছিলেন। কিছুদিনের মধ্যে সেই বাড়িতে স্ত্রীকে নিয়ে গিয়ে তোলার পরিকল্পনা ছিল ওই জঙ্গিদের।
বিস্ফোরণের পরই বাবুরবাগের এক বাড়ির মালিক পুলিশকে জানান, এক দম্পতি তার বাড়িটি সাত হাজার টাকায় ভাড়া নিতে চেয়ে ইতিমধ্যেই দুহাজার টাকা অগ্রিম দিয়ে গেছেন। পুলিশের মাধ্যমে খবর পেয়ে এনআইএ রহিমার সন্ধান পায়। রহিমাকে বাবুরবাগের বাড়ির মালিকের সামনে এনআইএ হাজির করালে, তিনি তাকে সনাক্ত করেন। আটকদের কাছ থেকে বেশ কিছু ভোটার কার্ড, বাংলাদেশের দোকানের রসিদ এবং বেশ কিছু বোরখার ছবি পেয়েছেন তদন্তকারীরা।