বিকল্প নেতৃত্ব নিয়ে আলোচনায় বিএনপি!
প্রকাশিত হয়েছে : ১:২৩:৫৫,অপরাহ্ন ২৩ মার্চ ২০১৯
নিউজ ডেস্ক:: ঘুরে দাঁড়ানোর উপায় নিয়ে আলোচনার চেয়ে কী কারণে দল সংকটের আবর্তে পড়ে আছে সে আলোচনাই এখনো বিএনপিতে বেশি। ফলে রোডম্যাপ ছাড়াই সময় পার করছে দলটি। অন্যদিকে নির্বাচনের আগে কিছুটা সমন্বয় থাকলেও ঢাকায় বিএনপির সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমানের কাজের সমন্বয়হীনতার খবর পাওয়া গেছে। এমন পরিস্থিতিতে জিয়া পরিবারের ভেতর থেকেই নতুন নেতৃত্ব আসতে পারে কি না, তা নিয়ে নতুন করে আলোচনা ও গুঞ্জন উঠেছে।
অবশ্য তারেক রহমানের বিরুদ্ধে যায় বলে বিএনপির কোনো নেতাই এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলতে নারাজ। ব্যক্তিগত ও অনানুষ্ঠানিক আলাপচারিতায় তাঁরা জানান, তারেক সম্পর্কে কথা বলে দলে তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে চান না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘দল ঢিমেতালে চলছে এ কথা ঠিক। কিন্তু বিকল্প নেতৃত্ব সম্পর্কে বলা আমার পক্ষে কঠিন।’
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার কিছুটা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘এ উপমহাদেশে পরিবারতন্ত্রের বাইরে যে কিছু নেই এটি সহজ হিসাব। সে হিসেবে তারেক সাহেবই আছেন। জোবায়দা রহমান ইজ হাইলি ইনটেলিজেন্ট। কিন্তু তাঁর প্রয়োজন আছে কি না, সেটি সময় বলে দেবে।’
তবে বিএনপির শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে পরিচিত সুধীজনদের মধ্যেও আলোচনা শুরু হয়েছে দলে বিকল্প নেতৃত্বের সম্ভাবনা নিয়ে। জিয়া পরিবারের মধ্য থেকেই ‘বিকল্প নেতৃত্ব’ আসতে পারে কি না, সে আলোচনাও আছে। সুধীজনদের কেউ কেউ বলছেন, দলের ভেতরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকলেও বাইরে, বিশেষ করে ভারতসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তাঁর ভাবমূর্তির সংকট আছে। সে কারণে তাঁকে ‘গ্রহণযোগ্য’ করা যাচ্ছে না।
আবার দেশের ভেতরে ‘ক্ষমতার বিকল্প কেন্দ্র’ হিসেবে পরিচিত প্রতিষ্ঠানগুলোরও বেশির ভাগই তাঁর বিরুদ্ধে বলে আলোচনা আছে। অনেকের মতে, এ কারণেই বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় বিএনপি ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। অনেকে এমনও বলছেন, তারেক রহমান নেতৃত্বে থাকলে বিএনপির চাকা ঘুরবে না।
শত নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘বিএনপির বিকল্প নেতৃত্ব নিয়ে আলোচনা শুরু হওয়াটা অমূলক বা অপ্রাসঙ্গিক কিছু নয়। কারণ খালেদা জিয়ার বয়স ও অসুস্থতার পাশাপাশি তারেক রহমান দীর্ঘদিন লন্ডনে রয়েছেন। তাঁর কখন এখানে আসার সুযোগ হবে এটি নিশ্চিত নয়।’
তিনি বলেন, ‘এমন পরিস্থিতিতে মানুষ মনে করছে, জোবায়দা রহমান বা জাইমা রহমান রাজনীতিতে এলে হয়তো বিএনপি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। তাই ভবিষ্যতের হলেও এ আলোচনা বাস্তবসম্মত।’
রাজনীতি বিশ্লেষক ড. তারেক শামসুর রহমান বলেন, ‘রাইট অর রং যে কারণেই হোক তারেক রহমানকে কেন্দ্র করে একটি বিতর্ক তৈরি হয়েছে। তা ছাড়া দল ক্ষমতায় না আসতে পারলে তাঁর ফিরে আসাও কঠিন। ফলে বিএনপিকে বাঁচাতে হলে এখন জাইমা রহমানই একমাত্র ভরসা। অবশ্য যদি তারেক তাঁকে আসতে বাধা না দেন।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জিয়া পরিবারের রক্তের উত্তারিধকার প্রশ্নে জোবায়দার সম্ভাবনা এখানে কম। বরং জাইমার নেতৃত্ব বেশি কার্যকর হবে।’
এক-এগারো পরবর্তী তিনটি সাধারণ নির্বাচনের পর বিএনপির ভেতরে-বাইরে এখন একই প্রশ্ন—এভাবে ক্ষমতার বাইরে আর কত দিন প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে টিকে থাকতে পারবে বিএনপি? অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে ঘিরে সৃষ্ট রাজনৈতিক মেরুকরণের ফলেই গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বিএনপি বড় দল হিসেবে টিকে থাকতে পেরেছে।
কারণ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এখনো বড় প্ল্যাটফর্ম বিএনপি। নতুন কোনো রাজনৈতিক মেরুকরণ না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের বিপরীতে বিএনপিই টিকে থাকবে। কিন্তু তিনটি নির্বাচনে ব্যর্থতার পাশাপাশি সদ্যঃসমাপ্ত ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রসমাজের মধ্যে নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা। বড় দলের ছাত্রসংগঠন হয়েও ছাত্রদল ওই জায়গা নিতে পারেনি।
অনেক বিশ্লেষক ওই ঘটনাকে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন। তাঁদের মতে, আওয়ামী লীগ কোনো কারণে ব্যর্থ হলে বিএনপি ওই জায়গায় দাঁড়াবে, তা এখন আর নিশ্চিত নাও হতে পারে। কারণ বিএনপিতে একদিকে গতিশীল নেতৃত্বের অভাব, অন্যদিকে ভেতরে ভেতরে অনৈক্য ও নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা বাড়ছে।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের তুলনায় নেতারা দলীয় প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে বেশি তৎপর। আবার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ঢাকার সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে তারেক রহমানের সমন্বয়ের অভাব দেখা দিয়েছে। এসব বিষয় দৃশ্যমান হওয়ায় মধ্যম ও পেছনের সারির নেতাকর্মীরাও এখন প্রচণ্ড হতাশ।
এ অবস্থায় অনেকের ধারণা, বিএনপির নেতৃত্ব ঘুরে দাঁড়াতে ব্যর্থ হলে দেশে নতুন রাজনৈতিক শক্তির আবির্ভাব হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। এ ক্ষেত্রে কেউ কেউ ভারতে বিজেপি বা দিল্লিতে আম আদমি পার্টির উদাহরণ দিচ্ছেন। কেউ কেউ এখনই খালেদা জিয়ার পুত্রবধূ ডা. জোবায়দা রহমান, এমনকি তারেক রহমানের মেয়ে জাইমা রহমানের নামও নিচ্ছেন।
কিন্তু জিয়া পরিবারের অন্য কেউ বিএনপির হাল ধরুক, তারেক ও খালেদা জিয়া তা চান না বলে বিএনপিতে আলোচনা আছে। আবার লন্ডনে রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকায় তাঁদের ফিরে আসাও কঠিন। দেশে ফিরতে চাইলে ব্রিটেনে তাঁদের রাজনৈতিক আশ্রয় বাতিল হয়ে যাবে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, মূলত জামায়াত সংশ্লিষ্টতার কারণে ডাকসু নির্বাচনে বাংলাদেশ সাধারণ শিক্ষার্থী অধিকার পরিষদ ও বামপন্থী সংগঠনগুলোর সঙ্গে মিলে প্যানেল দিতে পারেনি ছাত্রদল। বিএনপির নেতাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতাও আরেকটি কারণ।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ মনে করেন, নির্বাচনের ধাক্কা সামলে রোডম্যাপ তৈরি করতে বিএনপির সময় লাগবে। তাঁর মতে, লন্ডন ও ঢাকার মধ্যে সমন্বয়হীনতা থাকলেও বিএনপি যে এখনো ঐক্যবদ্ধ আছে, এটিই বেশি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিএনপি পারবে—এমন ধারণা থেকে জনগণ সরে গেলে মুশকিল আছে। ডাকসু নির্বাচন থেকেও শিক্ষা নেওয়ার বিষয় আছে।
বিএনপির নেতা মাহবুবুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, আগামী দিনের কর্মকৌশল নিয়ে আলোচনা শুরু হলেও রোডম্যাপ তৈরি হয়নি। তারেক রহমানের সঙ্গে ঢাকার নেতাদের সমন্বয় হচ্ছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে কিছু বলতে চাই না। বৈঠকে উপস্থিত থাকি, এর বেশি কিছু জানি না।’
ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার এ প্রসঙ্গে বলেন, তারেক রহমান দলের মহাসচিবের সঙ্গে সমন্বয় করে বিএনপি চালাচ্ছেন।
দলীয় সূত্র মতে, বর্তমানে তারেক রহমান অনেকটা একাই দল চালাচ্ছেন। ফলে সিনিয়র নেতারা উদ্যোগী হয়ে কিছুই করছেন না। ফলে দলে একধরনের স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটি গঠন ছাড়াও ড্যাব, অ্যাব, কৃষক দল, মৎস্যজীবী দলসহ কয়েকটি সংগঠন একাই পুনর্গঠন করেন তারেক।
প্রায় দিনই তিনি বিভিন্ন জেলার নেতা ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে স্কাইপে মতবিনিময় করছেন। প্রথম দিকে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর উপস্থিত না থাকলেও সমালোচনার পর পরেরগুলোতে থাকছেন বলে জানা যায়।