মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার, নিজামীর রায় আজ
প্রকাশিত হয়েছে : ৫:৩৮:৫০,অপরাহ্ন ২৯ অক্টোবর ২০১৪
ঢাকা: জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায়ের দীর্ঘ অপেক্ষার পালা অবশেষে শেষ হতে পারে আজ বুধবার। কারণ, এই রায় ঘোষণার জন্য আজ আবার দিন ধার্য করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ নিয়ে দ্বিতীয় দফায় এই মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করলেন। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হকের সমন্বয়ে গঠিত এই ট্রাইব্যুনাল গতকাল মঙ্গলবার রায় ঘোষণার এ দিন ধার্য করেন। রায় ঘোষণা উপলক্ষে নিজামীকে সকাল সাড়ে ১০টার মধ্যে হাজির রাখার নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। সন্ধ্যায় তাঁকে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়।
ট্রাইব্যুনালে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলাগুলোর মধ্যে এ পর্যন্ত সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলেছে নিজামীর বিরুদ্ধে মামলার বিচার কার্যক্রম। এর রায়ও অপেক্ষমাণ সবচেয়ে দীর্ঘ সময়। গত বছরের ১৩ নভেম্বর প্রথম দফায় এ মামলার কার্যক্রম শেষে যেকোনো দিন রায় ঘোষণা করা হবে বলে জানান ট্রাইব্যুনাল। সেই থেকে এই রায়ের জন্য অপেক্ষার শুরু। রায় ঘোষণার আগেই ৩১ ডিসেম্বর অবসরে যান ট্রাইব্যুনাল-১-এর তৎকালীন চেয়ারম্যান বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর৷ এর ৫৩ দিন পর
বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়ে এই ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনাল দ্বিতীয় দফায় মামলার সমাপনী যুক্তি শোনেন। ২৪ মার্চ মামলাটি দ্বিতীয় দফায় রায়ের অপেক্ষায় (সিএভি-কেস অ্যায়োটিং ভারডিক্ট) রাখা হয়৷ এর তিন মাস পর ২৪ জুন রায় ঘোষণার দিন ধার্য করা হয়।
কিন্তু রায় ঘোষণার দিন সকালে কারাগারে আটক নিজামী হঠাৎ ‘অসুস্থ’ হয়ে পড়েন। কারা কর্তৃপক্ষ ট্রাইব্যুনালকে জানায়, তাঁকে হাজির করা সম্ভব নয়। ট্রাইব্যুনাল বলেন, আসামির অনুপস্থিতিতে রায় ঘোষণা যুক্তিসংগত নয়। এ জন্য মামলাটি আবারও রায়ের অপেক্ষায় রাখা হয়।
ট্রাইব্যুনাল বলেছিলেন, আসামি সুস্থ হয়ে উঠলে যত দ্রুত সম্ভব রায় ঘোষণা করা হবে। ৩ জুলাই নিজামীর সুস্থতার প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালে পাঠায় কারা কর্তৃপক্ষ। এর প্রায় চার মাস পর দ্বিতীয় দফায় এই রায় ঘোষণার দিন ধার্য করা হলো।
২০১২ সালের ২৮ মে ১৬টি অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এই মামলায় নিজামীর বিচার শুরু হয়। প্রায় দেড় বছর ধরে সাক্ষ্য গ্রহণ চলে৷ এই মামলার দীর্ঘসূত্রতার অন্যতম কারণ, একই সময়ে চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক মামলারও বিচার চলছিল। এ জন্য ওই মামলার অন্যতম আসামি নিজামীকে সপ্তাহে দুই দিন চট্টগ্রামে নেওয়ায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার কার্যক্রম ব্যাহত হয়। গত ৩০ জানুয়ারি ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায়ে নিজামীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়।
মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে নিজামীর সর্বোচ্চ সাজা আশা করছে রাষ্ট্রপক্ষ। তাঁদের দাবি, নিজামীর বিরুদ্ধে গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ প্রভৃতি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ তাঁরা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছেন। একই সঙ্গে এসব অপরাধ সংঘটনে নিজামীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃত্বের দায়ও প্রমাণিত হয়েছে৷
পক্ষান্তরে আসামিপক্ষের দাবি, মিথ্যা তথ্য ও ভুয়া সাক্ষীর সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা এসব অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে পারেনি। এ জন্য নিজামীকে খালাস দেওয়া উচিত।
১৯৪৩ সালে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণকারী নিজামী ১৯৭১ সালে নিখিল পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের (জামায়াতের তৎকালীন ছাত্র সংগঠন, বতর্মান নাম ইসলামী ছাত্রশিবির) সভাপতি ছিলেন৷ রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ, নিজামী একাত্তরের কুখ্যাত গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন৷ ২০১০ সালের ২৯ জুন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে করা মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই বছরের ২ আগস্ট তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়৷
আজ নিজামীর রায় ঘোষণা হলে দুটি ট্রাইব্যুনাল এ নিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের ১০টি মামলার রায় ঘোষণা করবেন। এ পর্যন্ত ট্রাইব্যুনাল-২ ছয়টি এবং ট্রাইব্যুনাল-১ তিনটি মামলার রায় দিয়েছেন। দুই ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায়গুলোর মধ্যে তিনটি ইতিমধ্যে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে সর্বশেষ ১৭ সেপ্টেম্বর জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ট্রাইব্যুনাল-১-এর দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন আপিল বিভাগ। আর গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে ট্রাইব্যুনাল-২-এর দেওয়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড দেন আপিল বিভাগ। ১২ ডিসেম্বর রাতে ওই রায় কার্যকর করা হয়। এ ছাড়া বিএনপির সাবেক নেতা আবদুল আলীম মারা যাওয়ায় তাঁর মামলাটি আপিল বিভাগ বাতিল করেছেন। ট্রাইব্যুনাল-২ তাঁকে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন।
ট্রাইব্যুনাল-১-এর রায়ে ৯০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ পাওয়া জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমও কারাগারে আটক অবস্থায় ২৩ অক্টোবর মারা যান। নিয়ম অনুসারে আপিল বিভাগে বিচারাধীন তাঁর মামলাটিও আর চলবে না।
এ ছাড়া মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এ পর্যন্ত জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, আলবদর বাহিনীর দুই নেতা চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান, জামায়াতের সাবেক সদস্য (রুকন) আবুল কালাম আযাদ, বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
নিরাপত্তা জোরদার: রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে আজ রাজধানীসহ দেশব্যাপী নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। গতকাল রাত থেকেই রাস্তায় নেমেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান জানান, নিজামির রায়কে কেন্দ্র করে হাইকোর্ট এলাকায় ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া রায়কে কেন্দ্র করে ঢাকা মহানগরে থাকবে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। থাকবে তল্লাশি চৌকি, অতিরিক্ত টহল।
ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন জায়গায় বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, ঢাকার বাইরের জেলাগুলো বিশেষ করে যেসব জায়গায় গত বছর ব্যপক জ্বালাও-পোড়াও হয়েছিল, সেসব জেলায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
হরতাল দিতে পারে জামায়াত: রায় দেখে প্রতিক্রিয়া জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জামায়াতের নীতি-নির্ধারকেরা। দলের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, রায়ে মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড বা এর কাছাকাছি কোনো ধরনের সাজা হলে কাল বৃহস্পতিবার ও রোববার সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডাকার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। ছাত্রশিবিরের সভাপতি ও সেক্রেটারিও গতকাল এক বিবৃতিতে রায়ে ‘অবিচার’ হলে মাঠে নামার হুমকি দিয়েছেন।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী ও কর্মপরিষদের দুজন সদস্য জানান, দলের সাবেক আমির গোলাম আযমের মৃত্যুর পরপরই নিজামীর রায়ের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না নেতা-কর্মীরা। তাঁরা মনে করেন, গোলাম আযমের জানাজায় নেতা-কর্মীদের বিপুল উপস্থিতি সরকারের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। তা আড়াল করতেই এতদিন অপেক্ষমাণ থাকা রায়কে হঠাৎ করে সামনে আনা হয়েছে।