‘বিপন্ন বিশ্ব ঐতিহ্যে’র তালিকায় নাম লেখাবে সুন্দরবন, উদাসীন সরকার
প্রকাশিত হয়েছে : ৬:০৯:০৭,অপরাহ্ন ১১ ডিসেম্বর ২০১৪
অনলাইন ডেস্ক: ইউনেস্কো ঘোষিত প্রাকৃতিক বিশ্ব ঐতিহ্যের স্থানগুলোকে অভয়ারণ্য ঘোষণা করে রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সংস্থাটির পক্ষ থেকে পর্যবেক্ষণকারী দলসহ রাষ্ট্রের সরকারগুলো ঐতিহ্য রক্ষায় পদক্ষেপ নেয়। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার প্রায়ই সুন্দরবনের ঐতিহ্যের কথা গর্ব ভরে উল্লেখ করলেও এটি রক্ষায় তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। সুন্দরবনের খেতাব বাতিলে ইউনেস্কোর পক্ষ থেকে একাধিকবার সতর্ক করা হলেও এখন পর্যন্ত তা আমলে নেয়নি সরকার। সাড়ে তিন লাখ লিটার জ্বালানি তেলসহ ট্যাংকার ডুবির ঘটনা এ শঙ্কাকে আরও ঘনীভূত করেছে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় শ্বাসমূলীয় এই বনের ব্যাপারে বরাবরই উদাসীন সরকার। তেলবাহী ট্যাংকার ডুবির ঘটনায় পরিবেশবিদদের মনে নতুন করে আরো উদ্বেগের জন্ম নিয়েছে। পরিবেশবিদরা আশঙ্কা করছেন, এ ধরনের নেতিবাচক প্রভাব অব্যাহত থাকলে শিগগিরই ইউনেস্কোর ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’ থেকে ‘বিপন্ন বিশ্ব ঐতিহ্যে’র তালিকায় নাম লেখাবে সুন্দরবন।
নিয়মিত অবহেলার মুখে ইতোমধ্যে সুন্দরবন থেকে ২ প্রজাতির পাখি, ৫ প্রজাতির মাছ ও ৩ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী হারিয়ে গেছে। বিলুপ্ত হওয়ার শঙ্কায় রয়েছে ২ প্রজাতির উভচর, ১৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৫ প্রজাতির পাখি ও ৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী।
শ্যালা নদীতে তেলবাহী ট্যাংকার ডুবির এলাকায় ইরাবতী, বোতলনাক, গাঙ্গেয়, ইন্দো প্যাসিফিক হাম্পব্যাক, ফিনলেস পরপয়েস, প্যানট্রপিক্যাল স্পটেড ডলফিনের প্রজাতি দেখতে পাওয়া যায়। এ ছাড়া এর আশপাশে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বসবাসও রয়েছে। এ দুর্ঘটনার ফলে ওই প্রাণীগুলো ছাড়াও বিখ্যাত সুন্দরী গাছ বিপন্ন হওয়ার মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়েছে।
এদিকে পরিবেশবিদদের অাশঙ্কা, এই সুন্দরবনেই নির্মিতব্য রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের পরিবেশ ও বাস্তুসংস্থান ধ্বংস হয়ে যাবে।
ইতোমধ্যে নির্মিতব্য রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, সুন্দরবন রেঞ্জ দিয়ে নৌযান চলাচলের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারকে বেশ কয়েকবার সতর্ক করেছে ইউনেস্কো কর্তৃপক্ষ। বাগেরহাটের রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত জানাতে সরকারের কাছে বেশ কয়েকবার চিঠিও দিয়েছে সংস্থাটি। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে গ্রহণযোগ্য কোনো জবাব দেওয়া হয়নি।
সর্বশেষ গত ১১ জুলাই ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সেন্টারের পরিচালক কিশোর রাও স্বাক্ষরিত সুন্দরবন সংক্রান্ত একটি চিঠি সংস্থাটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে দেওয়া হয়। সুন্দরবন রক্ষায় সরকার কী উদ্যোগ নিয়েছে সে বিষয়ে আগামী বছরের ১ ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রতিবেদন চেয়েছে সংস্থাটি।
গত মঙ্গলবার পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের শ্যালা নদীতে মালবাহী জাহাজের ধাক্কায় ‘ওটি সাউদার্ন স্টার সেভেন’ নামে একটি তেলবাহী ট্যাংকার ডুবে যাওয়ায় এতে থাকা ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার ফার্নেস তেল ছড়িয়ে পড়েছে ৭০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে। নদীর উপর এই ফার্নেস তেলের ভারী আস্তরণ থাকায় নদীর পানিতে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন প্রবাহিত হতে পারছে না। ফলে এই বিশ্বের সবচেয়ে বড় শ্বাসমূলীয় বনের জীববৈচিত্র এখন মারাত্মক হুমকির মুখে পতিত হয়েছে। শুধু শ্যালা নদীই নয়, এ নদীর শাখা প্রশাখা দিয়ে এসব ফার্নেস তেল ছড়িয়ে পড়েছে সুন্দরবনের আরো গভীরে। সুন্দরবনের যে অংশে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে, সে অঞ্চল সরকার ঘোষিত ডলফিনের অভয়ারণ্য। ট্যাংকারের তেল ছড়িয়ে পড়ায় এসব বিলুপ্তপ্রায় ডলফিনও মরতে শুরু করেছে। সুন্দরবন ও এর আশপাশের জেলেদের ভাষ্য অনুযায়ী, তারা বিভিন্ন নদীতে মাছ ভাসতে দেখেছেন।
নদীতে তেল ছড়িয়ে পড়ায় শুধু বিলুপ্তপ্রায় ডলফিনই নয় বরং বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই শ্বাসমূলীয় বনের গাছপালা, মাছ ও বন্য প্রাণীর জন্য এক মহাবিপর্যয়ে পড়েছে। কারণ পানিতে তেলের আস্তরণ প্রাণের অস্তিত্বের জন্য বিরাট হুমকি। আশ্চর্যের বিষয় হলো, দুর্ঘটনার পর ১২ ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কিছু জানতেন না। জাহাজ উদ্ধার ও তেল অপসারণের কোনো উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। এমন অবস্থায় একটা প্রশ্নই গুরুত্বপূর্ণ, আর সেটা হচ্ছে, কবে ক্ষতিগ্রস্থ সুন্দরবন ও আশপাশের এলাকা তার পূর্বের রূপ ফিরে পাবে?
ইতোমধ্যে তেলবাহী ট্যাংকারডুবির ঘটনা ওই অঞ্চলের পানিসহ বনাঞ্চলের প্রাণীদের উপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী সংগঠন ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটি। তাদের উদ্বেগানুযায়ী, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ওপর প্রভাব পড়লে তা সুন্দরবনের ঐতিহ্যের খেতাবের ক্ষেত্রে মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দেবে।
ট্যাংকার ডুবির ঘটনার প্রায় দেড়দিন পর ডুবন্ত ট্যাংকারটিকে কিনারে আনতে সক্ষম হয়েছে কর্তৃপক্ষ। আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে জাহাজটিকে দেশীয় পদ্ধতিতে তীরে টেনে আনা হয়। এ ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘ। এ ঘটনায় সুন্দরবনের কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা অনুসন্ধানে জাতিসংঘের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল শিগগিরই বাংলাদেশে আসতে পারে।
ট্যাংকারটি উদ্ধারের পর এখন সরকার নদীতে ছড়িয়ে থাকা তেল অপসারনে পদক্ষেপ নিচ্ছে। নদীতে ছড়িয়ে পড়া তেল অপসারণে স্থানীয় জেলেদেরকে নামানো হচ্ছে। আগামী তিন দিন নেট দিয়ে ছড়িয়ে পড়া তেল সংগ্রহ করবে তারা। এরপর উদ্ধারকারী জাহাজ কাণ্ডারী-১০ থেকে ছিটানো হবে পাউডার। এ ছাড়া পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত এ রুটে নৌযান চলাচল বন্ধ থাকবে।
দুর্ঘটনাকবলিত ট্যাংকারের সুপারভাইজার ওয়ালিউল্লাহ জানিয়েছেন, সংকেতের তোয়াক্কা না করে পরিকল্পিতভাবেই এমভি সাউদার্ন স্টার-৭ ট্যাংকারে ধাক্কা দেয় এমভি টোটাল ট্যাংকার।
তিনি জানান, সোমবার বিকেল ৪টার দিকে জয়মনি ঘোল থেকে ট্যাংকারটি রওয়ানা দেয়। ঘন কুয়াশার কারণে ট্যাংকারটি মঙ্গলবার রাতে নোঙর করে তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন। তখন তিনি আরেকটি ট্যাংকার আসতে দেখেন। ওই ট্যাংকারকে বেশ কয়েকবার সংকেত দেওয়া হয়। কিন্তু সংকেতের তোয়াক্কা না করে পরিকল্পিতভাবেই ধাক্কা দেয় এমভি টোটাল। ট্যাংকার ডুবে যাওয়ার পর প্রশাসনকে জানান হয়। কিন্তু তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
জানা গেছে, সুন্দরবনে ডুবে যাওয়া তেলবাহী জাহাজ ‘ওটি সাউদার্ন স্টার-৭’ সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরে নিবন্ধিত না। এটির লাইসেন্স দিয়েছে পেট্রোবাংলা।
সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের মহাপরিচালক কমোডর জাকিউর রহমান ভুঁইয়া এ তথ্য জানিয়ে বলেন, সমুদ্র পথে তেল পরিবহনের জন্য যে ধরনের ক্র্যাইটেরিয়া (উপযোগিতা) থাকার কথা, তা এ জাহাজে ছিল না। তা ছাড়া এগুলো অভ্যন্তরীণ নদীপথে তেল পরিবহন করার জন্য, যা ডিপো থেকে সরাসরি গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেয়। তেলবাহী জাহাজের জন্য যে ধরনের স্ট্যান্ডার্ড থাকার কথা তা এই জাহাজে নেই। এ জাহাজের লাইসেন্স তারা দেননি। ২০১০ সালে কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টের জন্য পেট্রোবাংলা এ সব জাহাজের লাইসেন্স দেয়। সে সময় থেকে এ জাহাজগুলো তেল পরিবহন করে আসছে।
এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করেছে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। আজ বৃহস্পতিবার মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. নূরুল করিমকে আহ্বায়ক করে এ কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে ১৮ ডিসেম্বরের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কমিটি সরেজমিনে তদন্ত করে সুন্দরবনের প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব এবং সম্ভাব্য বিপর্যয় ও ক্ষয়ক্ষতির উত্তরণে সুপারিশ পেশ করবে।