সুনামগঞ্জে বজ্রপাত আতঙ্ক : গত দেড় মাসে ২৫ জনের মৃত্যু
প্রকাশিত হয়েছে : ১১:৫৯:০৭,অপরাহ্ন ১১ মে ২০১৫
নিউজ ডেস্ক :: হাওর এলাকা সুনামগঞ্জ। গত দেড় মাসে বজ্রপাতে মৃত্যু ঘটেছে প্রায় ২৫ জনের। নিহতদের অধিকাংশই কৃষক। হাওরে ধান কাটা অথবা অন্য কাজে থাকার সময় আকশ্মিক বজ্রপাতেই তাদের মৃত্যু ঘটে। এছাড়াও বজ্রপাতে আহত হয়েছেন অনন্ত ৩০জন। । তাই দিনদিন আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন সুনামগঞ্জের মানুষ।
সুনামগঞ্জের হাওরে এখন বোরো ধান কাটার ভরা মৌসুম চলছে। এমনিতেই শ্রমিক সংকটের কারণে এবার খেতের পাক ধান নিয়ে সমস্যা আছেন কৃষকেরা। তার ওপর বজ্রপাতের আতঙ্ক এখন পেয়ে বসেছে তাঁদের। আকাশে মেঘ দেখলেই হাওরে ধান কাটা-মাড়াই বন্ধ করে দিয়ে বাড়িতে চলে আসছেন কৃষক-শ্রমিকেরা। হাওরপাড়ের কৃষকেরা বলছেন, এর আগে সুনামগঞ্জের হাওর এলাকায় বৈশাখী ধান তোলার সময় বজ্রপাতে এত লোক মারা যায়নি। যে কারণে সবার মাঝে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। আকাশে মেঘ দেখলেই বজ্রপাতের ভয় মনে উঁকি দেয়। বজ্রপাতের আতঙ্কে জেলার বাইরে থেকে আসা ধান কাটা শ্রমিকদের মধ্যে অনেকেই চলে গেছেন। তাই বাধ্য হয়েই হাওরে ফসল তোলার কাজটি ঝুঁকি নিয়ে করতে হচ্ছে তাঁদের। পুলিশ, প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ২৮ মার্চ থেকে ৯মে পর্যন্ত সুনামগঞ্জে বজ্রপাতে ২৫জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে এক নারীও আছেন। তিনি বাড়ির পাশে ধান তোলার কাজে থাকার সময় বজ্রপাতে মারা যান। অন্যদের প্রায় সবাই কৃষক। কেউ হাওরে ধান কাটার সময়, কেউ হাওর থেকে বাড়ি ফেরার পথে আবার কেউ ধান মাড়াইয়ের কাজে থাকার সময় বজ্রপাতে মারা যান। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে দিরাই উপজেলায়। এই উপজেলায় মারা গেছেন সাতজন। এ ছাড়া তাহিরপুর উপজেলায় ছয়জন, ধরমপাশা উপজেলায় চারজন, সদর উপজেলায় দুইজন, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলায় দুইজন, জামালগঞ্জ উপজেলায় দুইজন, শাল্লা ও ছাতক উপজেলায় একজন করে মারা গেছেন। ওই সময়ে বজ্রপাতে আহত হয়েছেন আরও ৩০জন।
গত ৯ মে বজ্রপাতে ধরমপাশা ও তাহিরপুর উপজেলায় দুইজনের মৃত্যু হয়। ৭ মে ধরমপাশা উপজেলায় একজন এবং তাহিরপুর উপজেলায় একজন মারা যান। ২ মে শনিবার বজ্রপাতে মারা যান পাঁচজন। এর মধ্যে দিরাই উপজেলায় তিনজন, ধরমপাশা উপজেলায় একজন এবং তাহিরপুর উপজেলায় একজন। এর আগে ২১এপ্রিল বজ্রপাতে মারা যান সদর উপজেলার মুহাম্মদপুর এলাকার একজন এবং দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার জয়কলস ইউনিয়নের আস্তমা গ্রামে একজন। ১৮এপ্রিল হাওরে ধান কাটার সময় বজ্রপাতে মৃত্যু হয় সদর উপজেলার পাঠানবাড়ি এলাকার এক কৃষকের।
১৭এপ্রিল বজ্রপাতে মারা যান আরও ছয়জন। এর মধ্যে দিরাই উপজেলায় চারজন, জামালগঞ্জ উপজেলায় একজন এবং দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলায় একজন। ৫এপ্রিল বজ্রপাতে মারা গেছেন ছাতক উপজেলায় একজন ও তাহিরপুর উপজেলায় একজন। ৪ এপ্রিল শাল্লা উপজেলা একজন এবং ১ এপ্রিল জামালগঞ্জ ও তাহিরপুর উপজেলায় আরও দুই কৃষক মারা যান বজ্রপাতে। গত ২৯ মার্চ ধরমপাশা উপজেলার একজন এবং এর আগের দিন ২৮ মার্চ তাহিরপুর উপজেলায় মারা যান দুইজন।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার মোল্লাপাড়া ইউনিয়নের ইছাগড়ি গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আরব আলী বলেন, বৈশাখ মাসে বজ্রপাতে সুনামগঞ্জের হাওরে প্রতি বছরই দু-চারজন লোক মারা যান। কিন্তু এবারের মত বজ্রপাতে এত লোকের মৃত্যু আগে কখনো হয়নি। কৃষকেরা ভয়ে আছেন। হাওরে পাকা নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। বাধ্য হয়েই মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে লোকজন হাওরে ধান কাটা-মাড়াইয়ের কাজ করছেন। কারণ হাওরের কৃষকদের সব কিছুই এই বোরো ধানের ওপর নির্ভরশীল।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, যারা বজ্রপাতের মারা গেছেন তাঁদের প্রত্যেকের পরিবারকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক ১৫ হাজার টাকা করে অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন,‘এবার সুনামগঞ্জে আগাম বৃষ্টি হওয়ার কারণে বজ্রপাতও বেশি হচ্ছে বলে লোকজন বলছেন। তবে হাওর এলাকায় বজ্রপাতে প্রাণহানির এই বিষয়টির বিজ্ঞানসম্মত কোনো ব্যাখা আছে কি-না সেটি খতিয়ে দেখা দরকার।’
আবহাওয়া অধিদপ্তর সিলেটের আবহাওয়াবিদ সাইদ আহমদ চৌধুরী জানান, সুনামগঞ্জে ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে বজ্রপাত একটু বেশি হয়। কারণ সুনামগঞ্জ নিচু এলাকা, আর এর উত্তরে পাহাড়। এটাও একটা কারণ। এখানে মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত বজ্রপাত হয়। তিনি বলেন, বজ্রপাতের আগে আমরা যখন আলোর ঝলকানি দেখি তখনই কেউ হাওরে থাকলে সে স্থানে বসে পড়া, নৌকা থাকলে নৌকার মাঝখানে অবস্থান নিতে হবে। অথবা তাঁর উচ্চতা থেকে আর কিছু উঁচু স্থাপনার নিচে আবস্থান নেওয়া যেতে পারে। তবে কোনোভাবেই গাছের চিনে অবস্থান নেওয়া কিংবা মাটিতে শোয়া যাবে না। সচেতন হলে হয়ত কিছু প্রাণহানি এড়ানো সম্ভব।
সুনামগঞ্জের কৃতি সন্তান তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মরতুজা আহমদ গত শনিবার সুনামগঞ্জে সাংবাদিকদের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, আমি বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলব। কী কারণে এখন হাওরে বজ্রপাতে এত লোকের প্রাণহানি ঘটছে সেটি নিয়ে গবেষণা করা দরকার। এ বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে হবে। কীভাবে বজ্রপাতে প্রাণহানি এড়ানো যায় এর উপায় খোঁজে বের করতে হবে।