বাংলাদেশের স্বাধীনতা কৃতিত্ব দাবিতে সতর্ক হবে ভারত
প্রকাশিত হয়েছে : ২:৫০:৫৯,অপরাহ্ন ১৫ জুন ২০১৫
নিউজ ডেস্ক::
ঢাকা সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পাকিস্তান সংক্রান্ত মন্তব্য আর তা নিয়ে বিস্তর কূটনৈতিক জলঘোলার পর ভারত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ সৃষ্টির কৃতিত্ব দাবি করা হয় – এমন যে কোনও ধরনের বক্তব্য থেকে সরকারের মন্ত্রী-কর্মকর্তারা সম্পূর্ণ বিরত থাকবেন। তবে পাকিস্তানের তোলা আপত্তির জেরে নয়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার স্বতঃপ্রণোদিতভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে; বাংলাদেশের সংবেদনশীলতাকে মর্যাদা দিতেই।
জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকা সফর থেকে ফিরে তাঁর সচিবালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যে পর্যালোচনা বৈঠক করেছেন, সেখানে তিনি নিজেই স্পর্শকাতর প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন। তিনি সেখানে বলেন, ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর নীতি নির্ধারক থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলে তিনি অনুধাবন করেছেন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা নিয়ে সে দেশে একটা তীব্র ‘সেনসিটিভিটি’ আছে যেটার মর্যাদা দেওয়া উচিত ভারতের স্বার্থেই।
মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে ভারতের ভূমিকা ছিল সহযোগী শক্তির – একটি মুক্তিকামী দেশের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় ভারত কেবল সামরিক ও কূটনৈতিক সহায়তা জুগিয়েছিল– আর তাই নরেন্দ্র মোদি চান ভারত সরকারের দায়িত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তিদের কথাতেও ঠিক সেটুকুরই প্রতিফলন হোক, তার বেশিও নয় বা কমও নয়!
আসলে এটা এখন সবারই জানা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সামনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন তার কোনও কোনও অংশ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে রীতিমতো প্রতিবাদ হয়েছে। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের অনেকেই মনে করছেন, নরেন্দ্র মোদির বক্তব্যে এই প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত ছিল যে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির কৃতিত্ব আসলে ভারতেরই। পাশাপাশি পাকিস্তানও মি. মোদির বক্তব্যকে লুফে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ জানাতেও দেরি করেনি– তারা বলেছে একটা দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার পর তা নিয়ে অন্য দেশ যে গর্ব করতে পারে সেটা অভাবনীয়!
ইঙ্গিতটা অতি স্পষ্ট– একাত্তরের যুদ্ধ ছিল পাকিস্তানের ঘরোয়া বিষয়, সেখানে অনৈতিকভাবে নাক গলিয়ে তার এত বছর পর ভারত আবার তার জন্য মহান সাজার চেষ্টা করছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেই সঙ্গেই জুড়ে দিয়েছে একটা হুঁশিয়ারি– ‘বন্ধুপ্রতিম’ বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের মধ্যে এভাবে ফাটল ধরানোর ভারতীয় কারসাজি কিন্তু আদৌ সফল হবে না!
পাকিস্তান কী ভাবল, তা নিয়ে নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদির বিশেষ মাথাব্যথা না থাকলেও বাংলাদেশেও যে সেই দেশ সৃষ্টির কৃতিত্ব দাবি নিয়ে কিঞ্চিৎ অভিমান ও অনুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, সেটা কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে যারপরনাই বিচলিত করেছে। আর সে কারণেই, গত ৬ ও ৭ জুনের সেই ঐতিহাসিক সফর থেকে ফেরার সপ্তাহ ঘোরার আগেই তিনি সেই সফরের ‘রিভিউ মিটিং’ সেরে ফেলেছেন। সেখানে নিজেই দিয়েছেন এই মহা গুরুত্বপূর্ণ ‘ফিডব্যাক’। যে ফিডব্যাকের মোদ্দাকথাটা হল, বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রাখতে গেলে কোলাকুলিটা হতে হবে সমানে-সমানে। ভারত ছিল বলেই বাংলাদেশের জন্ম সম্ভব হয়েছে, এমন কোনও লঘু চালের বারফট্টাইয়ের সেখানে ঠাঁই হতে পারে না।
আসলে একাত্তরের যুদ্ধকে বাংলাদেশের দৃষ্টি থেকে দেখার চেষ্টা ভারতের শাসক শ্রেণির মধ্যে এত কাল কমই হয়েছে। সেই যুদ্ধকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধর বদলে ‘তৃতীয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ’ হিসেবে দেখার চল, হালের বলিউড ছবি গুন্ডে-ও তার চেয়ে অন্যরকম কিছু ভাবেনি। এমন কী মুক্তিযুদ্ধের মাত্র অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশে কীভাবে ভারতবিরোধী মানসিকতা বৃদ্ধি পেল, তা বিচলিত করেছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকেও।কিন্তু সেটা দূর করার জন্য তিনিও বিশেষ কোনও পদক্ষেপ নেননি, বা নানা কারণে নিতে পারেননি।
২০০৭ সালে উত্তরপ্রদেশে একটি নির্বাচনি জনসভায় গিয়ে ঝুলি থেকে বেড়ালটা বের করে দিয়েছিলেন ইন্দিরার নাতি, গান্ধী পরিবারের রাজপুত্র রাহুল গান্ধী স্বয়ং! তখন আমেথির নবীন এমপি রাহুল বলেছিলেন, ‘আমাদের পরিবার একবার যা বলে, সেটাই করে দেখায়। সে ভারতের স্বাধীনতাই হোক, পাকিস্তানকে দুটুকরো করাই হোক বা ভারতকে একুশ শতকে নিয়ে যাওয়াই হোক!’ সোজা কথায়– পাকিস্তানকে দুটুকরো করাটা নেহরু-গান্ধী পরিবারের এজেন্ডাতেই ছিল, বাংলাদেশ ঘটনাচক্রে তার ‘বাইপ্রোডাক্ট’ মাত্র! রাহুল গান্ধীর সে মন্তব্য নিয়ে বাংলাদেশে তখন বিশেষ প্রতিবাদ হয়নি কেন কে জানে, কিন্তু একাত্তরের যুদ্ধ নিয়ে ভারতের ‘পলিটিক্যাল ফার্স্ট ফ্যামিলি’র ভাবনাটা কী সেটা বুঝতে কোনও অসুবিধা হয়নি।
ফলে নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরেও ভারতের সেই প্রচ্ছন্ন অহমিকার যদি কোনও প্রতিফলন ঘটে থাকে, তাহলে অবধারিতভাবে সেটা দিল্লির গত চুয়াল্লিশ বছর ধরে লালিত একটা উন্নাসিকতারই প্রকাশ। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত বিচক্ষণ। তাই প্রথমবার ঢাকা সফরে গিয়েই তিনি বুঝেছেন এতে কোনও কাজের কাজ তো হচ্ছেই না, বরং ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে আমদানি হচ্ছে অহেতুক অস্বস্তির। আর সে কারণেই তাঁর স্পষ্ট নির্দেশ- মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাংলাদেশের সংবেদনশীলতার মর্যাদা দেবে ভারত, কোনওভাবেই বাংলাদেশ সৃষ্টির কৃতিত্ব দাবি করবে না।
গত ৭ জুন রাতে ঢাকা থেকে এয়ার ইন্ডিয়ার বিশেষ বিমানে দিল্লি ফেরার পথেই নরেন্দ্র মোদি তাঁর কর্মকর্তাদের বলেছিলেন, ‘আমাদের বাংলাদেশ চ্যাপ্টার কিন্তু শেষ নয়, বরং সবে শুরু! বন্ধুত্বের সেই নতুন সূচনা মুক্তিযুদ্ধের দুই শরিক কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই করবে।’ আপাতত এটাই ভারতের প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার।
সূত্র : ট্রিবিউন