আপনি জানেন কী আপনার ছেলেমেয়ে ইন্টারনেটে কি করছে?
প্রকাশিত হয়েছে : ৯:৫৯:০৬,অপরাহ্ন ০৩ মার্চ ২০১৫
তথ্যপ্রযুক্তি ডেস্ক::
একজন মা আকুতি নিয়ে লিখেছেন, ‘আমার ছেলেমেয়ে সারা দিন ইন্টারনেটে কী যে করে বুঝি না। আমি নিজেও ইন্টারনেটের কিছু বুঝি না। কী করব?’
সমস্যাটি কি শুধু একজন মায়ের, নাকি এ সমস্যা আরও অনেক মা-বাবার? চলুন, উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়ে একটু গল্প করি। আমরা যখন এই উঠতি বয়সের যাত্রার ভেতর দিয়ে গিয়েছি তখন কী কী করেছি? সারা দিন যে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে স্কুলে দিন কাটিয়েছি, স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে আবার তাদের সঙ্গেই খেলার জন্য মাঠে গিয়েছি।
মা-বাবা বলতেন, ‘সারা দিন তো ওদের সঙ্গে স্কুলেই ছিলি, এখন আবার ওদের সঙ্গে খেলা কিসের? পড়তে যা।’ শত চেষ্টা করেও মা-বাবাকে বোঝাতে পারতাম না, স্কুলের ভেতর আর বাইরের কথাবার্তা আর বন্ধুত্ব এক নয়। কোনোভাবে মা-বাবার কাছ থেকে খেলার অনুমতি মিললেও মা কঠিন স্বরে বলে দিতেন, ‘সূর্য ডোবার আগে ঘরে ফিরতে হবে।’ আমরা তাতেই খুশি। কোথায় সারা দিনের ক্লান্তি? এক দৌড়ে চলে যেতাম বন্ধুদের সঙ্গে খেলা বা গল্প করতে।
কী গল্প করতাম? উঁহু, সেটা বলা যাবে না। কিন্তু মা-বাবা নতুন কারও সঙ্গে গল্প করতে বা ঘুরতে দেখলেই জিজ্ঞেস করতেন, ‘ওই ছেলেটা কে রে? ওকে তো আগে কখনো দেখিনি।’ এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে মোটামুটি একটা বার্ষিক পরীক্ষা দিতে হতো। মা-বাবা খুশি থাকলে তবেই ওই নতুন বন্ধুর সঙ্গে খেলার অনুমতি মিলত।
এখনকার সময়ের গল্পটা কী? এই প্রশ্ন সেই ভাবিকে করতেই তিনি তৈরি করা উত্তর দিয়ে দিলেন, ‘এই গল্পে ওই মাঠে গিয়ে গল্প বা খেলা করার জায়গায় যদি লেখো ইন্টারনেটে খেলা আর গল্প করা, তাহলে সব পরিষ্কার। ছেলেমেয়েরা স্কুল থেকে এসেই ইন্টারনেট নামের আধুনিক প্রযুক্তির অন্তর্জালে চ্যাট করবে। আমি যতই বলি, মাত্র না স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলো, এখন আবার গল্প কিসের?’ আমার ছেলে বলে, ‘মা, ওই স্কুলে গল্প আর ঘরে বসে গল্প এক নয়। তুমি ওসব বুঝবে না।’
দুটি গল্পের মধ্যে পার্থক্য এই যে এখনকার ছেলেমেয়েরা আর মুখোমুখি দেখা হওয়ার অপেক্ষায় থাকে না। ইন্টারনেট সেই দূরত্ব ঘুচিয়ে দিয়েছে। আমরা এখন জেনারেশন ‘ওয়াই’ বা ‘এক্স’ নয়; বরং জেনারেশন ‘ডি’ বা ডিজিটাল জেনারেশনকে বড় করার দায়িত্ব হাতে নিয়েছি। কথা তো ঠিক, একসময় আমরা যেমন নতুন নতুন বন্ধু খুঁজতাম চিঠির মাধ্যমে, ওরা এখন সেভাবে বন্ধু খোঁজে না।
ইন্টারনেটে ওরা ‘সাইবার প্রতিবেশী’ তৈরি করেছে, যেখানে একজন আরেকজনকে কখনো না দেখেও একধরনের যোগাযোগ তৈরি হয়ে যায়। মানসিকভাবে একজন আরেকজনের সঙ্গে ‘যুক্ত’। এক অদৃশ্য সুতোয় তারা বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছে। এটা কি খারাপ? আমি বলব, না। অবশ্যই খারাপ নয়। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এই সাইবার যোগাযোগ কতখানি ঝুঁকিপূর্ণ?
আবার ভাবির গল্প বলি। ভাবির উঠতি বয়সের ছেলেমেয়ে আছে। ওদের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবির দুই চোখে ঘুম নেই। আমি ভাবিকে জিজ্ঞেস করি, ‘ভাবি, আপনার বাড়িতে কোনো অপরিচিত মানুষ ঢুকে আপনার ছেলেমেয়ের সঙ্গে গল্প করতে পারবে।’ ভাবি বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘মানে? অপরিচিত মানুষকে আমি ঢুকতে দেব কেন?’
আমি রসিকতা করে বলি, ‘ধরুন, যদি একজন দুষ্টুপ্রকৃতির লোক গভীর রাতে আপনার ছেলেমেয়ের সঙ্গে আড্ডা মারার জন্য আপনার বাড়িতে আসে, আপনি কী করবেন?’ এবার ভাবি ভীষণ রেগে গেলেন, ‘এমন ফালতু কথা বোলো না তো? বাড়িতে আমরা আছি না? আমার বাড়ির দরজা কি খোলা থাকে যে হুট করে ঢুকে যাবে?
দেখো, বাইরের গেটে তালা, ঘরের দরজায় তালা; এসব ভেঙে আসার পরিকল্পনা করলে পুলিশে ফোন করব।’ আমি ভাবির নিরাপত্তাবেষ্টনী দেখে বললাম, ‘তাহলে আপনি নিশ্চিত যে আপনার ছেলেমেয়েরা খুব নিরাপদ।’ ভাবির তৃপ্তির হাসি, ‘অফকোর্স।’ আমি ভয়ে ভয়ে বলি, ‘কিন্তু ভেবে দেখেছেন, এই আপনি এখন বাইরের গেটে, ঘরের দরজায় তালা দিয়ে নিশ্চিন্তে আছেন। ছেলেমেয়েরা যার যার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে ওদের কাজ করছে। ওরা কী করছে?’
ভাবি অবজ্ঞা করেই উত্তর দিল, ‘কি জানি, ওই ইন্টারনেটে কী যেন করছে?’ ‘আপনার ছেলেমেয়ে যে ইন্টারনেটে পৃথিবীর কোনো দুর্ধর্ষ অপরাধীর সঙ্গে কথা বলছে না, সেটা বলবেন কী করে?’ ভাবি এবার সোফা থেকে লাফ দিয়ে উঠল, ‘মানে?’ এবার আমি বুঝিয়ে বলি, ‘ইন্টারনেটে মানুষ ছদ্মনাম ব্যবহার করে। এমনও তো হতে পারে, কোনো শিশু যৌন নির্যাতনকারী বা অপরাধী ভালো মানুষ সেজে আপনার ছেলেমেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে।
আপনি বাড়িঘরে তালা দিয়ে ভাবছেন, কেউ আপনার বাড়িতে আসতে পারবে না। কিন্তু খেয়াল করুন, ওই ইন্টারনেট দিয়ে ওই অপরাধগুলো আপনার সন্তানের শোবার ঘরে ঢুকে পড়তে পারে।’
এবার বোধ হয় ভাবির টনক নড়ল। পারেন তো তখনই ইন্টারনেটের তার কেটে দেন। কিন্তু কথাটা তো সত্য যে এই সাইবার কালচার আমাদের প্রচলিত ছেলেমেয়েদের বড় করার (প্যারেন্টিং) বিষয়টি সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়েছে। আবার মনে করিয়ে দিই, আমরা আমাদের মা-বাবা বা দাদা-দাদির কাছ থেকে এ বিষয়ে কিন্তু কোনো প্রশিক্ষণ পাইনি। অতএব এটা সম্পূর্ণ নতুন চ্যালেঞ্জ।
আমি নিশ্চিত, সেদিন রাতে ভাবির ঘুম হয়নি। গভীর রাতে বারবার উঠে ঘরের দরজা-জানালা চেক না করলেও হয়তো বারবার উঁকি দিয়ে দেখেছেন, তার ছেলেমেয়ে ইন্টারনেটে কোনো অপরাধীর সঙ্গে কথা বলছে কি না।
বিষয়টি নিঃসন্দেহে চিন্তার ব্যাপার। কিন্তু এরা তো এই ডিজিটাল যুগের। ইন্টারনেটের তার কেটে এ সমস্যা সমাধান হবে না। আপনার সন্তানকে অবশ্যই ইন্টারনেট দিতে হবে। নতুবা সে স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে চলনে-বলনে এমনকি জ্ঞানেও পিছিয়ে পড়তে পারে। আপনি কি তা চান? ভাবির গভীর আকুতি, তাহলে করবটা কী? এই প্রশ্নের কোনো সহজ উত্তর নেই। কারণ, আমরা প্রত্যেকেই ভিন্ন। তবে কতগুলো বিষয়ে আপনাদের চোখ রাখা উচিত। দেখুন না এগুলো দিয়ে ঘরে একটা সুন্দর ও সুস্থ পরিবেশ তৈরি করা যায় কি না!
সন্তানের সঙ্গে কথা বলুনঃ এর কোনো বিকল্প নেই। মা-বাবার উচিত পরিকল্পনা করে সন্তানের সঙ্গে বসে ইন্টারনেট ব্যবহার বিষয়ে কথা বলা। যেমন-কখন চ্যাট করবে, কী কী ওয়েবসাইটে যাবে, যাওয়া যাবে না ইত্যাদি।
ওই যে শুরুতে যেমন বলেছি, আমাদের মা-বাবা যেমন আমাদের বলে দিতেন খেলা শেষে কখন বাড়ি ফিরতে হবে, কখন পড়তে হবে ইত্যাদি। ঠিক ওই রকম একটি প্ল্যান সন্তানকে পরিষ্কার জানিয়ে দিন যে আপনি তাকে বিশ্বাস করেন। অতএব যেদিন এই বিশ্বাস ভঙ্গ হবে সেদিন থেকে ইন্টারনেট ব্যবহারের অবাধ লাইসেন্স বন্ধ হবে। সহজ ভাষায়, আপনার সন্তানকে ইন্টারনেট ব্যবহারের বাউন্ডারি ঠিক করে দিন।
এই বাউন্ডারি ঠিক করার সময় আরও কয়েকটি বিষয় খেয়াল রাখবেনঃ
ঘরের দরজা বন্ধ করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইন্টারনেট ব্যবহারে কিছুতেই উৎসাহিত করবেন না। যদি ঘরের দরজা বন্ধ করতেই হয়, তাহলে যেকোনো সময়, যেকোনো অজুহাতে ঘরে ঢুকে সন্তানের সঙ্গে কথা বলবেন।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে আপনার সন্তান পড়াশোনা এবং ইন্টারনেটে কথাবার্তা (চ্যাট) একই সময়ে করতে চাইবে। আপনি সেটা না করতে দিলেই ভয়াবহ যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। দুটো কাজ একসঙ্গে করা যায় না, আমি তা বলব না। তবে এটা সত্য যে পড়াশোনা এক ঘণ্টায় করা যায়, সেটা করতে দুই ঘণ্টা লাগতে পারে। সন্তানের সঙ্গে আলোচনা করে সময় ঠিক করুন, কখন পড়াশোনা আর কখন চ্যাট করা উচিত। তবে এটা অবশ্যই যৌথ সিদ্ধান্তে হওয়া উচিত।
ই-মেইল পাসওয়ার্ডঃ সন্তানকে বলুন আপনার অনুমতি ছাড়া ইন্টারনেট অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড বদলানো যাবে না। তার মানে এই নয়, আপনি প্রতিদিন তার ই-মেইল পড়বেন। কিন্তু ও জানবে আপনি ইচ্ছে করলেই ওর ই-মেইল পড়তে পারেন।
আপনার সন্তান যাদের সঙ্গে ইন্টারনেটে কথা বলে (ইন্টারনেটের ভাষায় একে বলে চ্যাট), তাদের বিষয়ে জিজ্ঞেস করুন। জানুন কে কে ওর স্কুলের বন্ধু আর কে কে স্কুলের বাইরের, জিজ্ঞেস করুন কীভাবে পরিচয় হয়েছে? যদি কখনো দেখেন যে নতুন বন্ধুর নাম লিস্টে যোগ হয়েছে, প্রশ্ন করুন।
ইন্টানেটে আপনি ইচ্ছে করলেই দেখতে পারেন আপনার সন্তান কী কী ওয়েবসাইট ব্রাউজ করেছে। কথা বলে ঠিক করুন, আপনার সন্তান কখনোই ওই ওয়েবসাইট হিস্ট্রি মুছবে না। কারণ, আপনি যেকোনো সময় তা চেক করতে পারেন। যদি সে ব্রাউজিং হিস্ট্রি মুছে ফেলে, তবে সে তার ইন্টারনেটের স্বাধীনতা হারাবে।
সন্তানের ওপর চোখ রাখুন। ওর আচরণে কি হঠাৎ কোনো পরিবর্তন খেয়াল করছেন? প্রিয় টেলিভিশনের অনুষ্ঠান, কম্পিউটার গেম বাদ দিয়ে কি ইন্টারনেটে বসে আছে? যদি তাই হয়, প্রশ্ন করুন ও সারাক্ষণ ইন্টারনেটে কী করে?
অনেকে বলেন, এত ঝামেলা না করে বাজার থেকে ইন্টারনেট সিকিউরিটি ফিল্টার কিনলেই তো সব সমাধান হয়ে যায়। অস্ট্রেলিয়া সরকার বিনা মূল্যে সবাইকে এই ফিল্টার দিচ্ছে। আমার ধারণা, এই ফিল্টারকে কীভাবে ফাঁকি দেওয়া যায়, তা এই ‘ডিজিটাল জেনারেশন’ জানে। আমি ডাউনলোড করিনি। আমার সন্তানকে বলেছি, ‘তুমি আমার ফিল্টার।
যেদিন দেখব তুমি ফিল্টার করছ না, সেদিন থেকে তোমার ইন্টারনেট ব্যবহার আমার হাতে চলে আসবে।’ তার পরও জানি, আমাকে চোখ রাখতে হবে। কারণ এ বয়সটাই ভিন্ন। ওরা অ্যাঞ্জেল নয়। অতএব মা-বাবার চোখ ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা তো থাকবেই।
সন্তানের সঙ্গে ইন্টারনেট সম্পর্কে কথা বলতে গেলে আপনাকেও ইন্টারনেট সম্পর্কে জানতে হবে। নতুবা আপনাকে বোকা বানানো খুব সহজ। অতএব ওদের সঙ্গে তাল মেলাতে হলে ওদের ভাষা শিখুন। ওদের লয়ে চলুন।
ভালো করে তাকিয়ে দেখুন, আপনার চারপাশে অনেক বন্ধুবান্ধব আছে, যারা কম্পিউটার সম্পর্কে বেশ ভালো জানে এবং এক কাপ চায়ের বিনিময়ে আপনার অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে। শেষ কথা হলো, ইন্টারনেট মানে কমিউনিকেশন। অর্থাৎ একজনের সঙ্গে আরেকজনের যোগাযোগ।
আপনার বড় শক্তি হোক আপনার সন্তান, এর সঙ্গে আপনার যোগাযোগ। আমি জানি, এই লেখা পড়ে আমার সেই ভাবি বলবেন, ‘তো যোগাযোগটা বাড়াব কীভাবে?’ এর উত্তর ভবিষ্যতে। ভালো থাকুন।