সিসিটিভি নট ইন অ্যাকশন!
প্রকাশিত হয়েছে : ১০:৪৫:৫৮,অপরাহ্ন ০৩ মার্চ ২০১৯
হাসান মো.শামীম
গত রবিবার নগরীর দর্শন দেউড়ি হাউজিং এস্টেট এলাকার প্রবেশপথে খুন হয় স্কুল ছাত্র সাহেদ। প্রকাশ্য জনালোকে কিছু তরুণ তাকে দা দিয়ে এলোপাথারি কুপিয়ে জখম করে। হাসপাতালে নেবার পথেই তার মৃত্যু হয়। সাহেদের অকাল মৃত্যুর পর অপরাধীদের সনাক্ত করতে প্রয়োজন হয় সিসিটিভি ফুটেজের।
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের চার নং ওয়ার্ডে এই হত্যাকান্ড সংঘটিত হওয়ায় খোজ পরে কাউন্সিলর রেজাউল হাসান কয়েস লোদির। তার ব্যক্তিগত উদ্যোগে লাগানো ১৪ টি সিসি ক্যামেরা আছে চার নং ওয়ার্ডের একাংশে। এমনকি যেখানে শাহেদকে হত্যা করা হয় তার ২০ ফুট দুরত্বেও ছিল ওই ১৪ টি ক্যামেরার একটি সিসি ক্যামেরা। হত্যাকারীদের চিহিত করতে ওই ক্যামেরার ফুটেজ হতে পারত গুরুত্বপুর্ন আলামত। কিন্তু সাহেদের স্বজনরা যখন সিসিটিভি রেকর্ড দেখতে চান তখন কাউন্সিলর অফিস থেকে জানানো হয় ঘটনার সময় বন্ধ ছিল সিসি ক্যামেরা!
এতে যারপরনাই ক্ষুব্দ ও হতাশ হোন নিহত সাহেদের স্বজনরা। তারা হাহাকার নিয়ে বলেন, এই হাউজিং এস্টেটে বিপুল টাকা খরচ করে আলপনা আকা হয়,অর্ধশত বছর পুর্তিতে বিশাল অনুষ্ঠান হয়,কিন্তু একটা খুনের সময় গুরুত্বপুর্ন সিসিটিভি বন্ধ করে রাখা হলো কেন? কার স্বার্থে, কাদের বাচানোর উদ্দ্যেশে।
এ ব্যাপারে খোজ নিয়ে জানা গেছে, সরেজমিন চার নং ওয়ার্ডে এখানে লাগানো ১৪ টি ক্যামেরার মধ্যে ১২ টি ক্যামেরাই নষ্ট! হত্যাকান্ডের সময় বন্ধ নয়, আদতে নষ্ট হয়েই আছে সিসি ক্যামেরা। অথচ সারা এলাকা জুড়ে লেখা আছে ‘সিসিটিভি ইন একশান’। আসলে ‘সিসিটিভি নট ইন একশান’ লেখা হলেই মানাতো বেশি। তবে ভেতরের খবর না জানায় সারা এলাকা সিসি ক্যামেরার আওতাধীন আছে জেনে যারা তৃপ্তির ঢেকুর তুলছিলেন তারা এখন আতংকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই এলাকার একজন প্রবীন বলেন ‘আমরা তো জানি পুরো ওয়ার্ড সিসি ক্যামেরার আওতাধীন, সে কারনে বেশ রিল্যাক্স থাকি কারন অপরাধীরা ক্যামেরা দেখলে ক্রাইম করতে পিছপা হয়। কিন্তু এই সিসি যদি কাজ না করে তাহলে সেটা তো ভয়ংকর ব্যাপার। কারন মানুষ তো জানে তারা নিরাপদ, আদতে তা নয়’।
নিহত সাহেদের মা বলেন ‘সিসি ক্যামেরা আছে জেনেও কিভাবে সন্ত্রাসী বাহিনী এত খোলাখূলিভাবে আমার ছেলেকে দেশিয় অস্ত্র দিয়ে আঘাত করতে পারল। এমনকি তাদের মাথায় হেলমেট পর্যন্ত ছিলো না। নিজেদের লুকানোর কোন চেষ্টাই তারা করেনি। এরপর ফুটেজ নিতে গিয়ে জানলাম তা বন্ধ ছিল। এই ঘটনা কি ইঙ্গিত বহন করে। মানুষের নিরাপত্তা রক্ষায় যে জিনিশ লাগানো হয়েছে তার সুবিধা যদি অপরাধিরা পায় তাহলে এর দায় কে নেবে? আমি তো আমার সন্তান ফিরে পাবোনা’!
নগরীতে ২০১৬ সালে পরীক্ষামুলক ভাবে তিনটি ওয়ার্ডে সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়। ২৭ টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৬,১৫ ও ১৯ নং ওয়ার্ডে লাগানো হয় ৮৮ টি ক্যামেরা। সর্বোচ্চ ৩৬ টি ক্যামেরা ছিল ৬ নং ওয়ার্ডে। এছাড়া নগরীর কিছু গুরুত্বপুর্ন রাস্তায়ও লাগানো হয় সিসি ক্যামেরা। সিলেট মহানগরীর তালতলা পয়েন্ট থেকে শুরু হয়ে সুরমা মার্কেট পয়েন্ট-সিটি পয়েন্ট হয়ে জিন্দাবাজার পর্যন্ত এই সিসি ক্যামেরার আওতায় নিয়ে আসা হয়। অন্যদিকে আরেকটি অংশে সিটি পয়েন্ট থেকে বন্দরবাজার হয়ে সোবহানীঘাট পয়েন্ট এবং এরপর সোবহানীঘাট থেকে নাইওরপুল পয়েন্ট সিসি ক্যামেরার আওতায় আসে। সিটি কর্পোরেশনের প্রকল্পের আওতায় ১৮ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই সিসি ক্যামেরাগুলোর মনিটর আছে কোতয়ালী মডেল থানায়।
সিলেট কোতয়ালী মডেল থানার ওসি সোহেল আহমদ এই কাজ বাস্তবায়ন করতে এগিয়ে আসায় সিলেট সিটি কর্পোরেশনকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, আইনশৃংখলা রক্ষার কাজে এই সিসি ক্যামেরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। শুধু অপরাধী সনাক্ত করাই নয়, এই সিসি ক্যামেরা নগরীর যানজট পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং সেই অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতেও সহায়তা করবে। কিছুদিন আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সিলেট এক আসনের সংসদ সদস্য ড. একে মোমেন হাউজিং এস্টেট এলাকার পঞ্চাশ বছর পুর্তি অনুষ্ঠানে জানান সিলেট নগরের নিরাপত্তায় পর্যায়ক্রমে দেড় হাজার সিসি ক্যামেরা বসানো হবে। অথচ সেই মুহুর্তে ওই এলাকার প্রায় সব সিসি ক্যামেরাই ছিল নষ্ট।
কিছুদিন আগে ভুলে একটি সিনজিতে ল্যাপটপ থেকে যায় ৪ নং ওয়ার্ডে বসবাসরত স্থানীয় এক সংবাদকর্মীর। পরে সিসিটিভির মাধ্যমে সিএনজির খোজ পেতে তিনি ওই ওয়ার্ড অফিসে যান। সেখানে গিয়ে দেখতে পান মনিটরটি কাউন্সিলরের পুরাতন অফিসে রাখা। এরপর সেখানে গিয়ে চেষ্টা চালানো হয় ফুটেজ উদ্ধারের। স্থানীয় ওয়ার্ড সচিব উপস্থিত না থাকায় ফুটেজ উদ্ধারে পাঠানো হয়েছিল ওয়ার্ডের চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারীকে! তিনি অপারেট করতে ব্যর্থ হলে ঢেকে পাঠানো হয় ওয়ার্ডের ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রিকে। তবে শেষ পর্যায়ে তাদের কেউই আর ফুটেজ উদ্ধারে সমর্থন হননি। বিরক্ত হয়ে ওই সংবাদকর্মী একজন বিশেষজ্ঞকে খবর দিয়ে এনে ফুটেজ উদ্ধারের চেষ্টা চালান! তবে ক্যামেরার দুর্বল রেজুলেশনের কারনে আর সিএনজি নাম্বার উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে এই হচ্ছে সিসিটিভি কার্যক্রমের চালচিত্র।
এ ব্যাপারে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) মো. রুহুল আলম বলেন ‘এখনো পর্যন্ত নগরীর তিনটি ওয়ার্ডে ও কিছু গুরুত্বপুর্ন রাস্তায় সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। অচিরেই আরো ১২ টি ওয়ার্ডে সিসি ক্যামেরা লাগানো হবে। এ ব্যাপারে টেন্ডারও হয়ে গেছে।’ আগামী মাস থেকেই এর কাজ শুরু হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তবে সিসি লাগানো হলে এর মনিটরিং প্রক্রিয়া কি রকম হবে এ সম্পর্কে তিনি বলেন ‘ওয়ার্ড অফিসে এই সিসি ক্যামেরাগুলোর মনিটর থাকবে।
সেখানে রেকর্ড করা ফুটেজ চাইলে পাওয়া যাবে। তবে এ ব্যাপারে আলাদা করে কোন লোকবল নিয়োগ হবেনা ,ওয়ার্ড অফিসে কমর্রত কর্মচারীরাই এর দেখভাল করবেন। তবে তাদের এই বিশেষ ব্যাপারে ট্রেইন আপ করা হবে কিনা তা নিশ্চিত করে বলতে পারেননি তিনি। মো. রুহুল আলম ‘বলেন বিষয়টি নতুন এ ব্যাপারে অভিজ্ঞ হতে সবাইকে একটু সময় দিতে হবে’।
সাহেদ হত্যার দুদিন পরেই এই ঘটনায় সাত আসামীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। হাউজিং এস্টেটের মুখে অবস্থিত আর্কেডিয়া বিল্ডিং এর সিসি ক্যামেরা থেকে সংগ্রহ করা হয় এই ঘটনার গুরুত্বপুর্ন ফুটেজ। তবে মার্কেটের নিজস্ব মালিকানাধীন এই সিসি ক্যামেরার ছবিও ছিল দুর্বল। ক্যামেরার বেশিরভাগ অংশ জুড়ে ছিল ছাদের বর্ধিত অংশ আর সামনে লাগানো পতাকা। অথচ নিরাপত্তা রক্ষায় এসব ক্যামেরার অবস্থান হওয়া উচিত আরো স্পষ্ট।তবে এসব ব্যপারে কথা বলার জন্য কাউন্সিলর রেজাউল হাসান কয়েস লোদির মুঠোফোনে কল করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেন নি।