অন্ধকারে চট্টগ্রাম দোহাজারী রেলপথ প্রকল্প
প্রকাশিত হয়েছে : ১০:০২:৫৪,অপরাহ্ন ২১ জুন ২০১৫
শোভন দাশ বাবু
চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেলপথের উন্নয়ন কোন আঞ্চলিক দাবি নয়। এই রেলপথটি বাস্তবে উন্নয়নের আলো দেখলে এটি হবে আন্তর্জাতিক করিডোর যা জাতীয় অর্থনীতির উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখবে নিঃসন্দেহে। চট্টগ্রামের প্রায় বিশটি থানার মধ্যে বোয়ালখালী, কর্ণফুলী, আনোয়ারা, পটিয়া, বাঁশখালী, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চন্দনাইশ, দোহাজারী থানা রয়েছে। চট্টগ্রাম-দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রস্তাবসমূহ এখন জনদাবিতে পরিণত হয়েছে। রেলযোগাযোগ ব্যবস্থা শুধু পরিবেশ বান্ধব নয়, দরিদ্র বান্ধব ও বটে। রেলপথ যদি ও সাশ্রয়ী ও নিরাপদ বেশি হওয়া স্বত্তেও এর প্রতি চরম অবহেলা দরুণ বিট্রিশরাই যে রেলপথ আমাদেরকে দিয়ে গিয়েছিলেন তাও আজ অনেকটাই সংস্কারের অভাবে মৃতপ্রায়। বাংলাদেশের অবকাঠামোতে দেখা গেছে সড়ক পথে সবচেয়ে বরাদ্দ দিয়ে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি কাজ করা হয়েছে। বাস্তবে বাংলাদেশে অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে, কিন্তু তাদের কথা,চিন্তা করেই রেলযোগাযোগ ব্যবস্থাকে উন্নত করা প্রয়োজন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবানে প্রায় ৪৪৮০ কিমি. রিজার্ভ ফরেস্ট রয়েছে, আছে পর্যটনের মিনি এভারেষ্ট চিম্বুক পাহাড় কেওক্রাডং। দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মিত হলে সেখানে পর্যটকদের যাতায়াত সহজ হবে, ১২০ কিমি. আন্তর্জাতিক মানের সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারও হাজারগুণ সমৃদ্ধ হবে। এতে পর্যটন নগরী কক্সবাজার হয়ে উঠবে বাণিজ্য তথা শিল্পনগরী। সী ফুড, সল্টেড এন্ড ডিহাইড্রেডেড ফিস, ফ্রোজেন ফুড, টিম্বার উড প্রোডাক্টস, শতাধিক হ্যাচারী শিল্প তার পরিচয় দেয়। লবণ ও চিংড়ি উৎপাদনে বিশেষ উন্নতি হবে এই রেলপথ যোগাযোগের কারণে। এছাড়া চীন, থাইল্যান্ড, মায়ানমারের পণ্য বাজার এখন কক্সবাজারে। মহেশখালীর গভীর সমুদ্রবন্দর এই প্রস্তাবনা ও সম্ভাবনাকে বহুগুণ বাড়িয়ে তুলবে। বাংলাদেশের ২য় সীমান্ত টেকনাফ বাংলাদেশ-মায়ানমারের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জন্য ট্রানজিট-পোর্ট হিসেবে গড়ে উঠবে।
বাংলাদেশের জাতীয় সমৃদ্ধির স্বর্ণদ্বার যদি চট্টগ্রাম বন্দর হয় তাহলে চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেলপথটি বাস্তবায়ন হলে এটি হবে বাংলাদেশের স্বর্ণপথ। ঢাকা-চট্টগ্রাম চারলেন, পদ্মা সেতুর মতোই এ রেলপথটি গুরুত্ব বহন করে। এই গুরুত্ব উপলব্ধি করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল কক্সবাজারের ঝিংলঝায় ঘুমধুম পর্যন্ত রেলপথের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ট্রান্স-এশিয়ার সাথে বাংলাদেশকে যুক্ত করতে সরকার এই প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় যদিও তা কাগজে-কলমে এখনো সীমাবদ্ধ। দোহাজারী রেলপথটি কক্সবাজার হয়ে ঘুমধুম পর্যন্ত সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ কেবল শিলান্যাস, নামফলক উন্মোচন এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। দাতা গোষ্ঠির অপ্রতুল বরাদ্দসহ সবকিছু মিলিয়ে এই প্রকল্পটি যেই তিমিরে ছিল বর্তমানেও সেই তিমিরে রয়েছে। প্রকল্প ব্যয় এবং ভূমি অধিগ্রহণ ব্যয় পূর্বের তুলনায় বর্তমানে বেড়েছে কয়েক গুণ। এভাবেই প্রকল্প ব্যয় এবং ভূমি অধিগ্রহণ ব্যয় সংশোধিত হয়ে বার বার এর প্রাক্কলিত ব্যয় বাড়তি হওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে।
তথ্যানুসারে, ১৮৯০ সালে বার্মিজ স্টেট রেলওয়ের চীফ ইঞ্জিনিয়ার বার্মাকে চট্টগ্রামের সাথে সংযুক্ত করার জন্য একটি প্রস্তাব দেন। ১৮৯৩ সালে মিনবু-আনপাস-আরাকান-চিটাগাং এর বিভিন্ন রুটে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। ১৯১৭-১৯১৯ সালে চট্টগ্রামকে মংডুর সাথে সম্পৃক্ত করার জন্য আরেকটি সার্ভে করা হয়। ১৯২০ সালে বৃটিশ-ইন্ডিয়ান রেলওয়ে কর্তৃক রেংগুনকে চট্টগ্রামের সাথে সংযুক্ত করার জন্য একটি সার্ভে করা হয়। ১৯১৭-১৯ এর সার্ভে অনুযায়ী বার্মা এলাকায় রেংগুন থেকে মিনবু পর্যন্ত রেললাইন নির্মিত হয়। অন্যদিকে বাংলায় চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণ করা হয়। কিন্তু দুভার্গ্যবশত ঘটনাচক্রে মিনবু থেকে দোহাজারী পর্যন্ত অংশটি নির্মিত হয়নি। ১৯৫৮ সালে পুণরায় কক্সবাজার পর্যন্ত ৯০ কিমি. রেললাইন নির্মাণের জন্য একটি সার্ভে করা হয়। ১৯৭৬-৭৭ সালে জাপান রেলওয়ে টেকনিক্যাল সার্ভিস ইজক্যাপ এর সহায়তায় ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের অংশ হিসেবে সার্ভে করা হয়। ২০০১ সালে আগস্ট মাসে কলকাতার ক্যানারাল ইন এসোসিয়েশন উইথ সিসট্রা/বিসিএল সর্বশেষ স্টাডি পরিচালনা করে। ৯ম অধ্যায়ের এই ফিজিবিলিটি রিপোর্টে বিস্তারিতভাবে চট্টগ্রাম-দোহাজারী-কক্সবাজার রেলের সম্ভাব্যতার কথা উপস্থাপিত হয়েছে।
১ম অধ্যায়ে এতে একটি ভূমিকা দেয়া হয়েছে এবং সোশাল ইকোনোমিক ব্যাকগ্রাউন্ড বর্ণনা করা হয়েছে। স্টাডির ২য় অধ্যায়ে ট্যুরিষ্ট ট্রাফিক, নরমাল ট্রাফিক অর্থাৎ ইন্টার ডিষ্ট্রিক্ট যাত্রীদের ট্রিপের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে পর্যটন নগরী চট্টগ্রাম ও সিলেটের সাথে একটি তুলনামূলক চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। ২য় ও ৩য় অধ্যায়ে ফ্রেইট ট্রাফিক ফোরকাস্ট এর বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে লবণ, চিংড়ি উৎপাদন ও চাহিদা, রেলওয়ের মাধ্যমে পরিবহনের বিস্তারিত বর্ণনা আছে। ফুডগ্রেইন বিশেষ করে ধান, চাল, গম, তরিতরকারি, শাকসবজী, ফল ইত্যাদি উৎপাদন বহনের পরিসংখ্যান রয়েছে। সড়কপথের চাইতে রেলপথে কম খরচে পরিবহনের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ রয়েছে। পেট্রোলিয়াম প্রোডাক্টস, টিম্বার ইত্যাদি রেলপথে পরিবহনের সম্ভাবনার কথাও উল্লেখ রয়েছে। প্রায় শতাধিক হ্যাচারি চকরিয়া থেকে কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় উৎপাদিত পণ্য সহজে রেলপথে পরিবহন করা যাবে। স্টোন এবং বোল্ডার্স পরিবহন করা যাবে, তাছাড়া ক্লিংকার, উডপাল্প, হেভী মিনারেল ইত্যাদি পরিবহনে নতুন দিগন্তের সূচনা হবে।
বিশেষভাবে ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে এবং কক্সবাজার মহেশখালী গভীর সমুদ্রবন্দরের অপার সম্ভাবনাকে উপস্থাপন করা হয়েছে। ৪র্থ অধ্যায়ে প্রকল্পের অবকাঠামো নির্মাণের বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে ট্রেক ষ্ট্রাকচার, স্টেশন্স এন্ড বিল্ডিংস আর্থ ওয়ার্কস, ব্রিজেস এবং কালভার্টস, সিগনেলিং এবং টেলিকমিউনিকেশনের বর্ণনা ও কস্ট স্টেটমেন্ট দেয়া হয়েছে। ৫ম অধ্যায়ে বর্তমান অবকাঠামো ও অপারেশন ঢাকা-কক্সবাজার ট্রেন, চিটাগাং ট্রেন্স, কমিউটার ট্রেন্স, স্টাফিং এর বর্ণনা করা হয়েছে। ফিশ ট্রান্সপোর্টসহ ফ্রেইট ট্রেন অপারেশন এর বিশদ বর্ণনা রয়েছে। ইঞ্জিনিয়ারিং টেকনিক্যাল রিপোর্ট, সিগন্যালিং এর বর্ণনা করা হয়েছে। উক্ত ফিজিবিলিটি স্টাডিতে জনবল এবং যাত্রীবাহী ও মালবাহী ট্রেনের চাহিদার কথাও রয়েছে। ৬ষ্ঠ অধ্যায়ে ফাইবার অপটিক্যালসহ রাজস্ব, কন্সট্রাকশন কষ্ট, রোলিং স্টকসহ ফাইন্যান্সিয়াল এনালাইসিস এর বর্ণনা আছে। ৭ম অধ্যায়ে ইকোনমিক বেনিফিট্স এবং ৮ম অধ্যায়ে ইকোনমিক এনালাইসিস এর বর্ণনা রয়েছে। ৯ম অধ্যায়ে একটি উপসংহার ও রিকমেন্ডেশন দেয়া হয়েছে।
চীন, জাপান, ভারত, আমেরিকা, ইউরোপ, রাশিয়াসহ উন্নত দেশে উন্নত রেল যোগাযোগের কারণে চাকরি, শিক্ষা, চিকিৎসা বা ভিন্ন কারণে গ্রাম, উপশহর থেকে লোকজন প্রধান শহরগুলোতে বসবাসের জন্য স্থায়ীভাবে এসে বসবাস করতে হয় না। কারণ গ্রাম, উপশহর কেন্দ্রিক শিক্ষা, শিল্প, স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান থাকার ফলে সেবা নিতে পারেন সহজে। তদ্রুপ চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেলপথের অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফলে চট্টগ্রামের যানজট-জনজট অনেকাংশে কমে আসবে। সরকারও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোকে ট্রানজিট দিয়ে জাতীয় রাজস্ব আদায়ের পদক্ষেপকে একধাপ এগিয়ে নিতে পারে এই রেলপথ প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে।
অবিভক্ত আসাম রেলওয়ে ১৯২৯-৩১ সালে পূর্বাঞ্চলীয় রেল চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত দীর্ঘ ৪৭ কিমি. রেলপথ নির্মাণ করে। চট্টগ্রাম বটতলী, ঝাউতলা, পলিটেকনিক, ষোলশহর, জান আলীহাট, গোমদন্ডী, বেঙ্গুরা, ধলঘাট, খানমোহনা, পটিয়া, চক্রশালা, খানহাট, হাসিমপুর, দোহাজারীতে প্রায় ১৪টি রেলস্টেশন স্থাপন করা হয়। সর্বনিন্ম ভাড়া ৫ টাকা এবং সর্বোচ্চ ১৩ টাকা ভাড়া নির্ধারিত। কিন্তু এই অল্প ভাড়ার টিকেটও প্রায় যাত্রী ক্রয় করেন না। কারণ রেলে টিকেট চেকার না থাকার কারণে যাত্রীরা মনে করে থাকেন যে, কোন রকমে ফাঁকি দিয়ে ট্রেনে ভ্রমণ করা যাবে অনায়াসে। ট্রেনে মালামাল পরিবহনও চলছে বিনা টিকিটে। ছয় জোড়া আপ-ডাউন ট্রেন লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে ২০০২ সালের ২ সেপ্টেম্বর বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই ট্রেন সার্ভিস বন্ধ করে দেওয়ায় বাধ্য হয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রামের কোটি কোটি জনগণ সড়ক পথে বাধ্য হয়ে নরক যন্ত্রণা ভোগ করছে।
বর্তমানে একটি মাত্র লোকাল ট্রেন শহর থেকে জরাজীর্ণ ৩-৪টি যাত্রীবাহী বগি নিয়ে তৎকালীন প্রায় ১৯৪০ সালে আমদানীকৃত ইউএসএ’র তৈরি জিএমইউ-১০ মডেল ইঞ্জিন দিয়ে প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টায় ছাড়ে আর দোহাজারী গিয়ে পৌঁছে রাত ১০-১১টায়। আবার সেই ফিরতি ট্রেন দোহাজারী থেকে ভোর ৪-৫টায় ছেড়ে বটতলীতে আসতে সকাল ১০-১১টা লেগে যায়। বটতলীতে ট্রেনের বগি দাাঁড়ানো অবস্থায় দেখা যায় মাদকসেবী, সন্ত্রাসী, ছিনতাইকারী, জুয়াড়ীদের নিরাপদ আবাদস্থল। আবার ঐসব লোকেরাই ট্রেনের বগিতে মল-মূত্র ত্যাগ করে থাকেন যেন এই সব দেখার কেউ নেই। ৮০০ হর্স পাওয়ার এর ইঞ্জিনে প্রতি আপ-ডাউন এ প্রায় ১৫০-২০০ গ্যালন তেল খরচ হয়।
এছাড়া এই লাইনে পূর্বে ডি-১, ডি-২ মডেলের ইঞ্জিন ছিল যখন প্রতিদিন ৬ জোড়া ট্রেন চলাচল করত। বর্তমানে দোহাজারী বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ফার্নেস অয়েলবাহি তেলের একটি ওয়াগন প্রতিদিন যাতায়াত করে। কিছুদিন পূর্বে বোয়ালখালী এলাকায় লাইনচ্যুত হয়ে ফার্নেস তেল নদীতে উপচিয়ে পড়ে। গত শুক্রবার বেঙ্গুরা-ধলঘাট স্টেশনের মাঝখানে ২৪ নং সেতু সাইরার পোলটিতে পুণরায় বড়ধরনের দূর্ঘটনা ঘটলো। এতে প্রায় অর্ধ কোটি টাকার দোহাজারী পিকিং প্ল্যান্টের ফার্নেস তেল ছড়িয়ে নদী দূষণ হল যা পরিবেশ বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা করছেন পরিবেশবাদীরা। এই দূর্ঘটনায় ভাগ্যক্রমে চালক বেঁচে গেলেও মারাত্মক আহত হয়েছেন। টেলিগ্রাম বন্ধ হয়েছে অনেক আগে, সিগন্যাল পোস্টও নেই, ভরসা মুঠোফোন। ১১১নং আপ ট্রেনটি যথাসময়েও ছাড়তে পারে না কারণ কোনদিন ইঞ্জিন থাকে না, চালক থাকে না কিংবা পরিচালক থাকে না।
রেলপথের উন্নয়ন সড়ক পরিবহন মালিকরা চান না, কারণ তাদের কোটি টাকা আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যাবে। রেলে নিয়োগপ্রাপ্তরা নিয়োগ পায় রাজনৈতিক বলয়ে, অর্থের মাপকাঠিতে। মেধা-যোগ্যতার বদৌলতে রেলে নিয়োগ না হওয়াতে এই সেবামূলক খাত লোকসান, অপচয় আর হয়রানি ও লুটপাটের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। প্রতিটা রেলস্টেশন দিনের বেলায় মাদকসেবী, জুয়াড়ীদের আড্ডা আর সন্ধ্যা হলেই ছিনতাইকারী সন্ত্রাসীদের নিরাপদ আবাসস্থল। রেলওয়ের বেশির জায়গা বেদখলে। ধলঘাট-বেঙ্গুরা স্টেশনের মাঝখানে সায়রার পোল/সেতুটি সংস্কার করা হয়েছে অনেক বার কিন্তু এই সংস্কারের কাজে এত নয়-ছয় করা হয়েছে যে এখানে ট্রেনটি প্রায় থেমে গিয়ে পার হতে হয়। ধলঘাট-খানমোহনা স্টেশনের মাঝখানে আরেকটি বড় সেতুর অবস্থাও নাজুক। কর্ণফুলীর নদীর প্রথম সেতু ১৯৩০ সালে ব্র“নিক এন্ড কোম্পানী ব্রিজ বিল্ডার্স হাওড়া নামে প্রতিষ্ঠান এই সেতুটি নির্মাণ করে। ১৯৫৮ সড়ক পথের পরিবহন চলাচল করার জন্য উপযোগী করে বর্তমান রূপ দেওয়া হয়। এই ব্রিজটিতে রয়েছে ২টি এব্যাট সেট, ৬টি ব্রিক পিলার, ১২টি স্টীল পিলার ও ১৯টি স্প্যান। সেই হিসেবে সেতুর বয়স প্রায় ৮৫ বছর। ১৯৯৭ সালে কালুরঘাট সেতু দিয়ে ১০ টনের বেশি পণ্য পরিবহন ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে রেলওয়ে। কিন্তু বর্তমানে চরম ঝুঁকিতে এই কালুরঘাট সেতুতে যেকোন সময় বড় দুর্ঘটনা ঘটা অসম্ভব নয়।
জানা যায়, দোহাজারি-রামু-কক্সবাজার ও ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন মিটার গেজ রেলওয়ে প্রকল্প হাতে নেয়া হয় ২০০০ সালে। ১২৮ কিমি. রেললাইন প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছিল চারশ কোটি টাকা। কিন্তু ২০১১ সালে ভূমি অধিগ্রহণে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলা প্রশাসন কর্তৃক সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয় দেড় হাজার কোটি টাকা। এই প্রকল্পের অধীনে নির্মাণ করার কথা ছিল সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়া, ডুলাহাজারা, রামু, ঈদগাঁহ, কক্সবাজার ও উখিয়ায় ৯টি নতুন রেল স্টেশন, ৪টি বড় ও ৪৭টি ছোট ব্রিজ, ১৪৯টি কংক্রিট বক্স কালভার্ট, ৫২টি কংক্রিট পাইপ কালভার্ট। তবে এখানে আলোচ্য বিষয় হল-বার বার এই প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে গিয়ে শেষ পর্যন্ত কবে নাগাদ শুরু হবে আর কবে শেষ হবে তা দেখার বিষয়। দাতা সংস্থার অনাগ্রহ এবং প্রকল্প পরিচালকদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে কাজ বাস্তবায়ন করা আলোচনায় আনতে হবে। ফাইলবন্দি হয়ে কতদিন-কতবছর আরও অপেক্ষার পালা থেকে মুক্তি মিলবে?
প্রথম দফায় ১৮০০ কোটি টাকা, ২য় দফায় ৪ হাজার কোটি টাকা এবং পরে প্রকল্পটির সম্ভাব্য প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ৭ হাজার ৫শ কোটি টাকা। এ রেললাইন বাস্তবায়ন হলে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড ও মায়ানমার হয়ে প্রবেশ করার সুযোগ হবে বাংলাদেশের টেকনাফের কাছে ঘুমধুম সীমান্ত দিয়ে। বাংলাদেশের ইতোপূর্বেকার সরকারগুলোর পূর্বমুখী রাজনীতিকে বাস্তবে রূপ দেবার জন্য যেসব ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছিল তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল দোহাজারী-কক্সবাজার থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণ। এখানে প্রথমত ভূমি অধিগ্রহণ ব্যয় এবং এই রেলপথ প্রকল্প ব্যয় এর সমন্বয় ঘটিয়ে বাস্তবে এর কাজ শুরু করা যাবে। শুধুমাত্র এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক এডিবি কিংবা চীনের দাতা সংস্থারা এই প্রকল্পে আগ্রহী হলেও তারা প্রকল্পের বাস্তবায়নে শতভাগ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা চাইবেন এটাই স্বাভাবিক। ১২৮ কিমি.রেলপথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে ২৭টি দেশের সাথে বাংলাদেশের রেল নেটওয়ার্ক গড়ে উঠবে।
চট্টগ্রাম-দোহাজারী-ঘুমধুম-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্প যে অনিশ্চিত তা গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায়। এবারকার বাজেটেও এ ব্যাপারে বিশেষ কোন বরাদ্দ নেই। ভারতের কেরালার একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বর্তমানে ধীরগতিতে সংস্কার কাজ করলেও তা সন্তোষজনক নয়। এই ট্রান্স এশিয়ান রেল প্রকল্প জাতীয় উন্নয়নের অংশিদার তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবুও কেন এর প্রতি এত অবহেলা, এত উপেক্ষা, এত বঞ্চনা তা বোধগম্য নয়। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে বাধা কোথায় তা জানার সময় কখন আসবে-এ প্রশ্ন দক্ষিণ চট্টগ্রামবাসীর।
লেখক : প্রাবন্ধিক