যাত্রায় পহেলা বৈশাখ
প্রকাশিত হয়েছে : ১:১৮:১৮,অপরাহ্ন ১৩ এপ্রিল ২০১৫
মিলন কান্তি দে
‘হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ
ধূলায় ধূসর রুক্ষ্ম উড্ডীন পিঙ্গল জটাজাল
তপ:ক্লিষ্ট তপ্ততনু মুখে তুলি বিষাণ ভয়াল
কারে দাও ডাক
হে রুদ্র বৈশাখ…’
বাঙালি সংস্কৃতিতে বাংলা নববর্ষের এই আবাহন এবং এর ঐতিহ্যমণ্ডিত ধারা যে আজও বহমান, তার একটি অন্যতম প্রধান কারণ, জাতি-ধর্ম ও দলমত নির্বিশেষে সবাই পহেলা বৈশাখকে সানন্দে অন্তরের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ সর্বজনীন চিরায়ত আবেদন এক স্বাতন্ত্র্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে পহেলা বৈশাখকে। যাত্রাপালার বিবর্তনেও দেখি এই বিশেষ দিবসকে ঘিরে নানা আনুষ্ঠানিকতা, নানা আয়োজন। গ্রামীণ খেলাধুলা, বিশেষ খাবার-দাবারের আয়োজন, ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির আসর-এসব আনন্দ-উৎসবের সঙ্গে বাঙালির বর্ষবরণে একটু ভিন্নমাত্রা যুক্ত করেছে যাত্রার ঐকতান বাদন। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে যাত্রার যে বিচিত্র রূপায়ণ আমরা দেখেছি এক সময়, সেখানে দেবতাদের মাহাত্ম্য বর্ণনার পাশাপাশি রাজা-বাদশাদের বীরত্বগাথা, দেশপ্রেম এবং গণমানুষের দ্রোহী চেতনার শাণিত সংলাপ আন্দোলিত করে মধ্য রাতের যাত্রার দর্শককে।
ঐতিহ্যগতভাবে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের মধ্য দিয়ে প্রত্যেক যাত্রাদলের অবশ্য পালনীয় কিছু নীতি নিয়ম তৈরি হয়ে গিয়েছিল এক সময়। এই দিনের অনুষ্ঠানের ছক সাজানো হতো এভাবে: কীর্তন ও ভক্তিমূলক গানের আসর, নাট-দেবতার স্তুতি, আরতি প্রতিযোগিতা, শিল্পীদের মিষ্টিমুখ করানো এবং প্রত্যেককে নগদ অর্থ প্রদান। এসব আনুষ্ঠানিকতা হতো যাত্রাদল অধিকারীর পক্ষ থেকে। প্রচলিত রীতি অনুযায়ী যাত্রা মৌসুম শেষ হয়ে যায় ৩০ চৈত্র। পরদিন পহেলা বৈশাখ থেকে নতুন মৌসুম শুরুর কল্যাণ কামনায় নানা ধরনের ধর্মীয় ক্রিয়াকর্ম চলতে থাকে। আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রার নতুন মৌসুমের ঘণ্টা পড়ে শারদীয় দুর্গাপূজার সপ্তমীর দিনে। সূর্য ওঠার আগে যাত্রাদলে পহেলা বৈশাখ শুরু হয় সমবেত কণ্ঠে ভক্তিমূলক ও দেশাত্মবোধক গানের মধ্য দিয়ে সূর্যাস্তের পর বসে বৈশাখ নিয়ে গল্পের আসর। তারপর রাতভর চলে ‘হই হই কাণ্ড রই রই ব্যাপার’-যাত্রাপালার বাদ্য বাজনা।
পাকিস্তান আমলে পেশাদার যাত্রাদল ছিল ২৬টি। প্রত্যেক দলেই ঘটা করে ‘পহেলা বৈশাখ’ পালন করা হতো। বিশেষ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জয়দুর্গা অপেরা, ভোলানাথ অপেরা ভাগ্যলক্ষ্মী অপেরা, চট্টগ্রামের বাবুল অপেরা এবং সিরাজগঞ্জের বাসন্তী অপেরার উৎসব অনুষ্ঠানাদি হতো খুব জাঁকজমক সহকারে। স্বাধীনতার পর ১৯৯০ সালে পর্যন্ত বৈশাখ উৎসবের ঐতিহ্য ধরে রেখেছিল মানিকগঞ্জের নিউ গণেশ অপেরা, চারণিক নাট্য গোষ্ঠী, গোপালগঞ্জের দিপালী অপেরা, ময়মনসিংহের সবুজ অপেরা, যশোরের তুষার অপেরা এবং এই শ্রেণীর আরও কয়েকটি দল।
বিগত শতাব্দীর ৫০ ও ৬০-এর দশকে পহেলা বৈশাখে এবং বৈশাখ মাস জুড়ে যে পালাগুলো মঞ্চস্থ হতো, তার তালিকা এরকম: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জয়দুর্গা অপেরার ‘বাগদত্ত’, সিরাজগঞ্জের বাসন্তী অপেরার ‘সোহরাব-রুস্তম’, ময়মনসিংহের নবরঞ্জন অপেরার ‘বাঙালি।’ এগুলো ছিল যুদ্ধবিরোধী ও গণজাগরণমূলক পালা। এর বাইরে ধর্মীয় ও ভক্তিমূলক পালাও মঞ্চস্থ হতো। যেমন- বাবা ‘তারকনাথ’, ‘সাধক রামপ্রসাদ’ ও এজিদ বধ।’ বিষাদ সিন্ধু অবলম্বনে এজিদ বধ পালা মঞ্জে এনেছিল বরিশালের মুসলিম যাত্রা পার্টি। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় চট্টগ্রামের বাবুল অপেরার একটি বিপ্লবী পালা গোটা দেশে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। পালার নাম ‘একটি পয়সা’। পালাটি ১৩৭৬ বাংলা সনের পহেলা বৈশাখে চট্টগ্রামের পটিয়া ক্লাবে পরিবেশিত হয়েছিল। এর একটি সংলাপ: ‘পুঁজিপতি ভগবানদের কাছে আর কোনো আবেদন নয়, প্রার্থনা নয়, মেহনতী মানুষের সঙ্ঘশক্তির প্রচণ্ড আঘাতে ওদের খুশির অট্টালিকা ভেঙে চুরে কায়েম করতে হবে আমজনতার ন্যায্য অধিকার।’ রাজনৈতিক সংকীর্ণতা, দলাদলি আর জাত্যাভিমানের বাইরে এদেশের একমাত্র পহেলা বৈশাখই সর্বজনীন উৎসবের রূপ পরিগ্রহ করেছে। এই সাম্য-সম্প্রীতির ঐকতানে আমরা শুনি যাত্রাপালায়ও। নবাব সিরাজউদ্দৌলা চরিত্রের অভিনেতা পহেলা বৈশাখের যাত্রামঞ্জে দাঁড়িয়ে যখন বলেন, ‘বাংলা শুধু হিন্দুর নয়, মুসলমানদের নয়। মিলিত হিন্দু-মুসলমানের মাতৃভূমি গুলবাগ এই বাংলা,’ তখন বিভিন্ন শ্রেণী গোত্রের দর্শক নিমিষে যেন একাত্ম হয়ে যায়।
চন্দ্রশেখর যাত্রাপালায় সাম্য-সম্প্রীতির এমন এক সংলাপ দেওয়া হয়েছে, যার সম্মোহনী শক্তি চিরকালের। সেই যাত্রার কাহিনীতে নবাব মীর কাশেমকে নায়ক প্রতাপ বলছেন: ‘জাঁহাপনা, এই সেই দেশ, যেখানে মুসলমানদের মসজিদের পাশে দাঁড়িয়ে আছে হিন্দুর দেব-মন্দির। যেখানে হিন্দুর সন্ধ্যারতির সঙ্গে মুসলমানের আজান ধ্বনি একই সঙ্গে বাতাসে ভেসে ওঠে।’ স্বাধীনতার আগে ‘চন্দ্রশেখর’ পালাটি প্রায় মঞ্চস্থ হতো বিভিন্ন স্কুল-কলেজের বৈশাখ অনুষ্ঠানে।
যাত্রায় এখন আগের মতো পহেলা বৈশাখ পালিত না হওয়ার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে, হালে এমন এক শ্রেণীর দল গজিয়ে উঠছে, যেখানে অভিনয় বলতে কিছু নেই। অশ্লীল নাচগান দিয়েই রাত শেষ করে দেয়া হয়। এই অশিক্ষিত দল মালিকরা ঐতিহ্য বোঝে না, পহেলা বৈশাখ, মুক্তিযুদ্ধ, একুশে ফেব্রুয়ারির ধার ধারে না। তারা জানে শুধু দম-দমা-দম-দম। এ ধরনের দলগুলো গোটা যাত্রাশিল্পকে কলুষিত করছে। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী রথযাত্রা উৎসব, দোল উৎসব, চৈত্র সংক্রান্তি, পহেলা বৈশাখ ও কারবালার কাহিনী নিয়ে ইমাম যাত্রার উপাখ্যানগুলো। যাত্রার সুদিন আজ বিগত। পহেলা বৈশাখের মতো সর্বজনীন উৎসব, নিকট অতীতেও যা ছিল ব্যয়বহুল, বর্ণাঢ্য আয়োজন-এখন তা স্মৃতিমাত্র।
পহেলা বৈশাখে নগর সংস্কৃতিতে ‘একদিনের বাঙালি’ সাজার কতই-না আয়োজন-আপ্যায়ন! কিন্তু যাত্রা সেখানে উপেক্ষিত। কালেভদ্রে দু’-একটি যাত্রানুষ্ঠান চোখে পড়ে- এই যা। চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে উপলক্ষে যে বিশাল মেলা বসে, যেখানে এক সময় যাত্রা হতো। এখন হয় না। ঢাকায় সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার (সিএটি) এবং বেঙ্গল ফাউন্ডেশন একবার তাদের উৎসব আয়োজনে যাত্রা নিয়ে এসেছিলো। তবে এসব উদ্যোগ আয়োজনের কোন ধারাবাহিকতা ছিল না। এক্ষেত্রে গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করতে হয় চারুকলা ইন্সটিটিউটের কথা।
প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে চারুকলা ইন্সটিটিউটের মঙ্গল শোভাযাত্রা যেমন এক ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে, তেমনি পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে চারুকলার শিক্ষার্থীদের প্রায় দুই দশকব্যাপী নিয়মিত যাত্রামঞ্চায়ন নগর সংস্কৃতির সৃষ্টি করেছে এক নতুন আবহ। ১৪০০ বাংলা সনের পহেলা বৈশাখে চারুকলায় এই আয়োজনের সূচনায় ছিলেন ফয়েজ আহমদ, নিতুন কুণ্ডু, কামাল লোহানী, রফিকুন্নবী প্রমুখ গুণীব্যক্তিত্বরা। সবশেষে যে কথাটি না বললেই নয়, বাংলা নববর্ষকে ঘিরে বাঙালির একান্ত নিজস্ব সংস্কৃতি যাত্রার বিকাশ ঘটেলি ভিন্ন ভিন্ন রূপে। সেই রূপায়ণকে তুলে ধরতে হবে সমকালীন সমাজ জীবনে। এজন্যে প্রয়োজন সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগ। জাতীয় পর্যায়ের এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের বৈশাখ অনুষ্ঠনে এবং বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে যদি নিয়মিত ‘যাত্রা’ রাখা হয়, পেশাদার দলগুলোকে যদি মুক্ত পরিবেশে যাত্রানুষ্ঠানের সুযোগ দেয়া হয়, তাহলেই আমরা ফিরে পাব আমাদের হারানো ঐতিহ্য। যাত্রার ঐকতানে আবার আগের মতই বাজবে- ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।’
লেখক: যাত্রা গবেষক, যাত্রা নট এবং সংগঠক