যুক্তরাজ্য সংসদ নির্বাচনের হাওয়া এখন সিলেটেও : বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ১১জনের মধ্যে ৮জনই সিলেটী
প্রকাশিত হয়েছে : ৮:১৬:১৪,অপরাহ্ন ০৯ এপ্রিল ২০১৫
বাসিত আলম::
যুক্তরাজ্য সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র ২৮দিন বাকী। আগামী ৭ মে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ তথা বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে বিপুল সংখ্যক মানুষ যুক্তরাজ্যে বসবাসের কারণে এ নির্বাচনের হাওয়া এখন সিলেটে বইছে। যুক্তরাজ্যের সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ১১ প্রার্থী এমপি পদের জন্য লড়াই করছেন। এর মধ্যে ৮জনই সিলেটী। দেশটির প্রধান তিন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে তারা মনোনয়ন পেয়েছেন। এর মধ্যে লেবার দল থেকে সাতজন, লিবারেল ডেমোক্রেট দল থেকে তিনজন এবং কনজারভেটিভ দল থেকে একজন মনোনয়ন পেয়েছেন।
যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী এই ১১ প্রার্থীর মধ্যে পাঁচজন নারী এবং ছয়জন পুরুষ। ২০১০ সালে রুশনারা আলী এমপি নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে ব্রিটিশ মূলধারার রাজনীতিতে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতদের অভিষেক হয়েছিল। নির্বাচনে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ১১ প্রার্থীর মধ্যে ৮ জনই সিলেটী। সিলেটে অবস্থানরত বৃটেন প্রবাসীদের বাড়িতে ভোট চাওয়ার প্রচারণায় ব্যস্ত প্রার্থীদের আত্মীয়-স্বজনরা।
আর এই নির্বাচনকে ঘিরে সিলেটীদের মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনা লক্ষ করার মতো। নির্বাচনটি গুরুত্বসহকারে প্রচার করছে দেশের গণমাধ্যম গুলো। আবার বাংলাদেশ থেকে গণমাধ্যম কর্মীসহ সাধারণ জনগণও এই নির্বাচনের ব্যাপারে রয়েছে ব্যাপক আগ্রহ ও কৌতুহল । গত কয়েক মাস আগে কনজারভেটিভ পার্টির প্রার্থী মিনা রহমান সিলেটে এসে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যান। এরকম আরো কয়েকজন প্রার্থীও সিলেটে এসে নির্বাচনের প্রচারণা চালিয়েছেন । ২০১০ সালের নির্বাচনের আগে লেবার পার্টির প্রার্থী রোশনারা আলী সিলেটে এসে দীর্ঘ সময় নির্বাচনী প্রচারণা চালান। ফলশ্রুতিতে তিনি প্রথম বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত হিসেবে বৃটিশ পার্লামেন্টে অভিষিক্ত হন। সেই ধারাবাহিকতায় এবারও সিলেটে এসে প্রচারণা চালান অনেকে। এমনকি এসব প্রার্থীদের পক্ষ হয়ে সিলেটে প্রচারণা করতে দেখা গেছে অনেক জন প্রতিনিধিসহ রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গকেও।
যুক্তরাজ্যের বার্মিংহামে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত বৃটিশ-বাংলাদেশী বিজনেস এওয়ার্ড প্রদান অনুষ্ঠানে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন
ঘোষণা করেন আগামী দিনে বৃটিশ বাংলাদেশীদের মধ্য থেকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হবেন। তিনি আরো বলেন, বৃটেনের অর্থনীতিতে অবদান বাড়ছে
বাংলাদেশী কমিউনিটির। সেই সাথে দেশটির মূলধারার রাজনীতিতেও এগিয়ে আসছে নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতরা।
এবারের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল কনজারভেটিভ পার্টির মনোনিত সংসদ সদস্য প্রার্থী মিনা রহমানের সাথে সিলেটে বৃটেনের নির্বাচনের প্রভাব নিয়ে আলাপ করলে তিনি বলেন, আমার নির্বাচনী প্রচারণাটাই শুরু করেছি প্রিয় জন্মভূমী সিলেট থেকে। আর সেখানকার জনগণের আন্তরিকতা দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। তিনি আরো বলেন, আমার নির্বাচনে জয়লাভ করতে শুধু বার্কিং-এ অবস্থানরত সিলেটী ভোটারদের সহযোগীতাই যথেষ্ট। আর তারা আমাকে নিজের কন্যা বা বোন হিসেবেই নির্বাচিত করবেন বলে আমার শতভাগ বিশ্বাস। তিনি দেশের সর্বস্থরের মানুষের কাছে দোয়া চেয়ে বলেন, আমি আপনাদেরই মেয়ে। আমি যেন নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আপনাদের মাঝে আসতে পারি। আপনারা শুধু আমাকে দোয়া করবেন। আর প্রবাসী সিলেটীদের আমাকে ভোট দানের জন্য উৎসাহিত করবেন।
অন্যদিকে, বাংলাদেশী কমিউনিটির মধ্য থেকে বৃটিশ পার্লামেন্টে সর্বপ্রথম নাম লেখান সিলেটের আরেক নক্ষত্র রোশনারা আলী। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ইরাকে সামরিক হামলার প্রতিবাদে শ্যাডো মন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী রোশনারা আলী এবারও প্রার্থী হয়েছেন। তার জন্মভূমি বিশ্বনাথবাসীও রোশনারা আলীর বিজয়ের অপেক্ষায় আছেন। জানা গেছে, সিলেটের বিভিন্ন এলাকায় যুক্তরাজ্য প্রবাসীদের বাড়িতে ভোট চাইতে কাজ করে যাচ্ছেন তার স্বজনরা।
যুক্তরাজ্য ছাত্রলীগ এর দপ্তর সম্পাদক ড্যানিয়েল আহমেদ বলেন, আমরা বাংলাদেশীরা খুব আনন্দিত! এবারের নির্বাচনে বাংলাদেশী প্রর্থীর সংখ্যা অন্যান্য বারের চেয়ে বেশি। আর ১১জন প্রার্থীদের মধ্যে অনেকেই জয়লাভ করবেন বলে আমার বিশ্বাস। সিলেটী বংশোদ্ভূতদের পাশাপাশি বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতনী, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিকের বিজয় নিশ্চিত বলেও আমরা আশাবাদি।
এখন শুধু অপেক্ষার পালা। দেখা যাক বৃটিশদের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসাবে কয়জন বাংলাদেশী জয়লাভ করেন। আর কয়জন বিজয়ের মালা গলায় নিয়ে নিজ জন্মভূমিতে আসতে পারেন।
নির্বাচনে ১১জন প্রার্থীর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি:
লেবার দলের সাত প্রার্থী
রুশনারা আলী:
গত নির্বাচনে প্রায় ১১ হাজার ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত হওয়া রুশনারা আলী এবারও পূর্ব লন্ডনের বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড বো আসনে লেবার দলের প্রার্থী হয়েছেন। ১৯৭৫ সালে সিলেটের বিশ্বনাথে জন্ম নেওয়া রুশনারা প্রথমবার এমপি নির্বাচিত হয়েই আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ও শিক্ষাবিষয়ক
ছায়ামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ তিনি পার্লামেন্টারি ট্রেজারি সিলেক্ট কমিটির সদস্য হিসেবে মেয়াদ পূর্ণ করেন।
টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক:
লন্ডনের তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ আসন হ্যাম্পট্যাড অ্যান্ড কিলবার্নে লেবার দলের প্রার্থী হয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতনি টিউলিপ
রেজওয়ানা সিদ্দিক। লন্ডনের মিচামে জন্ম নেওয়া টিউলিপ কিংস কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানার মেয়ে ২০১০ সালে স্থানীয় ক্যামডেন কাউন্সিলের কাউন্সেলর নির্বাচিত হন। লেবার দলীয় এমপি গ্লেন্ডা জ্যাকসন বার্ধক্যজনিত কারণে অবসর নেওয়ার ঘোষণা দিলে স্থানীয় লেবার সদস্যদের ভোটে টিউলিপ প্রার্থীতা অর্জন করেন।
রুপা হক:
কিংস্টন ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞান বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ড. রুপা হক লড়ছেন লন্ডনের ইলিং সেন্ট্রাল অ্যান্ড অ্যাকটন আসনে। গত নির্বাচনের কনজারভেটিভদের দখলে যাওয়া আসনটি এবার লেবারের অন্যতম ‘টার্গেট সিট’। ১৯৭২ সালে লন্ডনের ইলিংয়ে জন্ম নেওয়া রুপার আদি বাড়ি পাবনায়।
মেরিনা আহমদ:
মেরিনা আহমদের জন্ম নারায়ণগঞ্জে। মাত্র ছয় মাস বয়সে মা-বাবার সঙ্গে যুক্তরাজ্যে পাড়ি দেওয়া মেরিনা প্রার্থী হয়েছেন লন্ডনের অদূরে
বেকেনহাম আসনে। দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে লেবার পার্টির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত মেরিনা মন্ত্রীদের সঙ্গে কেবিনেট অফিসে কাজ করার পাশাপাশি ক্রাউন
প্রসিকিউশন টিমে দায়িত্ব পালন করছেন।
আনোয়ার বাবুল মিয়া:
আনোয়ার বাবুল মিয়ার আসনটিও লন্ডনের খুব কাছেই। ওয়েলউইন অ্যান্ড হার্টফিল্ড নামের এই আসনে তিনি লড়বেন কনজারভেটিভ দলের চেয়ারম্যান ও মন্ত্রী গ্রান্ট শ্যাপের সঙ্গে। আইন পেশায় নিয়োজিত আনোয়ার বাবুলের জন্ম ১৯৭২ সালে বৃহত্তর সিলেটের জগন্নাথপুরে।
সুমন হক:
স্কটল্যান্ডের অ্যাবার্ডিনশায়ারের বেন্ফ অ্যান্ড বুখান আসনে লেবার দলের মনোনয়ন পেয়েছেন সুমন হক। অ্যাবার্ডিন ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক সুমন প্রথম বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রার্থী, যিনি স্কটল্যান্ডের আসন থেকে মনোনয়ন পেলেন। স্কটল্যান্ডে জন্ম নেওয়া সুমনের আদি বাড়ি বৃহত্তর
সিলেটের ছাতকে। তিনি ১০ বছর ধরে স্কটিশ লেবার দলের সদস্য।
আলী আখলাকুল:
লুটনের রিগেইট অ্যান্ড বেনস্ট্যাড আসনে চারজন প্রতিযোগীকে পরাজিত করে লেবার দলের প্রার্থী নির্বাচিত হন আলী আকলাকুল। লুটনে জন্ম নেওয়া আকলাকুলের আদি বাড়ি সিলেটের বালাগঞ্জে। তিনি ব্রিটিশ রেড ক্রস ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত।
লিবারেল ডেমোক্র্যাট দলের তিন প্রার্থী
প্রিন্স সাদিক চৌধুরী:
নর্থ হ্যাম্পটন সাউথ আসনে লিবারেল ডেমোক্র্যাট দলের পক্ষে প্রার্থী হয়েছেন প্রিন্স সাদিক চৌধুরী। তিনি ২০০৭ সালে নর্থহ্যাম্পটনশায়ার
কাউন্সিল নির্বাচনে প্রথম কোনো বাংলাদেশি হিসেবে কাউন্সেলর নির্বাচিত হয়েছিলেন। পেশায় ব্যবসায়ী সাদিক ১৯৭৩ সালে সিলেট শহরে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র দুই মাস বয়সে মা-বাবার সঙ্গে তিনি যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান।
আশুক আহমদ:
১১ বছর বয়সে ১৯৭৬ সালে মা-বাবার সঙ্গে যুক্তরাজ্যে পাড়ি দেওয়ার পর থেকেই লুটনে বসবাস করছেন আশুক আহমদ। তিনি লুটন সাউথ আসনে ডেমোক্র্যাট দলের প্রার্থী। স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পদে কাজ করা আশুক আহমদ ২০ বছরের বেশি সময় ধরে লিবারেল ডেমোক্র্যাট দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আছেন। তার জন্ম বৃহত্তর সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলা।
মোহাম্মদ সুলতান:
ওয়েলসের আর্ফন আসনে লিবারেল ডেমোক্রেট দলের প্রার্থী হয়েছেন মোহাম্মদ সুলতান। সিলেটের দক্ষিণ সুরমায় জন্ম নেয়া সুলতান তরুণ বয়সে
যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান। পেশায় একজন সফল রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী সুলতান স্থানীয় বেনগোর সিটি কাউন্সিলের কাউন্সেলর।
কনজারভেটিভ দলের এক প্রার্থী:
মিনা রহমান:
কনজারভেটিভ দল থেকে লন্ডনের বার্কিং আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন মিনা রহমান। তিনি গত পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকা দলটির একমাত্র বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রার্থী। সিলেটের ছাতকে জন্ম নেওয়া মিনা রহমান একটি হাউজিং সোসাইটির ব্যবস্থাপক পদে কাজ করার পাশাপাশি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত।