হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিতে ফোরজি নিলামের তোড়জোড়
প্রকাশিত হয়েছে : ৯:৩৯:০২,অপরাহ্ন ০৬ নভেম্বর ২০১৪
তথ্যপ্রযুক্তি ডেস্ক: এখনও সারা দেশে থ্রিজি সেবা চালু হয়নি। কিন্তু এরই মধ্যে ফোরজির তরঙ্গ (৭০০ মেগাহার্টজ) নিলাম নিয়ে বড় ধরনের কমিশন বাণিজ্যে নেমেছে টেলিকম খাতের একটি চক্র। তারা সফল হলে সরকারের এক হাজার কোটি টাকার বেশি গচ্চা যাবে। বিশ্বের সবচেয়ে দামি এই তরঙ্গ ব্যবহারের ক্ষেত্র (জায়গা) তৈরি না করেই তড়িঘড়ি করে এটি নিলামে তোলার চেষ্টা করছে চক্রটি। নেপথ্যে কাজ করছে দেশী-বিদেশী প্রভাবশালী টেলিফোন কোম্পানিগুলোও। দৈনিক যুগান্তরে বিশেষ প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানিয়েছেন প্রতিবেদক মুজিব মাসুদ।
পত্রিকাটি বলছে, কোম্পানিগুলো এই মুহূর্তে ৭০০ মেগাহার্টজের তরঙ্গ বগলদাবা করতে না পারলে ৩/৪ বছর পর এর দাম ২০০ থেকে ৩০০ গুণ বেশি হয়ে যাবে। অনুসন্ধানে জানা যায়, সাবেক টেলিকমমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর তৈরি করা একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট ফোরজি তরঙ্গ নিলামের এই অবৈধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। সঙ্গে রয়েছে টেলিকম সেক্টরের কিছু ব্যবসায়ী, মন্ত্রণালয় ও বিটিআরসির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী। এজন্য বড় ধরনের বাজেটও তৈরি করেছে সিন্ডিকেট। জানা গেছে, মন্ত্রী না থাকলেও নেপথ্যে থেকে লতিফ সিদ্দিকী দ্রুততার সঙ্গে এই তরঙ্গ নিলামে ওঠানোর তোড়জোড় চালাচ্ছেন। এর আগে বিভিন্ন নিলাম এবং তরঙ্গ বণ্টন নিয়েও বড় ধরনের কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছিল। নামমাত্র নিলামে পাঁচ হাজার কোটি টাকার থ্রিজি তরঙ্গ ৪ মোবাইলফোন অপারেটরের কাছে বিক্রি করা হয়েছিল। তার আগে একটি কোম্পানিকে ফ্রি তরঙ্গ বরাদ্দ দেয়ায় সরকারের ১২০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। তারও আগে বিনামূল্যে মোবাইল ফোন অপারেটরদের টুজি তরঙ্গ ব্যবহারের সুযোগ দিয়ে সরকারের ৭ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়।
যুগান্তর কয়েকজন বিশেষজ্ঞর সাথে কথা বললে তারা জানান, বর্তমানে দেশে তরঙ্গসংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ লোকের খুবই অভাব। বিটিআরসিতে হাতেগোনা দু-একজন অভিজ্ঞ কর্মকর্তা থাকলেও মন্ত্রণালয়ে এর সংখ্যা প্রায় শূন্য। যার কারণে তরঙ্গ সেক্টর নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। মূলত সে কারণেই দেশে থ্রিজির বাজার তৈরির আগে ওই তরঙ্গ বিক্রি করা হয়েছিল নামমাত্র মূল্যে। যদি বাজার তৈরি করে ২/৩ বছর পর থ্রিজি তরঙ্গ বিক্রি করা যেত, তাহলে আরও ১ হাজার কোটি টাকার বেশি আয় করতে পারত সরকার। এরপরও সরকার কিংবা বিটিআরসি অতীত থেকে শিক্ষা নিচ্ছে না। এ কারণে ফোরজির বাজার তৈরির আগেই ৭০০ মেগাহার্টজের তরঙ্গ নিলামে বিক্রির তোড়জোড় শুরু হয়েছে। বিশেজ্ঞরা মনে করেন, ফোরজির তরঙ্গ নিলামে ওঠানোর আগে আইটিইউর (ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন) সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত। এছাড়া মূল্য নিয়েও আলোচনা করা উচিত। এমন মূল্য ঠিক করতে হবে যাতে প্রতি মেগাহার্টজ তরঙ্গের মূল্য কোনোভাবেই থ্রিজির চেয়ে কম না হয়। বরং থ্রিজির চেয়ে যাতে কয়েকগুণ বেশি হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, বিটিআরসি যা ইচ্ছা তা করছে। ফোরজির বাজার নিয়ে আলোচনা করতে গেলে অনেক বিষয় বিবেচনায় আনতে হবে। পূর্ববর্তী বিডব্লিউএ (ব্রডব্যান্ড ওয়ারলেস অ্যাকসেস) ও থ্রিজি নিলামের আগে নিলাম গাইডলাইন খসড়া করা হয়। এই গাইডলাইন করতে গিয়ে মার্কেটের বর্তমান অবস্থা, প্রবৃদ্ধি প্রবণতা, মূল্য, নিলাম পরবর্তী প্রভাব এবং গ্রাহক নিয়ে চুলচেরা গবেষণা করা হয়েছিল। কিন্তু ৭০০ মেগাহার্টজের তরঙ্গ নিলামের আগে কোনো গবেষণাই করা হয়নি। অথচ এই তরঙ্গ নিলামের প্রস্তুতি প্রায় শেষের পথে। এখন সরকারের শীর্ষ মহলের সবুজ সংকেত পেলেই তারা সরাসরি নিলামে যাবে। তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, নিলামের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নাটকীয়ভাবে টেলিকম মার্কেটে মারাত্মক ধস নামাতে পারে- যদি না সতর্কভাবে বিশ্লেষণ করা হয়। বাংলাদেশের মার্কেট পরিস্থিতি এমনিতেই ইউনিক এবং এই বিষয়গুলো নিলামের আগে ঠিক করা উচিত। তিনি বলেন, সরকার ৮০০, ৯০০ ও ১৮০০ মেগাহার্টজে থ্রিজি তরঙ্গ ব্যবহারের অনুমতি দিতে পারে, যদি সংশ্লিষ্ট অপারেটরগুলো রোল-আউটের বাধ্যবাধকতা পূরণ করে। কিন্তু এখনও অনেক অপারেটর তা করতে পারেনি।
পত্রিকাটির কাছে বিটিআরসির একজন কর্মকর্তা বলেন, দেশের বেশিরভাগ মানুষ গরিব এবং সাধারণ জীবনযাপন করে। তাদের এখনও থ্রিজি ব্যবহার করার জন্য বেশি দামি হ্যান্ডসেট ক্রয়ের ক্ষমতা হয়নি। যার কারণে থ্রিজি গ্রাহকের সংখ্যা বাড়ছে খুবই ধীর গতিতে। তাই অপারেটরদের উচিত এখনও টুজি তরঙ্গ রেখে দেয়া। অপারেটররা যদি তাদের টুজি তরঙ্গের পরিমাণ কমিয়ে ফেলে তাহলে ভয়েস কোয়ালিটি মারাত্মক খারাপ হবে। এটা অপারেটরদের জন্য লাভজনক হলে জনগণও সেবা থেকে বঞ্চিত হবেন। তিনি বলেন, থ্রিজি গাইডলাইন অনুসারে সব বিডার সর্বোচ্চ তিনটি ব্লক ক্রয়ের কথা ছিল। কিন্তু গ্রামীণফোন ২টি ব্লক নিয়েছে, বাকি সব অপারেটর একটি করে ব্লক কিনেছে। অথচ এখন তারা নিলামের এক বছরের মাথায় নতুন পরিকল্পনা নিয়ে এসেছে তাদের ফোরজি লাগবে। মূল কথা হচ্ছে, বাজারে যাতে অন্য কোনো অপারেটর আসতে না পারে, সেজন্য এই সিন্ডিকেট দ্রুত ও গোপনে এই ফোরজি তরঙ্গ নিলামে কিনে নিতে চাচ্ছে। তবে বিটিআরসি বলছে, এই মুহূর্তে ৭০০ মেগাহার্টজ পুরোপুরি নিলামের জন্য পাওয়া যাবে না। কারণ প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি এই তরঙ্গ বিভিন্ন অপারেটর দখল করে রেখেছে। মামলা-মোকাদ্দমা করে এই তরঙ্গ তারা দিচ্ছে না। যার কারণে বিটিআরসি চাচ্ছে সরকারের সহযোগিতা নিয়ে আইনের মাধ্যমে ওই তরঙ্গ দখলে নিতে। একই সঙ্গে যেসব অপারেটর ঢাকাতে অপারেট করে এবং যাদের গ্রাহক ১০ হাজারের কম তাদের কাছ থেকেও ৭০০ মেগাহার্টজের তরঙ্গ ফিরিয়ে নিতে চাচ্ছে বিটিআরসি।
এ ব্যাপারে টেলিফোনে এবং কার্যালয়ে গিয়েও বিটিআরসি চেয়ারম্যান সুনিল কান্তি বোসের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। বিটিআরসির ভাইস চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসান হাবিব খানের মোবাইলে ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে পরিচালক স্পেকট্রাম লে. কর্নেল জোবায়ের বলেন, বর্তমানে ৭০০ মেগাহার্টজের অনেক তরঙ্গ খালি নেই। অনেকে মামলা করে দখল করে রেখেছে। আগে এসব তরঙ্গ সরকারের দখলে আনতে হবে। তারপরই বিটিআরসি নতুন করে সিদ্ধান্ত নেবে। তিনি বলেন, যেহেতু ৭০০ মেগহার্টজের তরঙ্গ দিয়ে কম খরচে বেশি গ্রাহককে সেবা দেয়া সম্ভব তাই এই তরঙ্গের চাহিদা বেশি। এটি মূল্যবান তরঙ্গও বটে।
আইজিডব্লিউ ব্যবসা দখলেও সিন্ডিকেট :
এদিকে বিটিআরসির একাধিক কর্মকর্তা ও আইজিডব্লিউ ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকারি দলের কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা মিলে তাদের তৈরি করা একটি সিন্ডিকেট এই ব্যবসাকে নিজদের দখলে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এজন্য লাইসেন্স নীতিমালা অনুযায়ী, আইজিডব্লিউগুলো একই লাইসেন্সের আওতায় থাকার কথা থাকলেও দুটি অসম স্তরে ভাগ করা হচ্ছে- টিয়ার-১ (১৬টি) ও টিয়ার-২ (৭টি)। গত ২৮ সেপ্টেম্বর বিটিআরসি তাড়াহুড়া করে টিয়ার-২ এর (আইওএস সুইচ পরিচালনাকারী) সাতটি আইজিডব্লিউর নাম চূড়ান্ত করে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। ওই সাতটি প্রতিষ্ঠান হল- ইউনিক ইনফোওয়ে, ডিজিকন টেলিকমিউনিকেশন্স, রুটস কমিউনিকেশন্স, গ্লোবাল ভয়েস, মীর টেলিকম, বাংলা ট্র্যাক ও নভো টেলিকম। এই সাত আইজিডব্লিউর মধ্যে মীর টেলিকম, নভো টেলিকম ও বাংলা ট্র্যাক পুরনো প্রতিষ্ঠান।
বিটিআরসি লিগ্যাল অ্যান্ড লাইসেন্সিং বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, ইউনিক ইনফোওয়ে মালিকানায় রয়েছেন বিএনপি নেতা জিএম সিরাজের স্ত্রী শাহনাজ সিরাজ। জানা গেছে, ২০১২ সালে ডিজিকন টেলিকমিউনিকেশন্স সরকারের একজন শীর্ষ নেতার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের সুপারিশে লাইসেন্স পায়। বিটিআরসির রাজস্ব না দেয়ায় ২০১৩ সালের জুলাই মাসে এ প্রতিষ্ঠানটিকে ব্লকও করা হয়েছিল। রুটস কমিউনিকেশন্স প্রতিষ্ঠানের অর্ধেক মালিকানায় রয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের একজন প্রভাবশালী সম্পাদকের স্ত্রী। গ্লোবাল ভয়েসের মালিকানায় রয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ওই চিঠিতে দেখা গেছে, মোট ২৩টি আইজিডব্লিউর মধ্যে ১৮টিকে এই সংগঠনের আওতায় নেয়া হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক আইজিডব্লিউ ব্যবসায়ী বলছেন, অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনেকটা চাপ সৃষ্টি করেই তাদের এ পরিকল্পনায় নিয়ে আসা হয়েছে। বিটিআরসি থেকে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, ২৩টি আইজিডব্লিউ অপারেটরদের মধ্যে থেকে শেষ ছয় মাস (মার্চ-আগস্ট) সর্বাধিক কল টার্মিনেশন, শেষ ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) সর্বাধিক রাজস্ব আনা, বকেয়া পরিমাণ বিবেচনাসহ কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করে ওই সাত প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচিত করা হয়েছে।
যুগান্তরের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, এই পরিকল্পনা বাস্তাবায়নে সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের এক ব্যবসায়ী নেতা মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার সাক্ষাৎ করেন বলে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান। বিটিআরসিতে কয়েক দফা বৈঠকও চলে কয়েক মাস ধরে। শেষ পর্যন্ত চাপ সৃষ্টি করে ফোরামে নিয়ে আসা হয় ১৮টি প্রতিষ্ঠানকে। জানা গেছে, পরিকল্পনা মডেল অনুযায়ী বৈদেশিক কল আদান-প্রদানের সব লেনদেন হবে টিয়ার-২ এর একটি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে। অন্য অপারেটর কল আদান-প্রদানের সব অর্থ হস্তান্তর করবে টিয়ার-২ এর মাধ্যমে। পরে টিয়ার-২ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের (বিটিআরসি, আইসিএক্স ও এএনএস) কাছে রাজস্ব হস্তান্তর করবে। পরিকল্পনায় টিয়ার-১ ও টিয়ার-২ এর লভ্যাংশ ভাগাভাগির হার ধরা হয়েছে ১:১.৯০। একই ব্যবসা হলেও টিয়ার-২ এর প্রায় দ্বিগুণ আর্থিক লাভ করার সুযোগ থাকছে। অর্থাৎ, টিয়ার-১ যদি পায় এক টাকা, তাহলে টিয়ার-২ পাবে এক টাকা ৯০ পয়সা। বর্তমানে প্রতি মাসে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার বৈদেশিক কল আদান-প্রদান হয়ে থাকে। বর্তমান অবস্থায় এ টাকার পুরোটাই চলে যাবে টিয়ার-২ এর নিয়ন্ত্রণে। অপারেটররা মনে করছেন, টিয়ার-২ দ্বিগুণ রাজস্ব পাওয়ায় তারা ডিসকাউন্টে কল আনবে, ইচ্ছা করলেই তারা কম দামে কল আনতে পারবে। এর ফলে সাত অপারেটর বাদে অন্য সবার ব্যবসা গুটিয়ে নেয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। সিন্ডিকেটের বাইরে থাকা একজন ব্যবসায়ী জানান, ১৫ কোটি টাকা দিয়ে এই লাইসেন্স নিয়েছি। সব মিলিয়ে বছরে ৪ কোটি ২৩ লাখ টাকা লাইসেন্স ফি দিতে হচ্ছে। একই হারে লাইসেন্স ফি ও রাজস্ব দিতে হলে কেন এ বৈষম্য করা হবে। বাজারে কোনো প্রতিযোগিতা থাকবে না।
দৈনিক যুগান্তরের সৌজন্যে।