ভয়ংকর ফাঁদে ‘কলেজ পড়ুয়া মেয়েরা’
প্রকাশিত হয়েছে : ৯:৫৮:২০,অপরাহ্ন ০২ ডিসেম্বর ২০১৪
নিউজ ডেস্ক:: ফরিদপুরে কলেজ পড়–য়া মেয়েদের ‘ফাঁদে’ ফেলে তাদের সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে একটি চক্র। এ চক্রটির ফাঁদে পড়ে ইতোমধ্যেই একাধিক ছাত্রী তাদের সর্বস্ব খুইয়েছেন। এমনকি আত্মহত্যার পথ বেঁছে নিয়েছেন এক ছাত্রী।
আপরাধী চক্রটি মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ভিডিও করে তা নিয়ে ব্যবসাও করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। মোবাইলে ধারন করা ভিডিও এর কথা বলে অভিভাবকদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা আদায় করছে দুর্বৃত্তরা। কেউ দিতে ব্যর্থ হলে তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এ চক্রটির কবলে পড়ে এক ছাত্রীর আত্মহত্যার পর আরেক ছাত্রী মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে এখন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে।
এসব বিষয় নিয়ে থানায় মামলা হলে চক্রটির তিন সদস্যকে আটক করে পুলিশ। তবে পরে জামিনে মুক্ত হয় তারা।
অভিযোগ উঠেছে, জামিনে আসার পর ফের চক্রটি একই অপরাধ সংঘটিত করার জন্য সক্রিয় হয়ে উঠেছে। চক্রটির অন্যতম হোতাকে এক কলেজ ছাত্রীর সাথে আপত্তিকর অবস্থায় আটক করে থানায় সোপর্দ করা হয়েছে। এ চক্রটির ফাঁদে পড়ে অনেক কলেজ ছাত্রী তাদের সর্বস্ব হারালেও মান সম্মানের ভয়ে চুপ করে রয়েছেন।
প্রাপ্ত অভিযোগ, থানায় মামলা ও ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে জানা গেছে, ফরিদপুর সরকারী রাজেন্দ্র কলেজে পড়তে আসা রাজবাড়ীর টুটুল ও সুবল নামের দুই ছাত্র শহরের একটি মেস ভাড়া নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মেয়েদের ফাঁদে ফেলে এ কর্মকান্ড করে আসছে। তাদের সাথে রয়েছে আরো কয়েকজন সহযোগী।
সম্প্রতি পরিচয়ের সূত্র ধরে রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলার অনিল রায়ের রাজেন্দ্র কলেজের মাস্টার্স পড়–য়া কন্যাকে শোভন কুমার দাস টুটুল ও শিশির কুমার বিশ্বাস তাদের মেসে ডেকে আনে। ছাত্রীটির বাবা অসুস্থ্য হয়ে তাদের মেসে রয়েছে এমন কথা বলে তাকে ডেকে আনা হয়। পরবর্তীতে ওই মেসে কয়েকজন মিলে ছাত্রীটিকে ধর্ষন করে। ধর্ষনের দৃশ্য মোবাইল ফোনে ধারন করা হয়। পরে এ ভিডিও দেখিয়ে পুনরায় তাকে মেসে ডাকা হয়। কিন্তু ছাত্রীটি মেসে না যাওয়ায় তার অভিভাবকের কাছে ভিডিও দেখিয়ে পঞ্চাশ হাজার টাকা চাওয়া হয়। ছাত্রীটির অসহায় পিতা টাকা না দেয়ায় লম্পটরা ধর্ষনের ভিডিওটি ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়। ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ে রাজেন্দ্র কলেজের শত শত ছাত্র-ছাত্রীর মোবাইল ফোনে।
জোরপূর্বক ধর্ষনের ভিডিওটি ফাঁস হবার পর ছাত্রীটি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। একপর্যায়ে সে আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়। আশংকাজনক অবস্থায় তাকে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। সুস্থ্য হবার পর তার বাবা তাকে পাংশায় বাড়ীতে নিয়ে যায়। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার পর তাকে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিছুটা সুস্থ্য হবার পর তাকে বাড়ী নেয়া হলে গত এক সপ্তাহ আগে ছাত্রীটি ফের ঘুমের ঔষধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। পরে তাকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে ছাত্রীটি মানসিক চিকিৎসক আলতাফ হোসেনের তত্বাবধানে রয়েছেন।
ধর্ষন ও ভিডিওচিত্র ইন্টারনেটে ছাড়ার বিষয়টি নিয়ে ওই শিক্ষার্থীর বাবা অনিল রায় ফরিদপুর কোতয়ালী থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় আসামী করা হয় শিশির কুমার বিশ্বাস, শোভন কুমার দাস ওরফে টুটুল, চয়ন কুমার দাস, চিম্ময় দাস ওরফে চন্ডি, রানা মজুমদারসহ অজ্ঞাত আরো দুইজনকে।
এ ঘটনার পর কোতয়ালী থানায় মামলা হলে পুলিশ ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে শিশির কুমার বিশ্বাস, চয়ন কুমার দাস, চিম্ময় দাস ওরফে চন্ডিকে আটক করে। আটককৃতদের চার দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। রিমান্ডে তারা বেশকিছু তথ্য প্রকাশ করে পুলিশের কাছে। তদন্ত প্রতিবেদনে পুলিশ ঘটনার সাথে অভিযুক্তদের কিছুটা জড়িত থাকার কথা বলে প্রতিবেদন দাখিল করে আদালতে। প্রতিবেদনে তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ (২) ধারায় বাদী যে তথ্য উপস্থাপন করেছেন তার কোন তথ্য আটককৃতরা দিতে পারেনি এবং বাদী সেতথ্য প্রমান উপস্থাপন করতে পারেনি। পরে তারা সবাই জামিনে মুক্ত হয়।
ধর্ষনের ঘটনাটি ও ভিডিওটি অনেকের কাছে থাকলেও কেন তা পুলিশ উদ্ধার করতে পারেনি তা রহস্যজনক বলে মনে করছে ওই শিক্ষার্থীর পরিবার।
ওই শিক্ষার্থীর বাবা অনিল রায় জানান, তার দুটি মেয়ে। এই মেয়েটির বয়স যখন দেড় বছর তখন তার মা মারা যায়। অনেক কষ্ট করে তিনি তাকে মানুষ করছিলেন। ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছিল তার মেয়েটি। পাংশা উপজেলার মধ্যে শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থী ছিল সে। ৫ম শ্রেনীতে ও ৮ম শ্রেনীতে বৃত্তি পেয়েছিল। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করেছিল। আশা ছিল উচ্চতর শিক্ষা নিয়ে অধ্যাপনার পেশায় আসবে। কিন্তু সুবল-টুটুলগংদের কারনে সে এখন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। এ ঘটনার সাথে জড়িতদের কঠোর শাস্তি দাবী করেন তিনি।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, এ ঘটনার সাথে যারা জড়িত তাদের আটক করা হলেও পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে কোন এ্যাকশনে যায়নি। ধর্ষনের দৃশ্যটি ছড়িয়ে দেবার কারনে তার মেয়ে এখন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। তার পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেছে। মানুসিকভাবে বিপর্যস্থ হওয়ায় সে দু দু’বার আত্মহত্যার চেষ্টা করে।
অনিল রায় আরো বলেন, তার মেয়েকে ধর্ষণের সাথে জড়িতরা মামলা তুলে নিতে নানাভাবে হুমকি দিচ্ছে। প্রভাবশালী একটি মহল মামলাটি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য চেষ্টা করছে বলেও তিনি জানান। কথা বলার এক পর্যায়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন অনিল রায়। তিনি এ ঘটনার সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানান।
এদিকে, এ চক্রটির আরেক হোতা সুবল চন্দ্র গত ২৫ নভেম্বর একই মেসে ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার কুশৈই চন্দ্র মন্ডলের মেয়ে রাজেন্দ্র কলেজের ছাত্রীকে প্রলোভনে ফেলে মেসে নিয়ে আসে। পরে তাকে জোরপূর্বক ধর্ষন করা হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিষয়টি টের পেয়ে মেসের মালিকের স্ত্রী রুমে ঢুকে আপত্তিকর অবস্থায় তাদের দেখতে পায়। পরে তিনি তার স্বামীকে খবর দিলে সে মেসে এসে ঘটনাটির বিষয়ে সুবলকে জিজ্ঞাসা করতে সে সবকিছু স্বীকার করে। পরে তাদের পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়।
এ বিষয়ে মেসের মালিক বাদী হয়ে কোতয়ালী থানায় একটি অভিযোগ দাখিল করে। পরে মেয়েটির পরিবারকে চাপ দেয়া হয়, ঝামেলা না করে সুবলের সাথে বিয়ে দেবার। একই চক্রের দ্বারা একই মেসে বারবার ছাত্রী ধর্ষনের ঘটনা/ভিডিও চিত্র ধারন ও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়া নিয়ে তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়।
নামপ্রকাশ না করার শর্তে রাজেন্দ্র কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থী অভিযোগ করে বলেন, ফরিদপুর শহরে অনেক মেস রয়েছে যেখানে নানা প্রলোভন কিংবা ফাঁদে ফেলে ছাত্রীদের সাথে অনৈতিক কর্মকান্ড করা হয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, এসব দৃশ্য ভিডিও ধারন করে তা ছড়িয়ে দেবার কথা বলে বারবার অনৈতিক কর্মকান্ড করতে বাধ্য করা হয়। তাছাড়া ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেবার ভয় দেখিয়ে টাকাও হাতিয়ে নেয়া হয়। এ কাজের সাথে ফরিদপুরের বাইরে থেকে পড়তে আসা মেয়েদের টার্গেট করা হয় বলে জানা গেছে।
সুবল-টুটুলদের ফাঁদ থেকে বেঁচে যাওয়া জনৈক ছাত্রী জানান, চক্রটি প্রথমে গ্রামের মেয়েদের সাথে খাতির করার চেষ্টা করে। নানা বাহানায় দু একটি উপহার দিয়ে সর্ম্পক সৃষ্টি করে। পরে সুযোগ মতো মেসে নিয়ে অনৈতিক কর্মকান্ড করে। সেই দৃশ্য ভিডিও ধারন করে রাখে।