বিজিবি’র রাজ্জাক অপহরণের নেপথ্যেও ইয়াবা
প্রকাশিত হয়েছে : ২:২১:২২,অপরাহ্ন ২২ জুন ২০১৫
নিউজ ডেস্ক::
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) নায়েক আবদুর রাজ্জাক অপহরণের নেপথ্যেও রয়েছে ইয়াবা-ব্যবসা। দুদেশের চোরাকারবারীদের পাশাপাশি মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) কতিপয় সদস্যেরও অবৈধ আয়ের অন্যতম উৎস এই ইয়াবা-ব্যবসা। আর এই ইয়াবাপাচারে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায় বিজিবি। এতেই চরম অসন্তুষ্ট হয়ে পড়ে বিজিপির কিছু অসাধু সদস্য। তাই ইয়াবা পাচারের প্রধান রুট নিরাপদ রাখতেই বিজিবি সদস্যদের ওপর হামলা ও অপহরণের ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) হাতে অপহৃত নায়েক আবদুর রাজ্জাককে ছয় দিনেও ছেড়ে না দেওয়ায় চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে বিজিবিতে। উপরন্তু মিয়ানমারের ওয়েব সাইট, সোশ্যাল মিডিয়া এমনকি সেদেশের বিভিন্ন পত্রিকায় বিজিবি’র ইউনিফর্মের শার্ট, লুঙ্গি ও হাতকড়া পরিয়ে রাজ্জাকের ছবি তুলে বিশেষ উদ্দেশ্যে তা প্রচারও করেছে বিজিপি। যে ছবিতে নায়েক রাজ্জাককে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখা যায়।
বিজিবি’র কর্মকর্তারা মনে করেন, মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর এমন আচরণ অপেশাদারিত্বের বহিঃপ্রকাশ কিংবা বন্ধু সুলভ রাষ্ট্রের সঙ্গে শোভনীয় নয়। এ ধরনের আচরণের ফলে পরস্পরের মধ্যে বিভ্রান্তি, ভূল বোঝাবুঝি ও অবিশ্বাসের জন্ম দেওয়াসহ সীমান্তে শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় বিঘ্ন ঘটাতে পারে। এছাড়া মিয়ানমারে অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগ এনে নায়েক রাজ্জাককে বিচারের মুখোমুখি করারও চেষ্টা করছে বিজিপি। তারপরও বিজিবি বিষয়টি শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য সর্বোচ্চ ধৈর্যের পরিচয় দিচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সুত্রগুলো জানায়, ইয়াবা চোরাচালানের সঙ্গে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর অনেক শীর্ষ কর্মকর্তাও জড়িত।নাফ নদীসহ আশে-পাশের এলাকায় বিজিবি টহল জোরদার করলে তাদের অবৈধ আয়ের পথ সংকুচিত হয়ে পড়ে। এতেই তারা ক্ষিপ্ত হয়ে বার বার হামলা চালিয়ে বিজিবি সদস্যদের মনোবল ভেঙ্গে দেওয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের ২৭১ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। যার বেশিরভাগই দুর্গম। এ সীমান্ত এলাকায় মিয়ানমার প্রায় প্রতিদিনই নতুন নতুন জটিলতা তৈরি করছে।
মানবপাচার, চোরাচালান ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানা অভিযোগে কয়েক বছর আগে নাসাকা বাহিনী বিলুপ্ত করে বিজিপিকে বাংলাদেশ সীমান্তে মোতায়েন করে মিয়ানমার। কিন্তু খুব কম সময়ের মধ্যেই বিজিপির বিরুদ্ধে ইয়াবা চোরাচালানসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ ওঠে।
সীমান্তে কর্মরত সূত্রগুলো আরও জানায়, মিয়ানমার থেকেই মূলত বাংলাদেশে ইয়াবা আসে। যে এলাকায় নায়েক রাজ্জাকসহ বিজিবি’র সদস্যরা আক্রান্ত হয়েছেন, ওই পথেই গত এক বছরে বিজিবি ১২ লাখ পিস ইয়াবা উদ্ধার করেছে। এছাড়া কোস্টগার্ড, র্যাব ও পুলিশ সীমান্তের বিভিন্ন এলাকা থেকে লাখ লাখ পিস ইয়াবা উদ্ধার করে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, একইস্থানে ও সীমান্তপথে ইয়াবা পাচারকারীদের ধরতে গেলে গত বছরের ১৪ অক্টোবর মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা বিজিবি’র ওপর হামলা চালায়। তখন বিজিবি সদস্য সুমনসহ কয়েকজন আহত হন। মিয়ানমার সীমান্তের যে পথ দিয়ে সবচেয়ে বেশি ইয়াবা বাংলাদেশে প্রবেশ করে সেখানেই মিয়ানমার সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিপি’র একটি ক্যাম্প রয়েছে। যার নাম ‘রানাও ক্যাম্প’। সীমান্তে ইয়াবা উদ্ধারে বিজিবি সদস্যরা এগিয়ে গেলেই ওই ক্যাম্প থেকে বিজিবি সদস্যদের লক্ষ করে বার বার গুলি চালানো হয়।
বিজিবি’র নায়েক আবদুর রাজ্জাককে ফেরত দিতেও নানা ছলচাতুরির আশ্রয় নিচ্ছে মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী। একেক দিন তারা একেক রকম বক্তব্য ও তথ্য দিচ্ছে। সর্বশেষ সোমবার দুপুর ২টায় মিয়ানমান কর্তৃপক্ষের কথা হয় বিজিবি’র কর্মকর্তাদের। সমুদ্রপথে মালেয়েশিয়া যাওয়ার পথে মানবপাচারের শিকার হয়ে যারা এখন মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের হাতে রয়েছেন, তাদের সঙ্গে ফেরত দিতে চান নায়েক রাজ্জাককে। কিন্তু মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের এ সিদ্ধান্তে রাজি নয় বিজিবি।
বিজিবি সূত্র জানায়, গত বছরের ২৮ মে বিজিবি’র নায়েক মিজানকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে একই কায়দায় গুলি করে হত্যা করে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি। পরে তার মৃতদেহ হস্তান্তরেও বিজিপি নানা টালবাহানা ও জটিলতার সৃষ্টি করেছিল। তখনও মিজান রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) জঙ্গি উল্লেখ করে তারা বিভিন্ন গণমাধ্যমে অপপ্রচার চালায়। পরে তারা মিজানের লাশ সহজ রাস্তা দিয়ে না দিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্গম এলাকায় হস্তান্তর করে। যেখান থেকে গাড়ি চলাচলের রাস্তায় মিজানের লাশ আনতে বিজিবি’র ১৪ ঘণ্টা সময় লেগেছিল। শুধু তা-ই নয়, মিজানের লাশ আনতে যাওয়ার সময়ও বিজিবি দলের ওপর গুলি করেছিল মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীরা।
নায়েক রাজ্জাকের বিষয়ে বিজিবি’র টেকনাফ সীমান্তে কর্মরত ৪২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু জার আল জাহিদ বলেন, মানবপাচার ও নায়েক রাজ্জাকের ঘটনা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি বলেন, সোমবার তিন দফায় কথা হয়েছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। তারা নতুন করে শর্ত দিচ্ছেন তাকে মংদু সীমান্ত দিয়ে তাকে দেওয়া হবে। কিন্তু একই সঙ্গে তারা মানবপাচারের বিষয়টি এ ঘটনার সঙ্গে যুক্ত করতে চায়।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল জাহিদ আরও বলেন, কোনও শর্ত ছাড়াই কখন কিভাবে নায়েক রাজ্জাককে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করা হবে, বিষয়টি জানাতে তারা মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছেন। এখন তারা মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের জবাবের অপেক্ষায় রয়েছেন।
গত বুধবার ভোর সাড়ে ৫টার দিকে টেকনাফের নাফ নদীর বাংলাদেশ অংশে বিজিবির ছয় সদস্য দুটি নৌকায় করে টহল দিচ্ছিলেন। এ সময় একটি টহল নৌকাকে লক্ষ করে বেসামরিক পোশাক পরিহিত মিয়ানমারের বিজিপি সদস্যরা অতর্কিত গুলি বর্ষণ শুরু করে। আত্মরক্ষার্থে বিজিবিও পাল্টা গুলি চালায়। এ সময় বিজিপির একটি টহল দল নায়েক রাজ্জাককে একটি এসএমজি ও ৩০ রাউন্ড গুলিসহ অপহরণ করে নিয়ে যায়। বিজিপি’র গুলিতে বিজিবি’র সিপাহী বিপ্লব আহত হন। তিনি বর্তমানে চট্টগ্রাম সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন রয়েছেন।