‘মানুষ আমাক পুড়া দিছে’
প্রকাশিত হয়েছে : ৯:২০:৪৫,অপরাহ্ন ২৫ জানুয়ারি ২০১৫
নিউজ ডেস্ক::
‘আমি কিচু করেনি। দাদীর সাথ বাসে করি আসতি লাগি, মানুষ আমাক পুড়া দিছে। খুব কষ্ট, ঘুম আসতি প্যারছিনা। খালি জইলা যাছি, পুড়্যা যাছি। চোখও খ্যুইলতে পারছিনি। আমার জ্বলা কখন বন্ধ হবি; কখন আমি দুই চোখদি দ্যেখতি পাইরবো। মানুষ আমাক কেন পুড়াইলো?’
অধো আধো বোলে এভাবেই দুঃসহ যন্ত্রণার কথা বলছিল পাঁচ বছরের শিশু ফারজানা আক্তার। এ সময় তার নিষ্পাপ চোখের পানি গড়িয়ে মুখের এক পাশ ভিজে যাচ্ছিল। দুর্বৃত্তদের আগুনে মুখের বাম পাশ পুড়ে গেছে ফারজানার। আঘাতে বাম চোখ ফুলে বন্ধ হয়ে গেছে। চোখের নিচ থেকে থুঁতনি পর্যন্ত দগদগে ঘা। পোড়ার যন্ত্রণা থেকে সাময়িক মুক্তি দিতে দেওয়া হচ্ছে ঘুমের ইনজেকশন। কিন্তু ঘুম ভাঙলেই অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে অবুঝ ফারজানা। তার অনেক প্রশ্ন, যার উত্তর নেই কারও কাছেই।
শনিবার দুপুরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে অগ্নিদগ্ধ ফারজানার সঙ্গে কথা বলতে গেলে এমনই দৃশ্যের অবতারণা হয়। শুক্রবার রাতে রাজশাহীর তানোর থেকে বাসে করে দাদীর সঙ্গে রাজশাহী আসছিল ফারজানা। উদ্দেশ্য, ঢাকা যাবে। কিন্তু এর আগেই দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে নির্মম বর্বরতার শিকার হয় ফারজানা (৫) ও তার দাদী জুলেখা বেগম (৪০)।
ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, অগ্নিদগ্ধ নাতনিকে কোলে নিয়ে বসে আসছেন দাদা মজিবর রহমান। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা বলতেই হুহু করে কেঁদে উঠলেন তিনি। তার কান্না দেখে পাশের বেডে থাকা যন্ত্রণাকাতর জুলেখা বেগমও আর না কেঁদে থাকতে পারলেন না। এরপর কয়েক মিনিটের নিরবতায় বার্ন ইউনিটে থাকা অন্যদের চোখও ভিজে গেলো। এমন সহিংসতায় তারা সবাই হতভম্ব।
কেঁদে কেঁদে জুলেখা বেগম বলেন, ‘আমরা গরীব মানুষ। রাজনীতি বুঝিনি। আমার এ অবুঝ নাতনিটা কি করিছে। কেনবা তারা আমাদের এভাবে পেট্রোল দি পুড়াইলো?’ বাসে দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে দুই হাতই পুড়ে গেছে জুলেখা বেগমের। পুড়েছে কপাল ও মুখের বাম দিকটাও। তা নিয়ে অসহ্য যন্ত্রণায় হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন জুলেখা বেগম।
দগ্ধ জুলেখা বেগম জানান, তাদের গ্রামের বাড়ি রাজশাহীর তানোর উপজেলার পাচন্দর ইউনিয়নের পাকচাঁনপুর গ্রামে। তিনি ঢাকার গাজীপুরের কোনাবাড়িতে ভাড়া থাকেন। স্বামী মজিবর কাশিমপুর নয়াপাড়ায় মণ্ডল গার্মেন্টসে কাজ করেন। আর তিনি ডেল্টা স্পিনিংয়ে বুয়ার কাজ করেন। তাদের এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলে-মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে রিকশা চালায়। ছেলের চার মাস বয়সী আরেকটি মেয়ে থাকায় বড় নাতনি ফারজানাকে তারাই লালন-পালন করছেন। দুই বছর আগে বোন মারা যাওয়ায় বোনের মেয়ের বাচ্চা দেখতেই গ্রামে এসেছিলেন।
তাদের দেখে ঢাকার গাজীপুরে ফেরার উদ্দেশে বাসে উঠেই ঘটনার শিকার হন জুলেখা বেগম ও নাতনি ফারজানা। খবর পেয়ে শনিবার সকালে ছুটে এসেছেন স্বামী মজিবর রহমানও। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে জুলেখা বেগম জানান, ঠিক চালকের পেছনের সিটেই ছিলাম আমরা। চলন্ত বাসে যাত্রীবেশে ৩/৪ জন দুর্বৃত্ত পেট্রোল ঢেলে দিলে মুহূর্তের মধ্যেই দাওদাও করে গোটা বাসে আগুন জ্বলে ওঠে। কোনোভাবে তার শরীরের চাদর দিয়ে নাতনি ফারজানাকে জড়িয়ে বাস থেকে নেমে যান। এতে শরীরে আঘাতও পান। আর নাতনিকে তুলতে গিয়ে তার দুই হাত ও মুখ পুড়ে যায় আগুনে। এছাড়া ফাজানার বাম হাত ও মুখের বাম পাশ পুড়ে যায়। এ সময় আছিয়া নামের আরেক শিশুকেও আগুন থেকে বাঁচান তিনি। তবে সাত বছরের ওই শিশুর গোটা মুখই পুড়ে গেছে।
তার অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় শনিবার সকালে তাকে বার্ন ইউনিটের ১৭নং বেড থেকে ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিটে স্থানান্তর করা হয়েছে। রামেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের চিকিৎসার ব্যয় বহন করলেও ভবিষ্যতে দুই হাত দিয়ে কাজ করতে না পারলে কিভাবে বাঁচবেন, এই চিন্তা এখন কুঁড়ে খাচ্ছে জুলেখা বেগমকে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের ইনচার্জ ডা. মনোয়ারা জানান, শুক্রবারের ঘটনায় দগ্ধ ৯ জনের মধ্যে বর্তমানে সাতজন চিকিৎসাধীন রয়েছে। দু’জনকে শনিবার ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। সাতজনের মধ্যে কেবল শিশু আছিয়াকে শনিবার ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিটে রাখা হয়েছে। তার ৬% ফেসিয়াল বার্ন রয়েছে।
হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম নাসির উদ্দিনের নির্দেশে নাশকতার ঘটনায় অগ্নিদগ্ধদের চিকিৎসা খরচ তাদের পক্ষ থেকেই বহন করা হচ্ছে বলে জানান ডা. মোনোয়ারা। শুক্রবার রাতে রাজশাহীর তানোর উপজেলার সদরের ব্র্যাক অফিসের সামনে যাত্রীবাহী বাসে পেট্রোল ঢেলে আগুন দেয় অবরোধকারীরা। এতে নারী ও শিশুসহ ৯ জন দগ্ধ হন।