ইসলাম ধর্ম অবমাননার অভিযোগ : উস্কাচ্ছে ছাত্রলীগ?
প্রকাশিত হয়েছে : ৩:১১:২০,অপরাহ্ন ০২ এপ্রিল ২০১৫
নিউজ ডেস্ক::
নড়াইলে ইসলাম ধর্মকে কটাক্ষ করার অভিযোগ এনে এক হিন্দু শিক্ষককে ঘরছাড়া করার হুমকি দেওয়া হয়েছে। আর এ ঘটনায় নেতৃত্ব দিচ্ছে ছাত্রলীগের কয়েকজন স্থানীয় নেতা-কর্মী। এলাকা থেকে ওই হিন্দু শিক্ষককে তাড়ানোর উদ্দেশ্যে তার মন্তব্যের ওপর রঙ চড়িয়ে ও ইচ্ছেমতো কথা জুড়ে দিয়ে এলাকায় পোস্টার ছড়িয়েছে সুবিধাবাদী মহলটি। এমনকি তাদের ইচ্ছা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষকে ভুল বুঝিয়ে পক্ষে টানতে নিয়মিতভাবে সেখানে মিছিল-সমাবেশও করছে তারা। ভুক্তভোগী শিক্ষকের নাম কিংকর চন্দ্র সমাজদার। তিনি জেলার লোহাগড়া দিঘলিয়া আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক।
সরেজমিন পরিদর্শন করে ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ২৩ মার্চ নিজ বাসায় প্রাইভেট পড়ানোর সময়ে ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে সাধারণ আলোচনায় ওই শিক্ষকের বলা একটি বক্তব্যকে বিকৃত করে উপস্থাপনের মাধ্যমে এ ঘটনার সূত্রপাত। এরপর বিষয়টি স্কুল ঘুরে মুখে মুখে অতিরঞ্জিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং সুবিধাবাদী একটি মহল এর ফায়দা লোটার চেষ্টা করা শুরু করে। এ ঘটনায় ওই বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকও মদদ দিচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এজন্য স্কুলের কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদেরও ব্যবহার করছেন তারা।
২৩ মার্চ শিক্ষক কিংকরের বাসায় ইংরেজি প্রাইভেটে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা জানায়, তাদের আলোচনার এক পর্যায়ে ধর্ম নিয়ে কথা ওঠে। স্যার (কিংকর চন্দ্র সমাজদার) এ বিষয়টা বাদ দিতে বললেও তারা আলোচনা করতে চাইলে এক পর্যায়ে স্যার বলেন, ‘উপমহাদেশে ধর্ম নিয়ে গোঁড়ামি আছে’। পরদিন ইসলাম ধর্মে কোন গোঁড়ামি আছে কি না- স্কুলের ১০ম শ্রেণির ক্লাসে এ বিষয়ে কয়েকজন ছাত্র প্রশ্ন করে। ধর্ম ক্লাসের শিক্ষক আতাউর রহমান এর সঠিক উত্তর না দিয়ে শিক্ষার্থীদের খোঁচাতে থাকেন এই কথা কে বলেছে তা জানার জন্যে। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীরা কিংকর স্যারের নাম বলে ফেললে ওই ধর্মশিক্ষক ক্লাস থেকে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এসে বিষয়টি প্রধানশিক্ষকসহ অন্যদের অবহিত করেন। এরইমধ্যে এই মন্তব্যের সঙ্গে রঙচড়াতে শুরু করেন তিনি এবং এটি ধর্মকে অবমাননার শামিল বলে মন্তব্য করতে থাকেন।
বিষয়টি স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক রতন কুমার বাগচী জানার পর তিনি ওই শিক্ষককে মৌখিকভাবে এ ধরনের মন্তব্য না করার জন্য পরামর্শ দেন। এদিকে ওই ধর্ম শিক্ষক ও তার সমর্থক কয়েকজন শিক্ষক এবং ছাত্র-ছাত্রীদের মাধ্যমে রঙচঙে হয়ে পুরো এলাকাতে ছড়িয়ে পড়ে। দিঘলিয়া বাজারে ওই শিক্ষকের বক্তব্যকে বিকৃত করে ধর্মভীরু মানুষের সামনে বলা হয়, কিংকর বাবু মহানবী (সা.) সম্পর্কে কটূক্তি করেছেন, বোরকা পরা মুসলিম মেয়েদের খারাপ আখ্যা দিয়ে ইসলাম ধর্মকে কটাক্ষ করেছেন।
বিষয়টি জানার সঙ্গে সঙ্গে এর সত্যতা যাচাই না করেই শিক্ষক কিংকরকে এলাকা তো বটেই নড়াইল ছাড়া করার ঘোষণা দেন দিঘলিয়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ জহুরুল ইসলাম রেজওয়ান এবং স্থানীয় ধর্মভীরু সাধারণ মানুষের মধ্যে এ বিষয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে তাদের সংগঠিত করা শুরু করেন তিনি। বিষয়টি বাড়াবাড়ি পর্যায়ে যাওয়ায় স্কুল ম্যানেজিং কমিটি ২৫ মার্চ সভা করে। সভায় কিংকর চন্দ্র সমাজদারকে সাময়িক বরখাস্ত, কারণ দর্শানো নোটিস এবং ঘটনাতদন্তে ৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়।
স্থানীয়রা জানান, বিদ্যালয়ের এ সিদ্ধান্তেও খুশি হতে পারেননি শেখ জহুরুল ইসলাম রেজওয়ানসহ স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি। তারা তাদের সিদ্ধান্তে অটল থেকে শিক্ষক কিংকরকে এলাকা ছাড়া করার পরিকল্পনা শুরু করেন। বিদ্যালয়ের ধর্ম শিক্ষকসহ আরও কয়েকজন শিক্ষক তাদের ইন্ধন জোগাতে থাকেন। তাদের প্ররোচনায় কিংকরের শাস্তির দাবিতে ২৯ মার্চ ছাত্রলীগ নেতা রেজোয়ানের নেতৃত্বে দিঘলিয়া স্কুলের সামনে থেকে গোটা বাজারে মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। এরপর সমাবেশ থেকে অভিযুক্ত শিক্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করা হয়। একইসাথে বাজার এলাকায় সাঁটানো হয় বহু পোস্টার।
ওই বিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র দিঘলিয়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ জহুরুল ইসলাম রেজওয়ান বলেন, কিংকর স্যারের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের ঘটনা আগেও ঘটেছে। স্কুল কর্তৃপক্ষ যদি আমাদের সন্তুষ্ট করতে না পারে, তাহলে আমরা আবারও আন্দোলন সংগ্রাম করবো। তাদের দাবির ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তাকে শুধু স্কুল নয়, নড়াইল ছাড়া করতে হবে।’
এদিকে স্কুলে সরেজমিনে গিয়ে ধর্ম শিক্ষক আতাউর রহমানের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বললে তিনি দাবি করেন, ‘দশম শ্রেণির ক্লাসের শেষদিকে শিক্ষার্থীরা উসখুস করছিল। একে অন্যকে কিছু বলার জন্য পীড়াপীড়ি করছিল। আমি তাদের কী সমস্যা জানতে চাইলে খসরুজ্জামানসহ অন্যরা আমাকে জানায়, কিংকর স্যার তাদের বলেছেন, ইসলাম কোন ধর্ম নয়; এটি কুসংস্কারে ভরা। বোরকা পরিহিতরা বেশি শয়তান হয়। তাদের বেশিরভাগ পালিয়ে বিয়ে করে ইত্যাদি। বিষয়টি তৎক্ষণাত আমি প্রধানশিক্ষককে অবহিত করি। তিনি ক্লাসশেষে অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়ে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলেন।’ তবে এ ঘটনায় অভিযুক্ত সহকারী শিক্ষক কিংকর চন্দ্র সমাজদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি আনীত অভিযোগকে উদ্ভট ও বানোয়াট দাবি করে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে একটি মহল পরিকল্পিতভাবে ষড়যন্ত্র করছে। আমি প্রত্যেক ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।’
তিনি বলেন, ”প্রাইভেট পড়তে আসা শিক্ষার্থীরা ধর্ম বিষয়ে আলোচনাকালে আমি বলি, এসব বাদ দাও। আমাদের পাক-ভারত উপমহাদেশে ধর্ম নিয়ে বেশ গোঁড়ামি আছে। ‘কথায় কথা বাড়ে আর ভোজনে বাড়ে পেট’ এই বলে আমি তাদের পড়ার দিকে মনোযোগী হতে বলি। তিনি দাবি করেন, ওই কথার ডালপালা ছড়িয়ে একটি মহল অনৈতিক ফায়দা তুলতে এমন কাজ করছে।” ভারপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক রতন কুমার বাগচী’র সঙ্গে পরে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন,’বিষয়টি জানার পর আমি তাকে ধিক্কার জানিয়েছি। সত্য-না মিথ্যা তা জানতে চাইনি, তার কথায় কেউ যেন ক্ষুব্ধ না হন-সে বিষয়ে তাকে সতর্ক করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, পরদিন বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় তাকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। এছাড়া পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ওবায়দুল্লাহ বিশ্বাসকে আহ্বায়ক করে ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি ৫ কর্মদিবসের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন দাখিল করবেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্কুলের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি শেখ লতিফুর রহমান পলাশ বলেন, আমরা চাই না, ধর্মীয় অনুভূতিতে কেউ আঘাত দিক বা এটি নিয়ে দেশব্যাপী ন্যাটা (ঝামেলা) হোক। কিংকর বাবুর বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার পরপরই ম্যানেজিং কমিটির সভা থেকে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা রিপোর্ট দিক, এরপর পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ হবে।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার শহীদুর রহমানের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কেউ আমাকে জানাইনি, আমিও জানি না।’ কথা হয় লোহাগড়া থানার ওসি শেখ লুৎফর রহমানের সঙ্গে। তিনি বিষয়টি এই প্রতিবেদকের কাছেই শুনলেন দাবি করেন। এরপর তিনি এসআই নজরুল ইসলামকে ঘটনাস্থলে গিয়ে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে নির্দেশনা দেন।
এদিকে, ওই প্রাইভেটে পড়তে যাওয়া বেশ কিছু শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, যেভাবে মিছিল সমাবেশে কিংকর স্যারকে জড়িয়ে বিভিন্ন রকম বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে এসব কথার কিছুই তিনি বলেননি। তার নামে ছাপানো পোস্টারেও যা কিছু বলা হচ্ছে সব বানানো ও মিথ্যা। এমন আলোচনা তিনি করেনই নি। এবিষয়ে ৩১ মার্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির কাছে প্রকৃত সত্য তথ্য উল্লেখ করে ২২জনের স্বাক্ষরে একটি চিঠি দিয়েছে সঠিক তথ্য যাচাই করে বিচার করার জন্যে।