বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক ভারতীয়রা কাশ্মিরের স্বাধীনতায় নারাজ কেন: অরুন্ধতীর প্রশ্ন
প্রকাশিত হয়েছে : ৩:০৮:২১,অপরাহ্ন ২৫ মার্চ ২০১৯
নিউজ ডেস্ক:: কাশ্মির সংকট নিয়ে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরাকে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ঐতিহাসিক ভূমিকার প্রসঙ্গ সামনে এনেছেন বিশ্বখ্যাত লেখক ও অ্যাকটিভিস্ট অরুন্ধতী রায়। ২২ মার্চ (শুক্রবার) কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার আপফ্রন্ট অনুষ্ঠানে তিনি ৭১ সালে সংঘটিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংস গণহত্যার কথা তুলে ধরেছেন।
পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রক্রিয়ায় ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সামরিক যুদ্ধের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে অরুন্ধতী প্রশ্ন তুলেছেন, গণহত্যার পাটাতনে দাঁড়িয়ে ভারতবাসী যদি পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে নিজ দেশের হস্তক্ষেপকে সমর্থন করে এবং তখনকার পূর্ব বাংলার মানুষের বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথক রাষ্ট্র গড়ার পক্ষে দাঁড়ায়, তাহলে কাশ্মির প্রশ্নে তাদের অবস্থান ভিন্ন কেন।
এ বছর ১৪ ফেব্রুয়ারির (বৃহস্পতিবার) কাশ্মিরের পুলওয়ামায় ভারতীয় ‘সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্সের’ (সিআরপিএফ) গাড়িবহরে আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে দায় স্বীকার করে পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন জইশ-ই মোহাম্মদ। জবাবে ২৬ ফেব্রুয়ারি (মঙ্গলবার)পাকিস্তানের মাটিতে বিমান হামলা চালায় ভারত। পরদিন ২৭ ফেব্রুয়ারি (বুধবার) সকালে নিজেদের সীমানায় দুটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে পাকিস্তান।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর প্রথমবারের মতো পাল্টাপাল্টি বিমান হামলায় দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা ও সংঘাত বাড়তে থাকে। এখনও সেই পরিস্থিতি পুরোপুরি শান্ত হয়নি। কাশ্মিরকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার এই সংঘাতময় বাস্তবতা নিয়ে আলোচনা করতেই আল-জাজিরার সাংবাদিক মেহেদি হাসানের সঞ্চালনায় আপফ্রন্ট অনুষ্ঠানে অংশ নেন অরুন্ধতী।
সাংবাদিক মেহেদি কাশ্মির নিয়ে অরুন্ধতীর অবস্থান জানতে চাইলে, বুকারজয়ী এই লেখক বলেন, কাশ্মির সেভাবেই পরিচালিত হওয়া উচিত, যেভাবে সেখানকার মানুষ চায়। এরপর আবার তাকে প্রশ্ন করা হয়, একটি গণভোটের মধ্য দিয়ে কাশ্মিরবাসী যদি ভারত-পাকিস্তান উভয় রাষ্ট্রের থেকে পৃথক হয়ে সার্বভৌমত্ব ও আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চ্ইত,ভারতীয় নাগরিক হিসেবে অরুন্ধতী তা সমর্থন করতেন কিনা।জবাবে অরুন্ধতী কাশ্মিরের সঙ্গে প্রতিতুলনার স্বার্থে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালিন ভারতীয় মিত্র বাহিনীর ভূমিকার প্রসঙ্গ টেনে আনেন।
১৯৭১ এ বাংলাদেশের (তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তান) মানুষ যখন পাকিস্তানের উপনিবেশিক শাসন-শোষণ থেকে নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র গড়ে তোলার সংগ্রাম করছে, তাতে আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্ণাঙ্গ সমর্থন দেয় ভারত। ৩ ডিসেম্বর আচমকা বিমান হামলার শিকার হয়ে ভারত ওইদিনই বাংলাদেশের মুক্তি বাহিনীর সমর্থনে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করে তৎকালিন ইন্দিরা গান্ধীর সরকার।
মিত্র বাহিনী পরিচয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাদের জাতি-মুক্তির লড়াইয়ে সামিল হয়। তার বহু আগেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংস গণহত্যার কবল থেকে বাঁচতে বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ ভারতে পালিয়ে গেলে সে দেশের মানুষ তাদের সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে বিপুল পরিমাণ শরণার্থীর সহায়তায় বাড়িয়ে দিয়েছিল বন্ধুত্বের হাত। তবে একই সেই ভারতীয়তাই কাশ্মিরে সংঘটিত নিজ দেশের সেনাবাহিনীর নৃশংস ভূমিকা নিয়ে সোচ্চার নয়।
আল-জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কাশ্মিরবাসীর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে নিজের অবস্থান জানাতে গিয়ে অরুন্ধতী জানান, অঞ্চলগত অখণ্ডতা রক্ষার প্রশ্নকে ‘বৈজ্ঞানিক সত্য’র মতো করে দেখেন না তিনি। ১৯৭১ সালে সংঘটিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘ভারতীয়রা যদি বিশ্বাস করে, বাংলাদেশের প্রশ্নে ভারতের হস্তক্ষেপ [অর্থাৎ] তখনকার পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নকরণ প্রক্রিয়ায় [যুক্ত] হওয়া সমর্থনযোগ্য… যেখানে ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত হচ্ছে, সেখানে [ওই হস্তক্ষেপ] একেবারেই যথাযথ, তাহলে কাশ্মির প্রশ্নে তাদের অবস্থানের ন্যয্যতা কী।’
১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থনে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার দুই সপ্তাহের মাথায় ১৬ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল এএকে নিয়াজি আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। পৃথিবীর বুকে স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আবির্ভাব ঘটে। কমবেশি সব ভারতীয়ই পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশের পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার বাস্তবতাকে সমর্থন করে। তবে সেই ভারতীয়দের বেশিরভাগই কাশ্মিরের বিচ্ছিন্নতার বিপক্ষে।