শীতের সংস্কৃতি: সংস্কৃতির শীত
প্রকাশিত হয়েছে : ৩:২৭:২৯,অপরাহ্ন ০৭ নভেম্বর ২০১৪
পাতা ঝরানোর পাশাপাশি নতুন পাতারও বিকাশ ঘটায় শীত। হেমন্তর ঘ্রাণেই বোরো মৌসুমের জন্য কৃষক তৈরি করবে বীজতলা। সেগুলো তুলে রোপণ চলবে পৌষের দিকে। মাঘ মাসে সারা দেশে তথা গ্রামবাংলার সবুজ ধান পাতা ছড়াবে তার রঙের অপূর্ব সমারোহ। আর সেই সবুজের হিল্লোলে দিশেহারা হয়ে কোনো প্রেমিক বার্তা প্রেরণ করবে তার প্রিয়তমার কাছে। তেমনি কুয়াশার আস্তরণ মাড়িয়ে শীর্তাত মাঠে কিষাণ ছুটে যাবে রাত পোহানোর আগে। গোটা শীত ঋতু ধরে মাঠের পর মাঠে দেখা যাবে রবি-শস্যের সমারোহ। ধান পাতার গন্ধ মৌ-মৌ করবে প্রান্তরের বাতাস, হরেক রকমের শাক-সবজি রঙে-রঙে ভরে উঠবে গ্রামবাংলা ও শহরের আনাচে কানাচে।
কাজী অরূপ
ছয় ঋতুর বৈচিত্র নিয়েই বাঙালির জীবনযাপন। আমরা এও জানি, জরা-খরা শেষে শীতেই সূচনা করবে বসন্তের। হিমশীতল প্রকৃতির গর্ভে অংকুরিত হবে বসন্তের ভ্রূণ। সংস্কৃতি মূলত, শীতের এই আমেজের সাথে মিশে আছে বাঙালির সংস্কৃতি ঐতিহ্যের নানান কৃষ্টি কালচার। বিশেষ করে এ দেশের গ্রামাঞ্চলে অঘ্রাণ মাসের প্রথম দিনের সাথে মিশে আছে নবান্ন উৎসব। আসলে অঘ্রাণ থেকে পৌষ মাস পর্যন্ত নবান্নের আমেজ লেগে থাকে গ্রাম বাংলায়। এ সময় গেরস্তের উঠোনে আসে নয়া ধান। সোঁদা গন্ধে মৌ-মৌ করে আঙিনা। এ সময় ঢেঁকির শব্দে টের পাওয়া যায় নবান্ন এসেছে। সেদিন খেয়েছে কাকে। বস্তুত, একালে নবান্ন শুরু আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। নবান্ন উৎসবের সেই চির-চিরায়িত অহংকার হারিয়ে ফেলেছে কবেই? কারণ জীবন থেকে স্বস্তি কমেছে। বেগ এসে কেড়ে নিয়েছে আবেগ, আনন্দ পড়েছে ঝিমিয়ে। অভাব-অনটন, অভিযোগ ভয় বিবাদ নিয়ে জর্জড়িত নবান্নের জন্য খ্যাত বাংলাদেশ। টানাপোড়ন বেড়েছে ছায়ার মতোন। কাজেই নবান্ন উৎসব এখন স্রেফ বিলাসিতা। এখন আগের মতো মেলা-খেলা জমে না, শীতের সন্ধ্যায় বসে না শিরণীর আসর, গ্রামসুদ্ধ লোক ডেকে খাওয়ায় না কেউ। সেই গ্রাম নেই, নেই ‘গাওয়ালী’ উৎসব। এখন গেরস্তের উঠোনে নয়া ধান তোলার সাজ-সাজ কলরব নেই। তবু অঘ্রাণের শেষে গেরস্তের ঘরের চৌকাঠে আজো ঝুলতে দেখা যায় গোছা-গোছা ধানের শীষ। যেনো ঝুলে আছে আগামী দিনের স্বপ্ন। আজকাল অবশ্য শহরে নবান্ন উৎসব হয়। তা বহুলাংশে কৃত্রিম হলেও ঐতিহ্যের স্মারক বটে। গ্রামবাংলা এ সময় শীতসন্ধ্যায় কেচ্ছা বলার ধুম পড়তো। জারি, সারি বাউল, হাছনরাজার গানের আসর বসতো পাড়ায়-পাড়ায়। পাঠের সুর হিমেল বাতাসে ছড়িয়ে পড়তো গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। পৌষের জ্যোস্নায় উঠোনে উঠোনে বসতো ‘বিষাদ সিন্ধুর’ পাঠের আসর, রাতভর মারফতি, মুর্শিদী গানের সেই শীত তাড়ানো আনন্দ এখন মস্নান। এখন আর শীতের মধ্যরাতে কবিয়ালদের ঢাক-ঢোলক ছন্দে মুখর হয় না। এক সময় উত্তর বাংলার গম্ভীরা গান ছিলো শীত ঋতুর প্রধান বিষয়। পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তা হারিয়ে যাওয়ার পথে। গ্রামবাংলা শীত সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান বিষয় ‘যাত্রাপালা’ এবং ‘নাটক।’ শীতের শুরু থেকে সাড়ম্বরে চলতো আয়োজন। পাড়ায় পাড়ায় জমে উঠতো যাত্রা-নাটকের রিহার্সেল। লোকে লোকারণ্য হতো ছামিয়ানা টাঙানো প্যান্ডেল। খড়ের বিছানায় বসে রাতভর যাত্রা দেখতো দর্শকরা। আজকাল যাত্রাপালা নেই বললেই চলে। কিছুটা শহুরে আদলে নাটক মঞ্চস্থ হয়। কিন্তু কোথায় যেন কমতি থেকেই যায়। শিল্পী আছে, সঙ্গীত আছে, শ্রেতাও আছে কিন্তু সেই স্বত:স্ফুর্ততার স্রোতে আজ শুধু ভাটার টান। শহরে শীত সংস্কৃতির তাৎপর্য ভিন্ন। এখন হারিয়ে গেছে অনেক কিছুই। শীতের রাতে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আসর আজকাল বিরল। ক্লাসিক গানের জলসা তেমন জমে না। নানা কারণে মানুষের রুচি বদলেছে। এখন লোকের পছন্দ ব্যান্ড সঙ্গীত। এসব আসরে বেশি পয়সায় টিকেট কেটে আধুনিক দর্শকরা উপভোগ করে বিদেশী শিল্পীদের গান। শীতকালে প্রাচীন সংস্কৃতি ‘যাত্রাপালা’ এখন শুধু স্মৃতি। তবে আগের সেই স্বাতন্ত্র্য নেই, নেই সারল্য। সত্তর আশির দশকে যাত্রার মূল আকর্ষণ ছিলো ‘প্রিন্সেসদে’র মুদ্রাশূন্য নাচ। এ ধরণের শীত-যাত্রা’ বাস্তবিকই সংস্কৃতিকে শীতার্ত করে তুলতো। সেই তান্ডব নৃত্যের প্রকোপ কমেছে। ‘প্রিন্সেস’রা চেহারা বদলে জায়গা করে নিয়েছে পাঁচতারা ‘জংগল নাইট’ জাতীয় জলসায়। তাতে আর যাই থাক, চিরায়ত বাঙালীর সংস্কৃতির উপাদান নেই।
শীতঋতু কেন্দ্রিক এই বার্তা যেনো বাঙালি সংস্কৃতির ক্রমবিবর্তনের চেহারা তথা মিশ্রণের স্বরূপ। আন্দোলনমূখী রাজনীতিও এক অর্থে ‘ক্যাটওয়াক।’ রাজনৈতিক কর্মকান্ড, আন্দোলন, মিছিল-মিটিং, সম্মেলন সাধারণত শীতকালে জমে ওঠে। আমাদের সাফল্যমন্ডিত রাজনৈতিক অর্জনের অতীত ইতিহাসে শীতকাল বেশ ভূমিকা রেখেছে। বার-বার আমরা যেনো শীতকে তুচ্ছ করে মাথা উচু করে দাঁড়িয়েছি প্রবল উত্তাপে। মূলত, শীতকাল হচ্ছে সংস্কৃতি চর্চার মৌসুম। দৃশ্যপট, শীতের সকাল ও সন্ধ্যা
শীতের সকালে পিঠ পেতে রোদ পোহানোর দৃশ্য এখন আলোচিত। শুধু গ্রামের উঠোনেই নয়, শহরের ব্যালকনিতে পড়া শীত সকালের রোদ গায়ে মাখতে কে না চায়? গ্রাম অঞ্চলের শীতের সকাল-সন্ধ্যায় খড় জড়ো করে আগুন পোহানোর দৃশ্য আজ অমলিন। বুড়োরা আজো পোহায় ‘আইলসার আগুন।’ পাশাপাশি ছেলে-মেয়েদের দেখা যায় শীতের সন্ধ্যা-সকালে কুড়ানো খড়-কাগজ জ্বেলে গা ছেকতে। এসব করুণ আলেখ্য নিয়ে প্রতিবার আসে শীত। শীতের একটি বৈশিষ্ট্য শিশিরের সৌন্দর্যও প্রশ্নাতীত। যদি তা লেগে থাকে গাছের পাতায়, দূর্বার ডগায়, গোলাপের পাপড়ি, পাথর কিংবা ঘরের কার্নিশে। ‘রবি ঠাকুর’ কি সাধে বলেছিলে,… ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ ঘর হতে দুপা ফেলিয়া/ একটি ধানের শীষের ওপর একটি শিশির বিন্দু।’ এ এক ভিন্ন জাতের অনির্বচনীয় সৌন্দর্য। শিশির সিক্ত ভোরের শেফালী তো বটেই, টিনের চালায় শীতার্ত রাতে শিশিরের টুপটাপ শব্দ শোনার মতো শ্রোতাও আছেন। সেই শিশির পড়ার শব্দ শুনতে পেতেন ‘কবি জীবনানন্দ দাস।’ কিন্তু কবি গ্রাম্য রাখালের শিশির ধোয়া পায়ের সৌন্দর্যের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা নিছকই কল্পনা। শীতের শিশির যাদের মাড়াতে হয় তারা প্রকৃতই শীতার্ত, অর্থাৎ শীতে আক্রান্ত শিশিরের শোভা তাদের কষ্টকল্প জীবনে কোনো অবদান সৃষ্টি করে না।
শীতের প্রকৃতি: প্রকৃতির শীত
আমাদের মাতৃভূমির প্রকৃতি যেনো ছয় ঋতুর এক মহাকাব্য। প্রত্যেক ঋতুর স্বাতন্ত্র্যে সমুজ্জ্বল, তা সহজেই অাঁচ করা যায় শীত এলে। এ সময় বদলে যায় নিসর্গ, পাল্টে যায় জীবন যাত্রার মানচিত্র। শীতকালে ফিকে হয়ে আসে এদেশের একহারা সবুজ। হেমন্তের শেষ দিক হতে পাতা ঝরার পালা। অনেক গাছ এ সময় পত্র-পল্লব হারিয়ে ন্যাড়া হয়ে যায়। এরা শীতার্ত সময়ের রাজসাক্ষী। পাতাহীন কিছু গাছকে দেখে মনে হবে যেনো প্রকৃতির প্রত্নসামগ্রী। আসলে শরীর তাপ এবং আর্দ্রতা রক্ষার জন্য শীতের হিমেল ছোঁয়ায় গাছ পাতা ঝরায়। শীত বিকেল সেই ঝরা পাতা কুড়িয়ে ঘরে ফিরে পাতা কুড়ানো মেয়েরা। তারা শীত থেকে বাঁচার জন্য জ্বালানি কুড়োয়। এদের নিয়ে কবিরা আবার কাব্য রচনা করে থাকেন।
পাতা ঝরানোর পাশাপাশি নতুন পাতারও বিকাশ ঘটায় শীত। হেমন্তর ঘ্রাণেই বোরো মৌসুমের জন্য কৃষক তৈরী করবে বীজতলা। সেগুলো তুলে রোপণ চলবে পৌষের দিকে। মাঘ মাসে সারা দেশে তথা গ্রামবাংলার সবুজ ধান পাতা ছড়াবে তার রঙের অপূর্ব সমারোহ। আর সেই সবুজের হিল্লোলে দিশাহারা হয়ে কোনো প্রেমিক বার্তা প্রেরণ করবে তার প্রিয়তমার কাছে। তেমনি কুয়াশার আস্তরণ মাড়িয়ে শীর্তাত মাঠে কিষাণ ছুটে যাবে রাত পোহানোর আগে। গোটা শীত ঋতু ধরে মাঠের পর মাঠে দেখা যাবে রবি-শস্যের সমারোহ। ধান পাতার গন্ধ মৌ-মৌ করবে প্রান্তরের বাতাস, হরেক রকমের শাক-সবজি রঙে-রঙে ভরে উঠবে গ্রামবাংলা ও শহরের আনাচে কানাচে।
শীতকাল ফুলের মৌসুমে। বিশেষ করে মৌসুমী ফুলের। এখন গোলাপের শীতে যোগ হবে বাড়তি লাবণ্য। সুরভী ছড়িয়ে ভোররাতে ফুটেই ঝরে পড়বে হলদেমুখো সাদা শেফালী। নানা রকম মৌসুমী ফুলের রঙে ফুটে উঠবে নগরীর পার্ক ও বাগিচা। ফুটবে ঝাঁকে ঝাঁকে সোনার রং গাদা, ডালিয়া, বহুবর্ণা চন্দ্রমলি্লকা। শীত বিদায় নেবার প্রাক্কালে বসন্তকে বরণ করার অর্ঘ্যদানী তৈরী করে যাবে। শোভাও সৌরভ একঘেয়ে জীবন থেকে মানুষকে দেবে কমবেশী স্বস্তির খোঁজ। এক সময় ছিলো শহরের মানুষ শীতের বিকালে পার্কে যেতো আনন্দ-অবসর কাটাতে। গোলাপ, রজনীগন্ধা কিংবা গন্ধরাজের ঝোঁপের আড়ালে চলতো তরুণ তরুণীর গুঞ্জন। এখনো সে সব আছে। তবে ক্রমশ: বিষন্ন-বিপন্ন হয়ে উঠেছে পার্কের বিকেল। ফুল বনেও বেড়ে গেছে এক শ্রেণীর সুযোগ-সন্ধানী ভ্রমণের অশ্লীলতা। যার কারণে স্তিমিত হয়ে গেছে ফুলের সেই সি্নগ্ধ সুবাস। ফলে বিনোদন পিয়াসীদের কাছে শীত বিকেলের সেই আকর্ষণ আর নেন। যার ফলশ্রুতিতে বাগিচার সানি্নধ্য মানুষকে আর আগের মতো টানেনা। নাগরিক জীবনে এটাও এক বাড়তি বিড়ম্বনা। শীত প্রকৃতির আরেক বৈশিষ্ট্য হলো, কাঁচা হলুদের ফুলে ছাওয়া সর্ষের ক্ষেত। সারা দেশে বিশেষত: গ্রামবাংলা অবারিত হলুদ প্রান্তর চোখ জুড়াবে পৌষ থেকে মাঘ মাস নাগাদ। দেখে মনে হবে খেয়ালী চিত্র শিল্পীর রঙের পাত্র উপুড় হয়ে পড়েছে মাটির ক্যানভাসে। ফাঁকে ফাঁকে মটরশুটির খন্ড-খন্ড সবুজ অথবা শাকসবজির শ্যামলতা। বস্তুত, পুষ্পশোভিত শীত বদলে দেয় ‘পল্লী কবি জসীমউদ্দিনের নক্সিকাথার মাঠ’ -এর দিগন্ত। আর সেই সাথে বিষন্নতাকে হালকা করে দেয় অনেকটা। নির্সগে এনে দেয় আরো এক ভিন্ন মাত্রা।
শীতের রসনাতৃপ্ত খাবার
প্রথমে আসে পিঠা-পুলির কথা। বাঙালির শখের খাদ্য তালিকায় পিঠা পুলির কিংবদন্তি। শুধু স্বাদে নয়, এগুলো সংস্কৃতিরও ধারক। পিঠার খাঁজে খাঁজে ফুলে ওঠে নিবিড় শিল্প নৈপুণ্য নামেরও বাহার বটে!
পাটিসাপটা, দুধকলি, ভাজাকলি, নারিকেলী, ভাপা, চিতই নকশীপিঠা ইত্যাদি। শীতের দুধে ভেজানো পিঠা কার রসনাকে উসকে না দেয়? এক সময় পিঠা ছিলো গ্রামবাংলার ঐতিহ্য কালের বিবর্তনের সাথে সাথে এখন তা শহরের বিলাস খাদ্যে নাম লিখিয়েছে। ফুটপাত থেকে নামিদামী খাদ্যভান্ডার এখন দেখা যায় পিঠার বিশেষ মেন্যু, বিশেষত: শীতকালে। এক সময় পিঠার পাশাপাশি মোয়া, মুড়কি, লাড্ডু, বরফি ছিলো প্রায় অনিবার্য পদ। তবে বাঙালির খাদ্য রুচিতে বাস্তবিকই একটি স্বাতন্ত্ররূপ দিয়েছে শীতকালের খেজুরের রস। সন্ধ্যা কিংবা ভোরবেলায় টলটলে খেজুরের রস পানের ঐতিহ্য এদেশে প্রাচীন, তা থেকে ঘন করে জ্বাল দেয়া চৌরস দিয়ে শীতের সকালে মুড়ি খাওয়া গ্রামবাংলার চেনা দৃশ্য। আরেক বস্তু খেজুরের পাটালি। কে না জানে যশোরের নলের গুড়ের নাম? শীতের খাবার নিয়ে কথা না বলাই ভালো সেতো ইতিহাস! শীতে জমে থাকা মাছের ঝোল, মাষকালাইয়ের ডাল আর কড়কড়ে ভাতের স্বাদ গ্রাম বাংলার জনপ্রিয়। ভূরি ভোজনের এ ঋতুতে হরেক রকম তরতাজা সবজি শীতের খাবার-দাবারে স্বভাবতই যোগ করে ভিন্ন স্বাদ। এ যেনো বাঙালির প্রাচীন পার্বণ, অবশ্যই শীতের পার্বণ।
লেখক: সাংবাদিক-প্রাবন্ধিক
০১৭২৯-৪৪৭৮৭২