হুমকিতে ভীত নই হত্যায় বিচলিত বললেন ড. জাফর ইকবাল
প্রকাশিত হয়েছে : ১:৩৯:২৯,অপরাহ্ন ২১ মে ২০১৫
নিউজ ডেস্ক :: অধ্যাপক ড. জাফর ইকবালসহ সারাদেশে ১০ জন রাজনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদকে এক তালিকায় হত্যার হুমকি দিয়েছে আল কায়েদা সমর্থিত বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ১৩।
এই চিঠি দেয়ার প্রসঙ্গ সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রথমত, আমার জন্য এটা নতুন বিষয় না। আমি অসংখ্যবার এরকম চিঠি পেয়েছি। এই চিঠি পেয়ে অনেকবার এমনো হয়েছে যে , কাউকে বলিও নাই। এমনকি আমার স্ত্রীকেও না। আর দ্বিতীয় হচ্ছে, যেহেতু এইবার অনেক বড় বড় মানুষের নাম আছে, সেহেতু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, পুলিশ র্যাব তারাও এ ব্যাপারে ইনভেস্টিগেট করবে। যদি সেটা ইনভেস্টিগেট করে যারা এই কাজগুলো করে তাদের ধরতে পারে তাহলে আমাদের দেশের লাভ।
তবে এইখানে যাদের নাম দিয়েছে, তারা বেশিরভাগই সমাজের প্রতিষ্ঠিত মানুষ, তাদের সেরকম ঝুকি নাই। তারা প্রোটেকশন পায়। এই যেমন আমাকে পুলিশ প্রটেকশন দেয়া হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর, এইচটি ইমাম, তাদেরকে চট করে রাস্তার মধ্যে চাপাতি দিয়ে মারতে পারবে, এই রকম আশঙ্কা আমি দেখি না। কিন্তু যারা একচুয়েলি রিস্কে আছে, অনন্তের মত ছেলেরা, তাদের জন্য কিছু করা, আসলে একমাত্র কর্তব্য। তাদের প্রোটেকশন দেয়া।
অনেকের ধারণা হতে পারে, যারা আক্রমণ করছে, তারা পিছন থেকে এসে লুকিয়ে আক্রমণ করছে, ব্যাপারটা সেরকম না। মোটামুটি প্রকাশ্যেই ঘটছে। তারা অনেকদিন থেকে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। ফোন করছে। কাজেই পুলিশ কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিএসবি কিংবা ইন্টেলিজেন্স, তাদের কাজ শুরু করার জন্য অনেক তথ্য কিন্তু আছে। কিন্তু যাদের কাছে তথ্য আছে, আইনশৃংখলা বাহিনী তাদের কাছ থেকে দিচ্ছে না, যাদের কাছে তথ্য আছে, তারাও ভয়ে আছে পুলিশের কাছে যেতে। কিন্তু এইটা ভাল না। আমি মনে করি ব্যাপারটা যেন ধরেই নেয়া হইছে, এই যে ব্লগার বা নাস্তিক এদেরকে যেন মারা ঠিক আছে, মারলে কিছু হবে না। ষোল কোটির দেশের মানুষ, কিছু মানুষকে তো মারা যায়ই। অনেকটা এই ধরণের একটা পরিস্থিতি আমরা দেখছি। যেটা আমার জন্য কষ্টকর। আমি মনে করি, এই চিঠিটা পাওয়ার পর, সরকার যেন মনে করে কিছু একটা করা উচিত। সমাজের প্রতিষ্ঠিত বড় বড় মানুষ, তারা নিজেদের প্রোটেকশন দিতে পারবে, কিন্তু যাদেরকে প্রোটেকশন দেয় না, তাদের জন্য কিছু একটা করতে হবে।
আগে দেয়া বিক্ষিপ্ত হুমকির সাথে বর্তমানের একসাথে এতজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে দেয়া হুমকি কি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য সমস্যা কিনা, এ প্রসঙ্গে জাফর ইকবাল বলেন, না, একটা কাগজের মধ্যে কয়েকজনের নাম লিখে মেইল করে দেয়া এইটা কঠিন কোন ব্যাপার না। আমি চিঠিটা দেখেছি, এইটাতে বানান যে শুদ্ধভাবে লিখা হয়েছে, তাও না। আমার নামের পাশে যে লিখেছে, আমার অনেকক্ষণ বুঝতে লেগেছে যে কি লিখেছে? তারপর বুঝলাম ওটা সেক্যুলার লেখার চেষ্টা হয়েছে।
তবে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, অভিজিত, ওয়াশিক ও অনন্ত, তিনমাসের ভিতর তিনজনকে মেরে ফেলেছে, এই তিনজনের নামই ওই চুরাশিজনের নামের লিস্টের ভিতর আছে। এইটা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ। এই লিস্টটা দিয়েছে হেফাজত ইসলাম, সেটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাবলিশড হয়েছে, আর এই লিস্ট ধরে ধরে একজন একজন করে মানুষ মারছে। আবার একটা প্যাটার্ণ আছে। যাকে মারবে বলে ঠিক করে, আগে তাকে নাস্তিক হিসেবে কথা বলা শুরু করে, তারপর ব্লগার হিসেবে কথা বলা শুরু করে, ইদানিং ব্লগার একটা গালি, অত্যন্ত বড় গালি, অনেক বড় বড় জ্ঞানী বিজ্ঞানী, শিল্পী , ইসলামি চিন্তাবিদ ব্লগার আছে। তাদেরকে মেরে ফেললে কি হবে? পুলিশ-রাষ্ট্র এমন একটা ভাব দেখায় যে, যারে খুশি মারুক, ওরা কেন করলো এরকম, এমন একটা ভাব আরকি। এদেরকে প্রোটেকশন দিতে হবে। আমাদের দেশে একটা পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে, যাতে আমরা মুক্তভাবে কথা বলতে পারি। আমার কথা পছন্দ না হলে, বলে প্রতিবাদ কর, আমার লিখা পছন্দ না হলে, লিখে প্রতিবাদ কর। আমি যাদি এমন কিছু লিখি যা দেশের আইন পরিপন্থী, দেশের আইন দিয়ে আমার বিচার কর। কিন্তু, মেরে ফেলবে, মারার পর উল্লাস প্রকাশ করবে, এটা সহ্য করতে হবে, এটা মেনে নেয়া যায় না।
আমাদের বাংলাদেশে কোমল একটা ধর্ম ছিল। যা পরিবর্তিত হয়ে অন্য বিচিত্র এক ধর্ম জায়গা করে নিচ্ছে, যেখানে কোনরকম ভালবাসা নাই, স্নেহ নাই, নিষ্ঠুরতা, একে মারো, ওকে মারো। ওকে জবাই করো। ওকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দাও। আমাদের দেশে যে মেয়েটা নাচে, সে নামাজও পড়ে। যে ছেলেটা রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনে, সে রোজা রাখে। পরীক্ষার আগে এসে দোয়া চায়, আমরা তার মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করি। এই হচ্ছে আমাদের ধর্মটা ছিল, এখন তা পরিবর্তিত হয়ে নতুন একটা ধর্ম আসছে। কোন টলারেন্স নাই। অমুক নাস্তিক, তাকে কোপানো হল, সে কখনো নিজেকে নাস্তিক দাবি করে নাই, এরকম কিছু করে নাই যে তাকে বলে দেয়া হল, সে নাস্তিক , বিজ্ঞানের কথা বললে নাস্তিক, যুক্তির কথা বললে নাস্তিক।
ক্রমাগত হত্যার কারণে লেখালেখি কমিয়ে দিচ্ছে সবাই, এরকম প্রশ্নের উত্তরে জাফর ইকবাল বলেন, এদের উদ্দেশ্যই তো তাই। তোমরা লেখালেখি করবে না, ওদের মত করে চলবে। এটাই চায় ওরা।
তবে এটা বড় কোন ঘটনা না উল্লেখ করে জাফর ইকবাল বলেন, না, এই কাজতো খুবই সোজা, একটা কম্পিউটার আর প্রিন্টার থাকলো, লিখলো আর প্রিনট করে খামের ভিতর ভরে ঠিকানা লিখে মেইল কর দিল। এইটাকে আমি ভয় পাই না।
ভয় পাই যখন একজনকে রাস্তায় মেরে ফেলে। ঠিক ভয় পাই না, বিচলিত হই। এটা হচ্ছে বিপদজনক। এবার কয়েকজন বড় বড় মানুষের নাম আছে, দেখি এইবার, তাদেরকে রক্ষা করার জন কোন পদক্ষেপ নেয়া হয় কিনা। আমাকে তো প্রোটেকশন দিচ্ছে সবাই, আমার স্টুডেন্টরাও প্রোটেকশ দিচ্ছে। কিন্তু ওই ছেলেদের কে প্রোটেকশন দিবে?
উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকা জিপিওর মাধ্যমে ‘ইসলাম বিরোধী’ আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং রাজনীতিবিদসহ ১০ জনকে হত্যার হুমকি দিয়ে চিঠি দেয় ‘আল-কায়েদা আনসারউল্লাহ বাংলা ১৩’।
চিঠিতে যে দশজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তারা হলেন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম , শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক , একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার অধ্যাপক কাবেরী গায়েন, জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট অসীম সরকার, সংসদ সদস্য তারানা হালিম ও ইকবালুর রহিম ও গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার।
এছাড়াও এ তালিকায় রয়েছেন বিকাশ সাহা ও পল্টন সুতার নামের আরো দুইজন ব্যক্তি। তাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
ঢাকার জিপিও থেকে পোস্ট করা একই চিঠির কপি অনেকের ঠিকানায় পাঠানো হয়েছে। ইংরেজিতে লেখা সেই চিঠিতে বলা হয়েছে – ‘তোমাদের অবশ্যই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হতে হবে’।