বাংলা জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা হিসেবে চালুর জোরালো দাবি
প্রকাশিত হয়েছে : ৪:২৮:২৪,অপরাহ্ন ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫
নিউজ ডেস্ক :: জাতিসংঘের অষ্টম দাফতরিক ভাষা হিসেবে বাংলা চালুর দাবি জোরালো হচ্ছে। এ দাবির সফল রূপ দিতেই সরকার বিভিন্ন প্রস্তুতি নিচ্ছে। জোর দেয়া হয়েছে অভ্যন্তরীণভাবে সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ব্যবহারের ওপর। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন আইনকে বাংলায় রূপান্তর এবং সরকারি কাজে বাংলা ব্যবহারের লক্ষ্যে প্রশাসনিক পরিভাষা তৈরিসহ অন্যান্য কার্যক্রম এগিয়ে চলছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে বাংলা ভাষা ব্যবহার কাজ শুরু হয়ে গেছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বলেন, “সরকারি কাজের জন্য আমরা একটি পরিভাষা তৈরি করেছি। বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ নামে এ অভিধানে বানানের নিয়ম, প্রশাসনিক পরিভাষা ইত্যাদি থাকবে। এর বাইরে বিভিন্ন আইনের বাংলা অনুবাদের কাজ চলছে। এ নিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ই কাজ করছে।” তিনি বলেন, আমরা বাংলা ভাষার ব্যবহারের জন্য সচিবালয়ের নির্দেশনাও তৈরি করব।
তবে বায়ান্নর মহান ভাষা আন্দোলনের ৬৪ বছর পরও এ আন্দোলনের অকুতোভয় সৈনিকদের একটি সম্পূর্ণ তালিকা আজও তৈরি হয়নি। শুধু তাই নয়, ভাষা সৈনিকদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদারও কোনো ব্যবস্থা হয়নি। এ নিয়ে ভাষা সংগ্রামীদের আক্ষেপ আর অভিযোগের শেষ নেই।
একুশে চেতনা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও ভাষা সৈনিক কামাল লোহানী বলেন, ভাষা সৈনিকদের জন্য রাষ্ট্র নির্ধারিত কোনো মর্যাদা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়নি। তারা মারা গেলে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয় না। ভাতা আর চাকরিতে বিশেষ সুবিধা দেয়ার বিষয়ও নেই। তিনি আরও বলেন, সরকার আজ পর্যন্ত ভাষা সৈনিকদের কোনো তালিকা পর্যন্ত করতে পারেনি। এটা সরকারের অনীহার কারণেই হচ্ছে না বলে মনে করেন তিনি।
১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমাবর্তনে পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা এমন ঘোষণা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে ছাত্ররা না না বলে প্রতিবাদ করেন। মূলত সেখান থেকেই ভাষা আন্দোলনের শুরু। এর পরিণতি লাভ করে ১৯৫২ সালে। ঢাকাসহ সারা দেশে গড়ে ওঠে আন্দোলন। মায়ের ভাষার জন্য বাঙালি অকাতরে প্রাণ দিয়েছে। মূলত ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই বাঙালি সফল স্বাধীকার আন্দোলন করেছে। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘ অধিবেশনে বাংলা ভাষণ দিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্ব দরবারে বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিভিন্ন সময়ে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলায় ভাষণ দিয়েছেন। ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত দিন ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউনেস্কো কর্তৃক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভের পর বাংলার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আরও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩ এবং বাংলা ভাষা প্রচলন আইন ১৯৮৭-এর ৩ ধারা অনুযায়ী দেশের সব সরকারি অফিস, আদালত, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসহ (বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়া) সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু এসব বিষয় কেবল কাগজে-কলমেই পড়ে থাকে। এ কারণে আইন বাস্তবায়নের বিষয়টি হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। হাইকোর্টের একজন আইনজীবী এ বিষয়ে রিট দাখিল দায়ের করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি আদালত রুলনিশি জারির পাশাপাশি অন্তবর্তীকালীন আদেশ দেন। এছাড়া বেতার ও টেলিভিশনে বাংলা ভাষার বিকৃত উচ্চারণ ও দূষণ রোধেও হাইকোর্টের একটি স্বঃপ্রণোদিত রুলসহ নির্দেশনা রয়েছে, যা ২০১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি দেন হাইকোর্ট।
ভাষা সৈনিকদের তালিকা প্রণয়ন, সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার এবং বাংলা ভাষার দূষণ রোধে প্রণয়ন কমিটির সঙ্গে সংযুক্ত আছেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার দুপুরে তিনি বলেন, সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা বাস্তবায়নের বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় যে পরিভাষা কোষ তৈরি করেছে, সেটি আমরা ভেটিং (পরীক্ষা-নিরীক্ষা) করে দিয়েছি। এখন তা প্রচলনের কাজটি তারা করবে। আর ভাষা সৈনিকদের একটি তালিকা করা যায়নি, তা সত্য। তবে এ ব্যাপারে আমরা পরামর্শ দিয়েছি, এতবছর পরে এটি করা দুরূহ। তাছাড়া এতেও মুক্তিযোদ্ধা তালিকার মতো ভুয়া দাবিদার দাঁড়াতে পারে, জাল হতে পারে। তাই আমরাই এটি না করার পরামর্শ দিয়েছি।
এ বিষয়ে ভাষা সৈনিক কামাল লোহানী বলেন, জাল হতে পারে বলে তালিকাটি হবে না- এমন যুক্তিকে আমি সঠিক মনে করি না। আমরা এখনও অনেকে বেঁচে আছি। যাচাই-বাছাই করে এটা করা সম্ভব। তিনি মনে করেন, এই তালিকা প্রণয়নে সরকার আন্তরিক নয়। কেননা, এমন তালিকা করার সক্ষমতা সরকারের রয়েছে। সরকার যদি সব জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেয়, তাহলে তারা তাদের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে একটি খসড়া তালিকা কেন্দ্রে পাঠাতে পারেন। এরপর সেটি যাচাই-বাছাই করে পূর্ণাঙ্গ করা সম্ভব।
শামসুজ্জামান খান বলেন, সরকারিভাবে কোনো তালিকা না থাকলেও ভাষা সংগ্রামীদের যে কোনো তালিকা নেই তা নয়। আহমদ রফিক এবং কামাল লোহানীর নেতৃত্বে ভাষা সংগ্রামী পরিষদ নামে একটি সংগঠন রয়েছে। তাদের কাছে একটি বেসরকারি তালিকা রয়েছে।
এ ব্যাপারে কামাল লোহানী বলেন, ১৯৮৬ সালে সাভার স্মৃতি সৌধে আমরা প্রথম ভাষা সৈনিকদের একটি সম্মেলন করি। ৩ দিনব্যাপী ওই সম্মেলনে প্রায় ৩শ জন এসেছিলেন। তখন প্রত্যেকের ছবিসহ নিবন্ধন করা হয়। কিন্তু সেই তালিকাটি এখন আমার কাছে নেই। আর ছবি যেই ফটো সাংবাদিকের কাছে ছিল তিনি মারা গেছেন। তিনি আরও বলেন, ভাষা আন্দোলনের ৬৪ বছর পেরিয়ে গেছে। এখন আর সরাসরি ভাষা সৈনিক দাবিদার তেমন পাওয়া যাবে না। অনেকেই মারা গেছেন। তাই আমরা বলছি ভাষা সংগ্রামীর কথা। কয়েক বছর ধরে ভাষা সংগ্রামী সমাবেশ করছি। প্রথমবার ৮০-৯০ জন পেয়েছি। এরপর তা কমে ৫০-৬০ জনে দাঁড়ায়। গত বছর ৩৫ জন পেয়েছি।
তবে জানা গেছে, হাইকোর্টের নির্দেশনার পর সরকারিভাবে ভাষা সৈনিকদের তালিকা প্রণয়নের একটা উদ্যোগ নেয়া হয়। ভাষা সৈনিক ও রবীন্দ্র গবেষক আহমদ রফিককে প্রধান করে গঠিত ওই কমিটি কয়েকটি বৈঠকও করে। তবে তারা কাজ আর শেষ করতে পারেননি। এ ব্যাপারে কামাল লোহানী বলেন, আমি যতদূর জানি, একটি দুটি বৈঠক করেছে। কিন্তু তারা তাদের কাজ শেষ করেননি। তবে সরকারি সহযোগিতা পেলে এই কমিটি সফল হতে পারত।
তিনি আরও বলেন, আমি মনে করি, এই তালিকা করার দায়িত্ব সরকারেরই। সংবিধান অনুযায়ী আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলা ভাষা প্রচলনের বিষয়ে আইন রয়েছে। তাছাড়া হাইকোর্ট থেকে ভাষা সৈনিকদের একটি তালিকা প্রণয়ন করতে বলা হয়েছে। কিন্তু এতসবের পরও সেই কাজটি সম্পন্ন করতে পারেনি সরকার। এটা যেমন সংবিধান ও আইন পরিপন্থী, তেমনি আদালত অবমাননার শামিল। -যুগান্তর।