সুরক্ষিত সীমান্তপথ : তবু আসছে অস্ত্র-গুলি-বিস্ফোরক
প্রকাশিত হয়েছে : ১০:১২:২৪,অপরাহ্ন ১০ নভেম্বর ২০১৪
শরীফ আহমেদ: সিলেট বিভাগের চার জেলার বিভিন্ন এলাকা দিয়ে ১০ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে আগ্নেয়াস্ত্র গুলি ও বিস্ফোরকদ্রব্য ঢুকছে বাংলাদেশে। কিছু প্রভাববশালীদের নেতৃত্বে এসব অস্ত্র মজুদ করছে বলে একাধিক সূত্রে জানায়।
গোপন সূত্রে জানা যায়, সিলেট বিভাগের চার জেলার ১৫টি সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারত থেকে আগ্নেয়াস্ত্র এনে তা সারাদেশে সরবরাহ করছে ১০ সিন্ডিকেট। সিলেটের গোয়াইনঘাটের সোনারহাট, রাধানগর, লালাখালের উৎসমুখ, জাফলংয়ের বল্লাঘাট, তামাবিল, কোম্পানিগঞ্জের ভোলাগঞ্জ, সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার বাঁশতলা, ছাতকের বনগাঁও, তাহিরপুরে টেকেরঘাট, মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী উপজেলার লাঠিটিলা, ফুলতলা বিরইনতলা, কুলাউড়ার উপজেলার শরীফপুর, চাতলাপুর ও হবিগঞ্জে আরও দু’টি সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে আগ্নেয়াস্ত্র ও বোমা তৈরির নানা উপকরণ বাংলাদেশে এসে থাকে। ভারত থেকে আসা অস্ত্রগুলোর মধ্যে পিস্তল, শর্টগান, গুলি এবং বিস্ফোরক দ্রব্যের মধ্যে গন্ধক, সালফার, সোডিয়াম ক্লোরাইড ও ডেটিনেটর। সীমান্তে অস্ত্র সুরক্ষিত সীমান্তপথ, তবু আসছে অস্ত্র-গুলি-বিস্ফোরক
সূত্রে আরও জানা যায়, সুনামগঞ্জের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে আসা অস্ত্রগুলো রেল ও নৌপথে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার হয়ে থাকে। ছাতক থেকে লোকাল ট্রেনে অস্ত্রগুলো প্রথমে সিলেট ও পরে সেখান থেকে ট্রেনে করে বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়। অস্ত্র পরিবহনের ক্ষেত্রে নিম্ন আয়ের নারী ও শিশুদের ব্যবহার করা হয়। এছাড়া ছাতক থেকে পাথর বোঝাই কার্গোতেও বিভিন্ন স্থানে অস্ত্র পাচার হচ্ছে। সিলেটের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে আসা অস্ত্রগুলো পাথর ও কয়লাবোঝাই ট্রাকে করে পাচার হয়ে থাকে।
সম্প্রতি মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে আসছে অবৈধ অস্ত্র ও মাদকদ্রব্য। সেই সঙ্গে বেড়েছে অবৈধ অনুপ্রবেশের ঘটনা।
মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার ফুলতলা রাঘনা, বটুলী ইমিগ্রেশন ,বিরইনতলা, রাজকী,মোকামবাড়ী, বড়ইতলী, গোয়ালবাড়ীসহ সীমান্ত এলাকা দিয়ে সম্প্রতি অবৈধ অনুপ্রবেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে ভারত থেকে বিভিন্ন প্রকার নেশাজাতীয় দ্রব্য বাংলাদেশে অবাধে ঢুকছে। কিছুদিন আগে বিজিবির ৪১ ব্যাটালিয়ান সদস্যরা প্রায় ২ লাখ টাকার কাপড় ও ১৫০ পিস ইয়াবাসহ কিছু তালিকাভূক্ত মাদক স¤্রাটকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এদিকে, মৌলভীবাজারের জড়ী উপজেলার ফুলতলা পুরো ইউনিয়ন সীমান্তবর্তী হওয়ায় ভারতীয় অপরাধীরা বাংলাদেশের পাহাড়গুলোতে আশ্রয় নেয়। পরে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করে এবং তাদের নিয়োগ চোরাকারবারীদের মাধ্যমে বোমা, অস্ত্র, ফেনসিডিল, গাঁজা, ইয়াবা, হুইসকিসহ বিভিন্ন অবৈধ মালামাল ভারত থেকে এনে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার করছে।
ফুলতলা ইউনিয়নের বিশিষ্ট সমাজসেবক জাহাঙ্গীর আহমদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এসব ব্যবসায় জড়িত বড় অপরাধীদের সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনের বড় কর্তাদের হাত রয়েছে। তাই প্রতি মাসে বড় অপরাধীরা সিন্ডিকেট নেতার কাছ থেকে একটি ভাগ পেয়ে তার নিশ্চুপ থাকেন।’
বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে আসা অস্ত্রসহ পাচারকারীদের চলতি মাসে অবৈধ মালামালসহ আটক করেছে র্যাব, পুলিশ, বিজিবির সহযোগিতায়। তবে অবৈধভাবে যেগুলো আসে তা স্থানীয়ভাবে ব্যবহৃত হয় এবং হবিগঞ্জ দিয়ে আসা অস্ত্রগুলো ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে বিভিন্ন স্থানে চলে যায়। সিলেট সীমান্ত দিয়ে অহরহ অস্ত্র আসলেও র্যাব, পুলিশ ও বিজিবির অভিযানে মাঝে মধ্যে কিছু অস্ত্র উদ্ধার হলেও মূল হোতারা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। গত জুন মাসেই গোয়াইনঘাট উপজেলার সোনারহাট সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে আসা ১০টি আগ্নেয়াস্ত্রের একটি চালান আটক করে পুলিশ। এ সময় সাহাব উদ্দিন ও আবদুর রাজ্জাক নামে দুই ব্যক্তিকে আটক করা হয়। এরমধ্যে সাহাব উদ্দিন ২০০৯ সালে আরেকবার অস্ত্রসহ র্যাবের হাতে আটক হয়েছিল।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পূর্বে মহানগর পুলিশ ও র্যাবের বিশেষ অভিযানে অন্তত ৩০টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়েছিল।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ৫২ ব্যাটালিয়নের সীমান্তবর্তী ফুলতলা ক্যাম্পের নায়েক সুবেদার হাবিবুর রহমান সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, বিজিবির ফোর্স কম থাকায় অনেক সময় অস্ত্রধারী মাদক ব্যবসায়ীদের ধরতে তাদের হিমশিম খেতে হয়। সেক্ষেত্রে স্থানীয় থানার পুলিশের সহযোগিতা নিতে হয় বলে তিনি জানান।
এ ব্যাপারে বিজিবির মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল ৫২ ব্যাটেলিয়ান সদর দপ্তরের দায়িত্বপাপ্ত কর্মকর্তা লে.কর্নেল সরদার মোহাম্মদ রেজাউল হক মুঠোফোনে সম্প্রতি বিভিন্ন সীমান্তে অবৈধ অস্ত্রসহ গ্রেপ্তারের সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, অবৈধ অনুপ্রবেশ এবং বিভিন্ন প্রকারের মালামাল ভারত থেকে বাংলাদেশে অবৈধভাবে যাতায়াত বন্ধের জন্য কড়া নিরাপত্তা অব্যাহত আছে। এসব অপরাধীদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করার জন্য প্রতিটি বিজিবি ক্যাম্পের কোম্পানি কামান্ডারদের নির্দেশ দিয়েছেন।
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে মুঠোফোনে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। সীমান্তের কোনো খবর তার কাছে নেই। তিনি এ ব্যাপারে পুলিশ সুপারের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
সিলেট সীমান্ত দিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র আসা প্রসঙ্গে সিলেটের পুলিশ সুপার নূরে আলম মিনা (পিপিএম) জানান, সিলেটের কোন কোন সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র আসে। এর কোনো তালিকা নেই পুলিশের কাছে। তবে পুলিশ মাঝে মধ্যে অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন উপজেলা থেকে অস্ত্র উদ্ধার ও অস্ত্র ব্যবসায়ীদের আটক করে।
আগ্নেয়াস্ত্রের প্রবেশ ঠেকাতে সীমান্ত এলাকায় পুলিশের বাড়তি নজরদারি রয়েছে বলে জানান। এ ব্যাপারে বিজিবির পাশাপাশি পুলিশ সর্তক রয়েছে।