শ্রমিকেরা কাজ করছে ঝুঁকি নিয়েই
প্রকাশিত হয়েছে : ১১:২৯:০০,অপরাহ্ন ০১ মে ২০১৫
ই বছর ধরে নানা মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা সত্ত্বেও কারখানার শ্রমিকদের কাজ করতে হচ্ছে প্রাণে ঝুঁকি নিয়েই। তাজরীন ফ্যাশনসে আগুনে পুড়ে শতাধিক ও রানাপ্লাজায় এক হাজারের বেশি শ্রমিক নিহতের ঘটনার পর জাতীয় আন্তর্জাতিক পরিসরে বিষয়টি নিয়ে বেশ নাড়াচাড়া হলেও সেটা সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে থেমে গেছে। ফলে তাকে যেকোনও মুুহূর্তে যেকোনও দুর্ঘটনার আশঙ্কা নিয়েই কাজ করতে হচ্ছে। গত এক সপ্তাহের দফায়-দফায় ভূমিকম্পে কারখানা ভবনে ফাটল ধরা নিয়ে যে ভয় সৃষ্টি হয়েছে, তাতে ছাঁটাইও হতে হয়েছে অনেক শ্রমিককে। ভয়ে অফিসে অনুপস্থিত থাকায় চাকরি গেছে কাজিপাড়ার বেশকয়েকটি গার্মেন্টের শ্রমিকের। কেউ-ই ইচ্ছে করেই যাননি অফিসে, খুঁজছেন নতুন চাকরি।
আর শ্রমিক তার অধিকার বলতে কেবল মাসিক বেতনটা ঠিক মতো পাচ্ছে কি না সেটাই বিবেচনায় নিচ্ছে। ফলে মে দিবসের প্রাক্কালে বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, মে দিবস বলতে তারা বোঝে নিছক ছুটির দিন, মালিক সদয় হলে ফ্যাক্টরি বন্ধ থাকবে। আর দিনমজুররা বেশিরভাগই জানেন না, মে দিবসের ইতিহাস কিংবা মে দিবসে তাদের জন্য নেই কোনও ছুটি।
২০১৩ সালে ২৪ এপ্রিল সাভারের রানাপ্লাজা ধ্বসে ১ হাজার ১৩৫ জন নিহত হলে স্তম্ভিত হয়েছিল দেশ। ওই সময় শ্রমিকদের কাজের পরিবেশের নিরাপত্তা নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে বিশ্বব্যাপী। এর জের ধরে নিরাপত্তার কথাটি সামনে আনে যুক্তরাষ্ট্র এবং অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা (জিএসপি) স্থগিত করে। পরবর্তী সময়ে জিএসপি সুবিধা ফিরে পেতে শ্রম পরিবেশ উন্নয়নে ১৬টি শর্ত দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এসব শর্ত পূরণ করতে পারলে জিএসপি সুবিধা পুনর্বহালের বিষয়টি বিবেচনা করবে বলে আশ্বাসও দেয়।
এই পরিস্থিতিতে তৈরি পোশাকশিল্পে কারখানার কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার বিষয়ে ব্যাপক তোড়জোড় শুরু হলেও দুইবছরে পরিস্থিতি খুব বেশি পাল্টায়নি। শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত হয়নি বলে মনে করেন শ্রমিক অধিকার সংগঠনগুলো। তাদের প্রশ্ন ধরে সরেজমিনে মিরপুর এলাকার পোশাক কারখানাগুলোয় গিয়ে দেখা গেল, সেই একই কর্মপরিবেশ, সেই একইভাবে সরু সিঁড়ি, সেই একই অস্বাস্থ্যকর বিল্ডিং। যেসব কারখানা পরিদর্শন করে বন্ধ হয়েছে সেগুলোর বাইরে এখনও অনেক কারখানা আছে যেগুলোয় নেই বাইরে দিয়ে সিঁড়ির ব্যবস্থা, যেগুলোয় এই ব্যবস্থা আছে, সেগুলোর সিঁড়ির মান এতই খারাপ যে, সেটা দিয়ে একসঙ্গে শ্রমিকরা নামতে গিয়ে হয় পড়ে যাবেন, নয়তো পুরো সিঁড়ির কাঠামোটি ভেঙে যাবে।
এমনকি বাংলাদেশে তৈরি পোশাক কারখানায় শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজে অগ্রগতি না হওয়ায় সম্প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতা ফোরাম অ্যালায়েন্স। সংগঠনটি বলেছে, কারখানায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজ এখন থেমে গেছে। যদিও তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ বলেছে, বিদেশি ক্রেতারা প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অর্থ সহায়তা না দেওয়ায় কারখানায় শ্রমিকের কাজের পরিবেশ উন্নত করার কাজে সমস্যা হচ্ছে। উল্লেখ্য, ইউরোপের ক্রেতাদের ফোরাম অ্যাকোর্ড দায়িত্ব নিয়েছিল ১১শ কারখানা পরিদর্শনের। আর যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের সংগঠন অ্যালায়েন্স এর ভাগে পড়েছিলো ৬ হাজার কারখানা। এখন অ্যালায়ান্স অভিযোগ তুলেছে, তারা যে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করেছে, বেশিরভাগ কারখানায়ই নির্ধারিত সময় মধ্যে সমস্যার সমাধান করা হয়নি। কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজ থেমে গেছে ।
রানা প্লাজা ধসের পরপরই এ দুই সংগঠন বলেছিল শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও সংগঠন করার অধিকার নিশ্চিত, অগ্নি নিরাপত্তাসহ গার্মেন্টে মানসম্মত পরিবেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রতিটি কারখানা পরিদর্শনের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করা প্রয়োজন।
গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সমন্বয়ক তাসলিমা আকতার বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের উচিত সংশোধিত শ্রম আইন অবিলম্বে বাস্তবায়ন করা। অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্স যা করতে চেয়েছে, সেটা শ্রমিকের জন্য নিরাপত্ত দেবে বটে, কিন্তু সব কারখানায় তারা কাজ তো করেনি। শ্রমিকদের মতামত রাখার অধিকার নিশ্চিত করা, তাদের স্বাস্থ্য ও কর্মপরিবেশের উন্নয়নের জন্য তৎপর হতে হবে। সেটা করার আগ্রহ তাদের ভেতর দেখা যায় না।’
এদিকে গার্মেন্ট শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু বলেন, যে শ্রমিকদের ঘামে শ্রমে আপনি মালিকশ্রেণি হয়ে উঠেছেন তাদের নিরাপত্তা দেওয়ার দায় কার? তিনি বলেন, ‘কারখানাগুলো ধ্বসে পড়বে কি না, সেটা যেমন দেখা জরুরি তেমন আদৌ এসব বিল্ডিং এ কারখানা থাকা উচিত কি না, আদৌ শ্রমিকরা স্বাস্থ্যগত ও পেশাগত ঝুঁকিমুক্ত কি না সেই দিকগুলো বিবেচনায় নিতে হবে মালিকদের।’
এদিকে মে দিবস সম্পর্কে জানতে চাইলে শ্যাওড়াপাড়ার একটা গার্মেন্টের শ্রমিক রাশেদা বলেন, ‘গতবছর শিপমেন্টের জন্য এই দিন ছুটি পাইনি। তাছাড়া সববছরই মে দিবসের দিন ছুটি থাকে।’ মে দিবস কী জানতে চাইলে একই কারখানার শ্রমিক শর্মি বলেন, ‘এদিন মিছিলে মিটিংয়ে গিয়ে যারা পলিটিক্স করে, তারা কইতে পারব আপনারে। আমাদের জিগায়ে লাভ নাই। আমরা মিটিংয়ে যাই না।’