খালেদার দিনক্ষণ মন্তব্যে দলে হতাশা: ইস্যুর অপেক্ষায় বিএনপি
প্রকাশিত হয়েছে : ৫:৪৫:১৭,অপরাহ্ন ০৯ অক্টোবর ২০১৪
শরীফুল ইসলাম: ভাল কোন ইস্যু ছাড়া আন্দোলনে যেতে পারছে না বিএনপি। তাই বিএনপি এখন ইস্যুর অপেক্ষায়। তবে ঈদের আগে আন্দোলনের কথা বলে ঈদের দিন খোদ বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া দিনক্ষণ দিয়ে আন্দোলন হয় না বলার পর দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে এখন হতাশা বিরাজ করছে। এ অবস্থা উত্তরণের কোন পথ আপাতত খুঁজে পাচ্ছে না বিএনপি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলনের হুমকি দিয়ে এলেও বাস্তবে আন্দোলন শুরু করতে পারেনি বিএনপি। কিন্তু সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর পর বিচারপতিদের অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দেয়ার পর বিএনপি হাতের নাগালে একটি ইস্যু পেয়ে যায়। এর প্রতিবাদে ২২ সেপ্টেম্বর ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করে বিএনপি। কিন্তু এ হরতাল কর্মসূচী পালন করতে বিএনপি জোটের নেতাকর্মীরাই মাঠে নামেননি। এ কারণে হরতাল ফ্লপ হয়। তাই এই হরতাল কর্মসূচী পালনের মাধ্যমে আরও আন্দোলন কর্মসূচী নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার যে পূর্বপরিকল্পনা বিএনপি হাইকমান্ডের ছিল, তা ভেস্তে যায়। এখন ভাল কোন ইস্যু ছাড়া আন্দোলনে যাওয়ার পরিকল্পনা নেই। তবে হঠাৎ কোন ভাল ইস্যু সামনে পেয়ে গেলে আবার বিএনপি হরতালসহ বিভিন্ন কর্মসূচী পালনের চিন্তাভাবনা করছে বলে জানা গেছে।
জানা যায়, সরকারবিরোধী আন্দোলনের ব্যাপারে আস্তে আস্তে অগ্রসর হওয়ার ইচ্ছে থাকলেও ২২ সেপ্টেম্বর হরতাল বিফল হওয়ার পর সে অবস্থান থেকে সরে এসেছে বিএনপি। এছাড়া জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেও বিএনপি বুঝতে পেরেছে এখনই আন্দোলনে গেলে এর সুফল অর্জন করা সম্ভব হবে না। আর সরকারও বিরোধী দলের আন্দোলন মোকাবেলায় প্রস্তুত রয়েছে। আর পুলিশসহ সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর কঠোর নজরদারি তো বিএনপির ওপর রয়েই গেছে।
২২ সেপ্টেম্বরের হরতাল ফ্লপ হওয়ার পর বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে বিএনপি হাইকমান্ডকে জানানো হয়েছে রাজধানীতে জোরালো আন্দোলনের প্রস্তুতি নিয়ে তারপর যেন আন্দোলন কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়। কারণ রাজধানীতে আন্দোলন সফল না হলে সারাদেশে আন্দোলন করে যে কোন লাভ নেই তার প্রমাণ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই পাওয়া গেছে। তাই পরবর্তী আন্দোলন কর্মসূচী পালনের ব্যাপারে তারা আগে রাজধানীর খোঁজখবর নিয়ে নিজ নিজ এলাকায় আন্দোলনে শরিক হবে। এ বিষয়টিও বিএনপি হাইকমান্ডকে ভাবিয়ে তুলেছে বলে জানা গেছে।
ঢাকা মহানগর বিএনপিতে এখন নেতৃত্বের যে অবস্থা তাতে রাজধানীতে আন্দোলন কর্মসূচী সফল করা এত সহজ হবে না। একদিকে দলের ত্যাগী নেতা ও স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের নেতৃত্বে ঢাকা মহানগর বিএনপির নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠনের পর দলের ভাইস চেয়ারম্যান ও মহানগরের সাবেক আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকা সমর্থক নেতাকর্মীরা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন, অপরদিকে মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের সঙ্গে মির্জা আব্বাস দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ায় এমনিতেই রাজধানীতে বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রম দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাই আন্দোলন কর্মসূচী পালন করতে মির্জা আব্বাস তাঁর সমর্থকদের নিয়ে মাঠে নামলেও খোকা ও সোহেল সমর্থকরা না নামলে সে আন্দোলন গতি পায় না। অবশ্য ২২ সেপ্টেম্বরের হরতালে কয়েক মিনিটের জন্য হাবিব-উন-নবী খান সোহেল মাঠে নামলেও মির্জা আব্বাস ও তাঁর অনুসারীরা মাঠে নামেননি। আর সাদেক হোসেন খোকা দেশের বাইরে থাকায় তাঁর অনুসারীরাও মাঠে নামেননি। তাই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর হরতাল চলাকালে দিনভর বিএনপি কার্যালয়ে থাকলেও অন্যান্য নেতাকর্মীরা মাঠে না থাকায় তিনিও মাঠে নামার চেষ্টা করেননি।
ভবিষ্যত আন্দোলনের পরিণতির কথা ভেবে বিএনপি নেতারাও এখন নরম সুরে কথা বলতে শুরু করেছেন। ঈদের দিন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া দিনক্ষণ দিয়ে আন্দোলন হয় না বলার পর এখন দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অন্য নেতারাও একই সুরে কথা বলা শুরু করেছেন। তবে সরকারের সঙ্গে সংলাপ ও বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশের মাধ্যমে সরকারকে চাপ প্রয়োগ করে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনে করার ব্যাপারে বিএনপি নানামুখী কৌশল অব্যাহত রেখেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আন্দোলন শুরু করতে না পারার জন্য বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতা একটি অন্যতম কারণ। কারণ, বিএনপিতে এখন কেন্দ্র থেকে শুরু করে সর্বস্তরে সাংগঠনিক অবস্থা নাজুক। তাই নেতাকর্মীরা এখন সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় হতে চাচ্ছেন না। বরং কৌশলে সরকারী দলের লোকজনের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিভিন্নভাবে আর্থিক লাভবান হচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে আন্দোলনে আগ্রহ নেই তাঁদের। এ জন্যই বিএনপি আন্দোলনের জন্য প্রস্তুতি নিতে পারছে না। আর এ কারণেই আন্দোলন ইস্যুতে বিএনপি নেতারা এখন নরম সুরে কথা বলছেন।
অবশ্য ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকেও আপাতত আন্দোলন কর্মসূচী পালন না করার ব্যাপারে বিএনপির প্রতি চাপ রয়েছে বলে জানা গেছে। জানা যায়, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ও এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টুর মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা খালেদা জিয়ার কাছে দাবি করেছেন তিনি যেন রাজপথ উত্তপ্ত করার মতো কর্মসূচী না দেন। আন্দোলনে যাওয়ার ব্যাপারে এ বিষয়টিও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে ভাবিয়ে তুলেছে বলে জানা গেছে।
বিএনপির আন্দোলনে অতীতে চালিকাশক্তি ছিল সহযোগী সংগঠন ছাত্রদল ও অঙ্গ সংগঠন যুবদল। কিন্তু নিজেদের মধ্যে কোন্দলের কারণে ছাত্রদল ও যুবদল এখন অনেকাংশেই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। ছাত্রদল সারাদেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশই করতে পারছে না। তারপরও এই সংগঠনের নেতাদের মধ্যে বিরাজমান কোন্দলে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও হতাশ হয়ে পড়েছে। একই অবস্থা যুবদল নেতাকর্মীদেরও। এক সময়ের রাজপথ কাঁপানো যুবদলের নেতাকর্মীরা এখন সরকারী দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ঠিকাদারি কাজ নিয়ে ব্যস্ত। বিএনপির আরেক সহযোগী সংগঠন শ্রমিক দল এখন রাজনীতিতে একেবারেই নিষ্ক্রিয়। শ্রমিক দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তাই তাঁরাও সরকারী দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে নির্বিঘ্নে চাকরি করছেন এবং বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা ভোগ করছেন। এছাড়া সম্প্রতি শ্রমিক দলের বর্তমান কমিটির নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে একটি পাল্টা কমিটি হওয়ায় পরিস্থিতি আরও নাজুক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। বিএনপির অঙ্গ সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক দল রাজপথে আন্দোলনসহ দলীয় বিভিন্ন কর্মসূচীতে কিছুটা সক্রিয় হলেও মামলা-হামলার ভয়ে তারাও এখন আগের চেয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। এছাড়া বিএনপির অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনের মধ্যে মহিলা দল, ওলামা দল, মুক্তিযোদ্ধা দল, জাসাস, কৃষক দল, মৎস্যজীবী দল ও তাঁতী দল মাঝে মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা পর্যায়ের কর্মসূচী পালন করলেও আন্দোলন কর্মসূচী পালনের ব্যাপারে এ সব সংগঠনের অনীহা রয়েছে। এ ছাড়া রাজপথে আন্দোলনে জড়িয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর রোষানলে পড়তে চান না তাঁরা।
জানা যায়, বিএনপি নেতাকর্মীরা এখন মামলা-হামলাকে অনেক ভয় পান। এটিই এখন আন্দোলনে অনীহার অন্যতম কারণ। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সহিংস আন্দোলন করতে গিয়ে সারাদেশে বিপুল বিএনপি নেতাকর্মী মামলায় জড়িয়ে পড়েন। অনেকেই এ সব মামলায় জামিন পেলেও কেউ কেউ এখনও কারাগারে আছেন। রাজপথের আন্দোলন আবার যখন চাঙ্গা করতে যাবেন তখন আবার তাদের ওপর ঝুলে থাকা মামলাগুলো সামনে নিয়ে আসবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এছাড়া আন্দোলন চলাকালে কোন সহিংস ঘটনা ঘটলে আবার নতুন করে মামলা খেতে হবে তাদের। এ জন্যই বিএনপি আন্দোলনের হাঁকডাক দিলেও দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে একটি বড় অংশ সেদিকে কান না দিয়ে নিজ নিজ কাজ নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন। আর এ কারণেই আন্দোলনের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ছেন বিএনপি হাইকমান্ড। তাই আগের অবস্থান পরিবর্তন করে এখন বিএনপি নেতারা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের কথা বলছেন। আর এ কথা শুনে দলের ত্যাগী নেতাকর্মীরা হতাশ হয়ে পড়ছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, আন্দোলন দিনক্ষণ দিয়ে হয় না এ কথা ঠিক। তাই বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া এ কথা বলেছেন। তবে এটাও ঠিক আন্দোলন করার ব্যাপারে বিএনপি বেশি দিন অপেক্ষা করবে না। আমরা সরকারকে অনেক সময় দিয়েছি। সরকার যদি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যাপারে সংলাপের আয়োজন বা কোন কার্যকর ব্যবস্থা না করে তাহলে আন্দোলন করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না। তবে তাৎক্ষণিকভাবে যখনই আন্দোলনের কোন ইস্যু চলে আসবে তখনই আন্দোলন হবে।