মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অমান্য করে চলছে বিমান
প্রকাশিত হয়েছে : ৯:৫৬:৫৩,অপরাহ্ন ৩০ ডিসেম্বর ২০১৪
নিউজ ডেস্ক::
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে লাভজনক করতে জনবলের সংখ্যা কমিয়ে আনতে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেয়া হলেও তা বাস্তবায়ন না করায় ক্ষতি গুণতে হয়েছে প্রায় ৫০ কোটি টাকা। যা বেড়েই চলেছে। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন এই প্রতিষ্ঠানের ২০০৮-০৯ সালের হিসাব সম্পর্কিত মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) বার্ষিক অডিট রিপোর্টে এই তথ্য উঠে আসে।
অডিট রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণের স্কিম এবং কর্মরত জনবলের বেতন-ভাতা পর্যালোচনায় দেখা যায়, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী বিমানের লোকবল না কমানোয় বেতন-ভাতা পরিশোধ বাবদ অতিরিক্ত অর্থ পরিশোধ করায় বছরে ৪৯ কোটি ৮১ লাখ ৫৩ হাজার ১৬০ টাকা ক্ষতি হয়েছে। যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।
এতে বলা হয়, বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়ের বিমান পুনর্গঠন ও বানিজ্যকীকরণে সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০০৭ সালের ৩০ জুনের মধ্যে বিমানের জনবল ৬৮৮৩ থেকে কমিয়ে ৩৪০০ জনে নামিয়ে আনার নির্দেশনা প্রদান করে। কিন্তু এই নির্দেশনা উপেক্ষা করায় সরকার অনুমোদিত ৩৪০০ জনের বিপরীতে অতিরিক্ত সর্বনিম্ন ২৫ দশমিক ১৪ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ২৯ দশমিক ৭ শতাংশ জনবলের বেতন-ভাতা পরিশোধ করায় ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বিমানের এই ক্ষতি হয়।
সরকারি হিসাব সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সদস্য রুস্তম আলী ফরাজী প্রিয়.কম-কে বলেন, ‘বিমান দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে সংস্থাটির সঙ্গে জড়িতরা সব লুটেপুটে খাচ্ছে। তাই সরকার বারবার চেষ্টা করেও এটিকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে পারে নাই।’
অডিট প্রতিষ্ঠান এ ব্যাপারে জানায়, বাংলাদেশ বিমানকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরের শর্ত হিসেবে জনবল কাঠামো ৩৪০০ নির্ধারণ করা হয়। জনবল কাঠামো নির্ধারণের সময় ড্রাইভার, পিয়ন, ট্রাফিক হেলপার, কার্গো হেলপার, এয়ারক্রাফট ক্লিনার এবং নিরাপত্তারক্ষীর পদ সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত করা হলেও বাস্তবে এ পদের কার্যক্রম অব্যাহত থাকে। ফলে এ সকল পদের অধিকাংশ কর্মচারী ভিআরএস-এ যাওয়ায় বিমানের অপারেশন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখার স্বার্থে ক্যাজুয়াল ভিত্তিতে এসব লোকবল নিয়োগ করা হয়।
নিরীক্ষা মন্তব্যে বলা হয়, নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান থেকে বিগত ২০১০ সালের ১২ জুলাই মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবত পত্র দেয়া হয়। পরবর্তীতে ২৩ জুলাই আবারো তাগিদপত্র দেয়া হয়। পরে জবাব না পাওয়ায় সর্বশেষ ব্যবস্থা হিসেবে ওই বছরের ৭ নভেম্বর মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর আধা সরকারি চিঠি জারি করা হয়। এরপর ৮ নভেম্বর মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জবাব পাওয়া যায়। এতে জানানো হয়, অধিকাংশ কর্মচারী ভিআরএস-এ যাওয়ায় বিমানের অপারেশন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখার স্বার্থে ক্যাজুয়াল ভিত্তিতে ওই সংখ্যক জনবল নিয়োগ করা হয়। অনুমোদিত জনবল কাঠামোর অতিরিক্ত লোকবল নিয়োগ করায় জবাব গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়নি।
নিরীক্ষার সুপারিশ হিসেবে অনুমোদিত সেটআপের মধ্যে জনবলের পরিমাণ নির্দিষ্ট করা এবং অনিয়মের বিষয়ে দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ করতে বলা হয়েছিল।
এসব বিষয়ে বিমানের পক্ষ থেকে বলা হয়, বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিমানের সার্বিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য কর্তৃপক্ষ ঘোষিত স্বেচ্ছা অবসর কর্মসূচির আওতায় (ভিআরএস) বিগত ২০০৭ সালের ১ জুলাই থেকে ১৮৭৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। এছাড়া ১৫৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে টার্মিনেট এবং বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান করা হয়।
সংস্থাটি আরো জানায়, ২০০৭ সালে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অনুযায়ী বিমানের অনুমোদিত জনবল ৬৮৩৭ থেকে ৩৪০০ জনে নামিয়ে আনা হয়। কিন্তু বিমানের বাণিজ্যিক দিক বিবেচনা করে কত জনবল রাখা হলে সার্বিক কার্যক্রমের ওপর ব্যাঘাত সৃষ্টি হবে না, সে ব্যাপারে মাঠ পর্যায়ের কোনো জরিপ ছাড়াই জনবল কমানো হয়েছে। হঠাৎ করে বিমানের জনবল কমিয়ে ফেলায় জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
বিমান দাবি করে, ট্রাফিক, হেলপার, কার্গো হেলপার, এমএলএসএস ও এমটি অপারেটর (ড্রাইভার) পদে প্রায় ১৫০০ পদ অবলুপ্ত করার ফলে বিমানের অপারেশন কার্যক্রম অচল হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় বিমানের ইঞ্জিনিয়ারিং, গ্রাউন্ড সার্ভিস, যানবাহন শাখাগুলোর চার শিফটে ২৪ ঘন্টা কার্যক্রম চালু রাখার জন্য বিমান থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গৃহিত জনবল থেকে কিছু সংখ্যক লোককে ক্যাজুয়াল ভিত্তিতে নিয়োগ প্রদান করা হয়। উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনার জন্য বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর একমাত্র গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং এজেন্ট বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। এর মাধ্যমে বছরে বিমান ৩০০ কোটি টাকা আয় করে। তাই এসব কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনায় বিমানে ক্যাজুয়াল ভিত্তিতে জনবল রাখা হয়।
এ বিষয়ে রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, এটি ভুল সিদ্ধান্ত ছিল না। তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মন্ত্রণালয় লোকবল কমানোর যে সিদ্ধান্ত দিয়েছিল, তাতে কিছুটা ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কারণ বিমানের পরিচালনায় কতজন লোকবলের প্রয়োজন ছিল, তা আমলে না নিয়েই মন্ত্রণালয় লোকবল কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এতে বিমান পর্ষদেরও খাম-খেয়ালী ছিল। তারা মন্ত্রণালয়ের সাথে সে সময় একমত পোষণ করে। লোকবলের সমস্যা সঠিকভাবে নিরূপন না করেই বিমানকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত করা হয়।
ক্যাজুয়াল ভিত্তিতে কার্যক্রম পরিচালনার বিষয়ে তিনি বলেন, আইনি দিক থেকে এটি কখনই সঠিক ছিল না। যেসব লোকজনকে গোল্ডেন হ্যান্ড শেকের মাধ্যমে অবসরে পাঠানো হয়েছে, তাদের কিভাবে আবারো নিয়োগ দেয়া হয়েছে সেই বিষয়ে কমিটিতে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। এটি আইনের লঙ্ঘন। তাই বিমানকে আগামী দুই ও তিন মাসের মধ্যে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত ছাড়া এসব নিয়োগের বিষয়ে জবাব দিতে বলা হয়েছে। এরপর যারা এর সাথে যুক্ত ছিল, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার সুপারিশ হবে।
রুস্তম আলী ফরাজী জানান, এক্ষেত্রে তৎকালীন কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা বর্তমানে অবসর নিয়ে পেনশন ভোগ করছেন, তাদের পেনশন বন্ধ করে দেয়া হবে। আর যারা কর্মরত আছেন তাদের বেতন বন্ধ করাসহ চাকুরি থেকে অব্যাহতি দিয়ে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এছাড়া কমিটির বৈঠকে বিমানের কর্তাদের পাওয়া যায় না বলেও অভিযোগ করেন এই সংসদ সদস্য।
বিমানের কর্মরত জনবল সংক্রান্ত পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০০৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত স্থায়ী জনবল ছিল ৪৫৯৯, অস্থায়ী ক্যাজুয়াল ৭৫৬সহ সর্বমোট ৫৩৫৫ জন। ৩১ ডিসেম্বর তা দাঁড়ায় স্থায়ী জনবল ২৭৯২, অস্থায়ী ক্যাজুয়াল ১৪২৩সহ সর্বমোট ৪২১৫ জন। আবার ২০০৮ সালের ৩১ ডিসেম্বরে স্থায়ী জনবল ২৮৭৪, অস্থায়ী ক্যাজুয়াল ১৮০৯সহ সর্বমোট ৪৬৮৩ জন হয়। আর ২০০৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এসে দাঁড়ায় স্থায়ী জনবল ৩১৯৭, অস্থায়ী ক্যাজুয়াল ১৫১০সহ সর্বমোট ৪৭০৭জন।
সংস্থাটি আরও দাবি করে, বিমানের বিভিন্ন বিভাগে জনবল কমাতে নিরীক্ষা আপত্তিতে অতিরিক্ত লোকবল নিয়োগে আর্থিক ক্ষতির কথা বলা হলেও উল্লেখিত পদে ক্যাজুয়াল জনবল নিয়োগ ছাড়া বিমানের গতিশীলতা বজায় রাখা সম্ভব নয়। তাই জবাব ও বাস্তবতার আলোকে আপত্তিটি নিষ্পত্তির জন্য অনুরোধ করে বিমান কর্তৃপক্ষ। এর সাথে মন্ত্রণালয়ের জবাবে একমত পোষণ করা হয়।
তবে এ বিষয়ে অডিট অধিদফতরের মন্তব্যে বলা হয়, ভিআরএস (স্বেচ্ছা অবসর কর্মসূচি) আলোকে বিমানের মোট ২০৩২ জনকে অবসর প্রদান করা হয়েছিল। কিন্তু অবসরপ্রাপ্ত এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পুনরায় ক্যাজুয়াল ভিত্তিতে বিভিন্ন পদে নিয়োগ করা হয়। মন্ত্রণালয়ের আদেশ অমান্য করে অতিরিক্ত জনবলকে বেতন-ভাতা প্রদান করার কোনো অবকাশ নেই। তাই প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত জনবলের মধ্যে সীমিত রেখে অতিরিক্ত জনবলের বিপরীতে অনিয়মিতভাবে ব্যয়িত অর্থ আদায় করা আবশ্যক। অডিট অধিদফতরের মন্তব্যের সাথে একমত পোষণ করে সিএজি।
অডিট রিপোর্টে বলা হয়, চূড়ান্ত ভিআরএস তৈরির সময় জনবলের ঘাটতির বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের নজরে আনা উচিত ছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে এটি যথাযথভাবে সম্পন্ন না করায় এই আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। তাই এ সংক্রান্ত দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ ও ক্যাজুয়াল ভিত্তিতে নিয়োগে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেয়া হয়েছিল কিনা, তা জানা আবশ্যক।
রোববার দশম জাতীয় সংসদের ‘সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি’র ১৬তম বৈঠক বিমানের অনিয়মের বিষয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, ২০০৭ সালে স্বেচ্ছা অবসর স্কিমের আওতায় বিমানের অনুমোদিত জনবল ৬৮৩৭ থেকে ৩৪০০ এ নামিয়ে আনতে নির্দেশ দেয় মন্ত্রণালয়। কিন্তু সেই নির্দেশনা না মানায় বছরে ৪৯ কোটি ৮১ লাখ ৫৩ হাজার ১৬০ টাকা ক্ষতি হয়। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে সংসদীয় কমিটি অনধিক তিন মাসের মধ্যে যাচাই করে জনবলের সংখ্যা যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনতে সুপারিশ করে।