যশোরের কয়েক হাজার যুবক মানবপাচারের শিকার!
প্রকাশিত হয়েছে : ২:৫৩:০০,অপরাহ্ন ৩১ মে ২০১৫
নিউজ ডেস্ক::
‘সালাম দালাল আমার স্বামীরে মাইরে নদীতে (সাগরে) ভাসায়ে দেছে। কাউরে কিছু না কয়ে ওই দালালের সঙ্গে গিইলো। আমরা তার কোনও খবর জানিনে। পরদিন শুনলাম, আমাগের পাড়াত্তে আরও একজন গেছে। সেইই মুবাইল ফোনে আমার স্বামীর মরার খবর দিইলো। আমার দুডো মেয়ে নিয়ে আমি এখন কী করবো?’- এটুকু বলেই হু হু করে কেঁদে ফেললেন যশোরের মণিরামপুর উপজেলার রাজগঞ্জ চন্ডিপুর গ্রামের মাহবুবুর রহমানের স্ত্রী রিক্তা খাতুন।
সংসারে স্বচ্ছলতা আনতে ১৭ মাস আগে দালালের হাত ধরে বাড়ি ছেড়েছিলেন তার স্বামী। বড় মেয়ে নছিরন খাতুন চন্ডিপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। ছোট মেয়ের বয়স তিন বছর। হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান নছিরন নিশ্চিত হয়ে গেছে তার আর পড়াশোনা হচ্ছে না।
নছিরন জানায়, যাওয়ার আগে আব্বু ছোট বোনের হাতে পাঁচ টাকার একটা নোট দিয়েছিলেন। দাদিকে আব্বু খুব ভালোবাসতেন। বললে হয়তো যেতে দেবেন না, তাই একদিন তিনি যখন নামাজ পড়তে শুরু করেন, তখন আব্বু শুধু বললেন ‘মা গেলাম।’
দাদি নামাজ শেষ করেই পেছন পেছন দৌঁড়েছিলেন, কিন্তু ধরতে পারেননি আর।
স্থানীয়রা জানায়, মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে একই পাড়ার মোজাফফর গিয়েছিল। সেই মোবাইলফোনে মাহবুবুরের মৃত্যুর খবর জানায়। নৌকায় খাবার নিয়ে মারামারির এক পর্যায়ে দালালরা তাকে হত্যা করে পেট কেটে সাগরে ভাসিয়ে দেয়।
একই দালালের হাতে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে সাগরে ভেসেছিলেন রাজগঞ্জ কলেজপাড়ার তপন গাজী। ১৭ মাস ধরে তার কোনও খোঁজ নেই। ছয় ও চার বছরের দুটি ছেলে নিয়ে চেয়ে-চিন্তে সংসার চালাচ্ছেন তার স্ত্রী সালমা বেগম। তিনি বলেন, ‘কার সাথে কীভাবে কোথায় গেছে, আমরা কিছুই জানি না। দু’ছেলেকে আমি এখন কীভাবে মানুষ করবো?’
একই উপজেলার চাকলা গ্রামের শুধু কিসমত চাকলাপাড়া থেকেই গেছে আট যুবক। তাদেরই একজন সুমন দফাদার (৩০)। পরের জমিতে শ্রম দিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করতেন। তিনিও নিখোঁজ ১৭ মাস ধরে। তার স্ত্রী মিরা খাতুন বলেন, ‘লোকজনের মুখে শুনেছি, কেশবপুর উপজেলার ভালুকঘর গ্রামের রহমান দালাল আমার স্বামীরে পানিপথে মালয়েশিয়া নিয়ে গেছে। দেড় বছরেরও বেশি সময় তার কোনও খোঁজ পাচ্ছি না। আমার পাঁচ বছর বয়সের দুটো জমজ ছেলে আছে।’
সুমনের সঙ্গে একই গ্রামের ফারুক হোসেনও গিয়েছিলেন। তারও কোনও হদিস নেই। তার দু’ছেলের একজন ক্লাস সেভেনে, অন্যজন ফাইভে পড়ে। ফারুকের স্ত্রী মহিনারা বেগম বলেন, ‘বিদেশে পাঠানোর জন্য দালাল ৫০ হাজার টাকা নিছে। স্বামীর কোনও খোঁজ নাই। ছেলে দুটোর লেখাপড়া বন্ধ।’
রাজগঞ্জ মোবারকপুরের মুক্তিযোদ্ধা মেহের আলীর ছোট ছেলে পীর আলী বক্স নিখোঁজ ১৭ মাস ধরে। ছেলের জন্য ঢাকা-যশোরের বিভিন্ন দফতরে ঘুরে ঘুরে এখন তিনি ক্লান্ত। সারাদিন মাটির ঘরের বারান্দায় বসে ফেল ফেল করে তাকিয়ে থাকেন পথের দিকে।
মণিরামপুর উপজেলার রাজগঞ্জ এলাকার পাড়ায় পাড়ায় এরকম অসংখ্য পরিবারের খোঁজ মিলছে এখন। সবচেয়ে ভয়াবহ তথ্য দিলেন স্থানীয় সাংবাদিক রাজগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক জিএম বাবু। তিনি বলেন, ‘ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি -রাজগঞ্জ এলাকা থেকে অন্তত চার হাজার যুবক দালালের হাত ধরে বাড়ি ছেড়েছে। যার মধ্যে আড়াই হাজার যুবক এখনও নিখোঁজ। সহস্রাধিক যুবক মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের বিভিন্ন কারাগারে রয়েছে। অল্পকিছু যুবক মালয়েশিয়া পৌঁছাতে পারলেও তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছে।’
এ অঞ্চল থেকে এত বেশি সংখ্যক মানুষ কেন দালালদের মাধ্যমে অনিশ্চিত গন্তব্যে পাড়ি জমালো-এ বিষয়ে তিনি (জিএম বাবু) বলেন, ’মণিরামপুরের পশ্চিম অংশের সাতটি ইউনিয়নে ৭০ ভাগেরও বেশি মানুষ খুবই দরিদ্র। এদের সবাই পরের জমিতে জন (শ্রম) দিয়ে, ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালিয়ে বহু কষ্টে সংসার চালায়। যখন কোনও কাজ থাকে না, তখন এদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। এ কারণে খুব সহজেই তাদেরকে প্রলোভিত করা যায়। এ সুযোগটাই নেয় দালালরা।’
মানবপাচার প্রতিরোধে দীর্ঘদিন ধরে যশোর অঞ্চলে কাজ করছে রাইটস যশোর নামে একটি বেসরকারি সংস্থা। সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক বলেন, ’মণিরামপুর থেকে কয়েক শ’ মানুষ দালালের খপ্পরে পড়ে সাগরে ভেসেছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। তবে এ সংখ্যা কয়েক হাজার কিনা তা এখনই বলতে পারছি না। পাচার হওয়া মানুষদের তথ্য জানতে আমরা জেলা ও পুলিশ প্রশাসনকে অনুরোধ করেছি।’
জনবল সঙ্কটের কারণে এ মুহূর্তে তারা কাজটি করতে পারছেন না বলে জানান বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক।
তিনি আরও বলেন, বছর খানেক আগে এ বিষয়ে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম। কিন্তু তখন প্রশাসনের টনক নড়েনি।’
তিনি অভিযোগ করেন, ‘প্রশাসনের সঙ্গে দালালদের সম্পর্ক রয়েছে। সে কারণে প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয় না। এখন পাচার হওয়া মানুষদের শনাক্ত ও উদ্ধারের দায়িত্ব সরকারের।’
মণিরামপুর থানার ওসি মোল্লা খবিরউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা ২৭ জন দালালের একটি তালিকা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়েছি।’
নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকা করার কোনও নির্দেশনা পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে ওসি বলেন, ’সেরকম কোনও নির্দেশনা নেই। এর আগে পাচার সংক্রান্ত ঘটনায় মণিরামপুর থানায় কয়েকটি মামলা হয়েছে।’
এদিকে সাগরে ভাসমান বাংলাদেশিদের বিষয়টি মিডিয়ায় আসা শুরু হলে মণিরামপুরের সব দালাল এলাকা ছেড়েছে। বেশিরভাগ দালাল গত ২/৩ বছরে এলাকায় অভিজাত বাড়ি তৈরি করেছে। রাজগঞ্জ বাজারে রহমান দালালের তিনতলা বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। তার স্ত্রী বলেন, ‘আমার স্বামী আগে বিমানে করে লোক পাঠাতো, এখন পাঠায় না। এখন সে ঢাকার বিজয়নগরে গাড়ি আর মোটর পার্টসের ব্যবসা করে। তার দুইটা গাড়ি আছে।’
তিনি দাবি করেন, ‘তার স্বামী কখনওই আদম ব্যবসা করেনি।’
কিন্তু একটু আগে তো বললেন- ‘বিমানে লোক পাঠাতো …’ সাংবাদিকরা এ কথা স্মরণ করিয়ে দিলে রহমান দালালের স্ত্রী বলেন, ‘আগে ভুল বলেছি।’