বাংলাদেশও ইবোলা ঝুঁকির বাইরে নয়
প্রকাশিত হয়েছে : ৯:২৩:৫৮,অপরাহ্ন ২০ নভেম্বর ২০১৪
নিউজ ডেস্ক::
এবছরের শুরুর দিকেই পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতে ইবোলা সংক্রমণের শুরু। সেখানে মহামারী আকার ধারণ করে হাজার হাজার মৃত্যুর পর এখন তা ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বব্যাপী। স্পেন, যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরবের পর এবার ইবোলা আক্রান্ত রোগী সনাক্ত হয়েছে প্রতিবেশী দেশ ভারতে। দেশের মানুষের মাঝে আতঙ্কের সৃষ্টি হওয়া এখন খুব স্বাভাবিক। অনেকের কপালেই ভাঁজ ফেলেছে এই ভাইরাস।
গত ১০ নভেম্বর দিল্লি বিমানবন্দরে লাইবেরিয়া থেকে ফেরা ২৬ বছর বয়সী এক যুবকের দেহে ইবোলা সনাক্ত হয়েছে। তার রক্তে এই ভাইরাসের সন্ধান না পাওয়া গেলেও মূত্র আর শুক্রাণুতে পাওয়া গেছে। জানা গেছে, সে লাইবেরিয়াতে থাকা অবস্থাতেই আক্রান্ত হয় এবং সেখানেই তার চিকিৎসা সম্পন্ন হয়। কিন্তু তারপরও তার দেহে রয়ে গেছে প্রাণঘাতী ইবোলা। শেষ খবর অনুযায়ী, বর্তমানে তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
এবছর মার্চে প্রথম গিনিতে ইবোলাকে ‘মহামারী’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। জারি করা হয় জরুরি সতর্কতাও। এরপরই একে একে তা ছড়িয়ে পড়ে সিয়েরা লিওন, লাইবেরিয়াসহ পশ্চিম আফ্রিকার বেশ কিছু দেশে। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে সংক্রমণের ভয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয় সীমান্ত। তবু থামিয়ে রাখা যায়নি ইবোলাকে। গত আগস্টে সংবাদ মাধ্যমে খবর হয় সৌদি আরবে ইবোলা আক্রমণের বিষয়টি। সিয়েরা লিওন ও নাইজেরিয়ায় ভ্রমণের পর এক সৌদি নার্স এবং এক ব্যক্তি মারা যাওয়ার খবর আসে। এছাড়া অপর এক ব্যক্তির মারা যাওয়ার খবরও পাওয়া যায়। তবে তখনই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইবোলায় আক্রান্ত নিহতের পরিসংখ্যানের সাথে ওই মৃত্যুর ঘটনা সংযুক্ত করেনি। সৌদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, নার্সের নিহত হওয়ার খবর সেদিনই আসে, যেদিন নাইজেরিয়ায় আরো পাঁচজন ইবোলায় আক্রান্ত হওয়ার খবর আসে।
এর পরপরই যুক্তরাষ্ট্রেও ইবোলার সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়। সিয়েরা লিওনসহ পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা সেবা দিতে যাওয়া কয়েকজন ডাক্তার, নার্স এবং স্বেচ্ছাসেবী সংক্রমিত হন। বাধ্য হয়ে বিশেষ সতর্কতার অংশ হিসেবে ইবোলা আক্রান্ত রোগী অথবা সন্দেহজনক ব্যক্তিদের নিবিড় পর্যবেক্ষণের আওতায় থাকতে হবে। এদিকে গত আগস্টের প্রথমার্ধে লাইবেরিয়া থেকে ঘুরে যাওয়া এক স্প্যানিশ ব্যক্তিও সংক্রমিত হয়ে পড়েন ইবোলায়। তাকে ‘ইউরোপের প্রথম ইবোলা আক্রান্ত ব্যক্তি’ বলে আখ্যায়িত করে দেশটির সরকার।
এবার ভারতে প্রবেশের মধ্য দিয়ে ইবোলা প্রবেশ করলো দক্ষিণ এশিয়াতে। ইবোলা সংক্রমণ মহামারী আকার ধারণ করার পর থেকেই বাংলাদেশে বিশেষ সতর্কতা নেওয়া হয়েছে। গত অক্টোবরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম সাংবাদিকদের জানান, দেশের বন্দরগুলোতে মনিটরিং কার্যক্রম জোরালো করা হয়েছে।
কোনোভাবেই যেন এই ভাইরাস দেশে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য সরকার সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় আছে। বন্দরগুলোতে মনিটরিং ব্যবস্থা আগামী কয়েক মাস অব্যাহত থাকবে বলেও জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী। সেসময় তিনি আরো জানান, বিমানবন্দরে বিদেশি ও প্রবাসীদের দেশে ফেরার পর স্বাস্থ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা জোরদার করা হবে।
অপরদিকে গত ২০ অক্টোবর প্রাণঘাতি ইবোলা ভাইরাস শনাক্ত করতে বিমানবন্দরসহ দেশের সব বন্দরে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি মো.জাহাঙ্গীর হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
এরপরও খবরে উঠে আসে, ইবোলা সংক্রমণ ঠেকাতে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য বিমানবন্দরে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা থাকলেও সেখানে স্থাপিত মেডিকেল সেন্টার তাদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা করার বিষয়টি। আর এর ফাঁক দিয়েই লাইবেরিয়া, সিয়েরা লিওনসহ মধ্য আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশ থেকে সম্প্রতি দেড় শতাধিক বাংলাদেশি দেশে ঢুকে পড়েছেন কোনোরকম কোনো স্বাস্থ্য পরীক্ষা ছাড়াই।
জানা যায়, লাইবেরিয়া ও সিয়েরা লিওনে বাংলাদেশের এনজিও ব্র্যাক ২০০৬ সাল থেকে কৃষি, স্বাস্থ্য ও ঋণদান কর্মসূচী শুরু করেছিল। ইবোলা ভাইরাসে অসংখ্য লোক মারা যাওয়ার খবরে প্রাণভয়ে লাইবেরিয়া ও সিয়েরা লিওনে ব্র্যাকে কর্মরত বাংলাদেশের ৬৮ কর্মকর্তা-কর্মচারী দেশে ফিরে আসেন। লাইবেরিয়া থেকে আসা ও ব্র্যাকের ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক (পশু সম্পদ) মো. রাজিবুল কাদের ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে সেসময় বলেন, লাইবেরিয়া ও সিয়েরা লিওনে ইবোলা ভাইরাস ভয়াবহ আকার ধারণ করায় সেখানকার সরকার জরুরি অবস্থা জারি করে। এতে আমরা বিপাকে পড়ে যাই। পরবর্তীতে আমাদের জীবন বাঁচানোর জন্য ব্র্যাক উদ্যোগ গ্রহণ করে। অতঃপর গত ১৮ আগস্ট ঘানা হয়ে বিশেষভাবে ভাড়া করা টার্কিশ এয়ারে আমিসহ ২২ জন ও ২১ আগস্ট অপর একটি বিমানে ৬ জন ব্র্যাকের-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা লাইবেরিয়া থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসি। একই সময় সিয়েরা লিওন থেকে সেখানে কর্মরত ব্র্যাকের আরও ৪০ কর্মকর্তা-কর্মচারী বাংলাদেশে এসেছেন। তবে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাদের কারো ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন হয়নি বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
এদিকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ইবোলা সংক্রমণের খবর এই মহামারীর আশঙ্কাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। সীমান্ত অতিক্রম করে যেমন বিজিবি-বিএসএফ এর চোখ ফাঁকি দিয়ে এ-পার ও-পার যাওয়ার বিষয়টি বর্তমানে ওপেন সিক্রেট। তারওপর সরকারি এবং বাণিজ্যিক কারণেই ভারত-বাংলাদেশে মানুষজনের যাতায়াত স্বতস্ফূর্ত। এছাড়া গার্মেন্ট খাতসহ বিভিন্ন শিল্পখাতে আফ্রিকার সঙ্গে বাংলাদেশের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যোগ রয়েছে। বাংলাদেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আফ্রিকার নানা দেশের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করে। ক্লাব ফুটবলে আফ্রিকান খেলোয়াড়দের আনাগোনা রয়েছে। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণে উৎসাহী, উদ্যোগ রয়েছে বাংলাদেশের ব্যক্তিখাতের। পশ্চিম আফ্রিকাসহ আফ্রিকা মহাদেশে কৃষি ও শিল্পখাতে বাংলাদেশের ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগের সূত্রেও বাংলাদেশে আফ্রিকার মহাদেশের লোকজনের আনাগোনা বাড়ছে ক্রমান্বয়ে। এর বাইরে দেশি-বিদেশি এনজিওর কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত দেশের ও বিদেশের অনেকেই আফ্রিকায় যাতায়াত করেন কর্মের প্রয়োজনেই। সুতরাং নানাভাবে ইবোলা ঢুকতে পারে বাংলাদেশে। এমতাবস্থায় বলা বাহুল্য, বাংলাদেশও রয়েছে ইবোলা ঝুঁকিতে।
প্রসঙ্গত, গত অক্টোবরে ফাঁস হওয়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে জানা যায়, আফ্রিকায় ইবোলা প্রাদুর্ভাবের ক্ষেত্রে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে সংস্থাটি। ফাঁসকৃত ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ডব্লিউএইচও মার্চে গিনি থেকে প্রথম ইবোলা সংক্রমণের প্রতিবেদন পেয়েছিল। কিন্তু প্রতিবেদন পাওয়ার কয়েকমাস পর এটি প্রতিরোধের প্রচেষ্টায় নামে সংস্থাটি। এপ্রিলে চিকিৎসা বিষয়ক দাতব্য সংস্থা মেডিসিনস স্যান্স ফ্রন্টিয়ার্স (এমএসএফ) ইবোলার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে সতর্ক করেছিল। কিন্তু ওই সময় এমএসএফ’র এই সতর্কতার সঙ্গে দ্বিমত করেছিল ডব্লিউএইচও।
অপরদিকে সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, ১১ নভেম্বর পর্যন্ত পশ্চিম আফ্রিকায় ৫ হাজার ১শ’ ৭৭ জনের মৃত্যু হয়েছে ইবোলা ভাইরাসের আক্রমণে। এর মাঝে ২ হাজার ৮শ’ ১২ জন লাইবেরিয়াতে, ১ হাজার ১শ’ ৮৭ জন সিয়েরা লিওনে, ১ হাজার ১শ’ ৬৬ জন গিনিতে এবং ৮জন নাইজেরিয়াতে নিহত হয়েছেন।
এবার জেনে নেওয়া যাক, ইবোলা কী? ইবোলা ভাইরাস আগে রক্তপ্রদাহজনিত জ্বর (ইবোলা হেমোরেজিক ফিভার) হিসেবেই সমধিক পরিচিত ছিল। ইবোলা মূলত একটি আরএনএ ভাইরাস। ইবোলা ভাইরাস গোত্রের ৫টির মধ্যে ৩টি প্রজাতি মানুষের শরীরে সংক্রমিত হয়ে গুরুতর অসুস্থ করার ক্ষমতা রাখে। বাকি ২টি মানুষের জন্য তেমন ক্ষতিকর নয়। এদের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক হচ্ছে জায়ারে ইবোলা ভাইরাস। জায়ার হলো একটি জায়গার নাম যেখানে সর্বপ্রথম এই ভাইরাসে কোনো মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল। প্রথমবার এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার ছিল শতকরা ৯০ শতাংশ। ভয়াবহ এই ভাইরাসটি মানবদেহে রক্তপাত ঘটায়। লিভার, কিডনিকে অকেজো করে দেয়, রক্তচাপ কমিয়ে দেয়, হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন কমিয়ে দেয় এবং শ্বাস-প্রশ্বাস ব্যাহত করে। ইবোলা ভাইরাস মানবদেহে প্রবেশের পর কয়েকদিন থেকে প্রায় ৩ সপ্তাহ পর্যন্ত কোনো লক্ষণ প্রকাশ না করেই অবস্থান করতে পারে। অর্থাৎ এর লক্ষণসমূহ পরিলক্ষিত হওয়ার জন্য সর্বোচ্চ ২১ দিন লাগতে পারে। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি এই রোগ নিয়ে চলে যেতে পারেন এক দেশ থেকে অন্য দেশে।
ইবোলা আক্রান্ত ব্যক্তি প্রথমে সাধারণত হালকা জ্বর, মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা অনুভব করে। কিছুদিন পর তীব্র মাথাব্যথা, জ্বর, শরীর ব্যথা, ত্বকে দানা দানা ওঠা, মুখে ঘা, ডায়রিয়া এবং মারাত্মক বমি শুরু হতে পারে। চূড়ান্ত পর্যায়ে শরীরের ভেতরে বাইরে রক্তপাত শুরু হতে পারে। এই ভাইরাসটি আক্রান্ত ব্যক্তির লিভার, কিডনি, হার্ট অকেজো করে দেয় যার ফলে রোগীর মৃত্যু ঘটে।
বলা হয়ে থাকে বাদুড়ের খাওয়া ফল থেকেই ইবোলা ভাইরাস মানুষের দেহে প্রথম প্রবেশ করে। এবং পরবর্তীতে তা মানুষ থেকে মানুষে ছড়াতে শুরু করে। ইবোলা আক্রান্ত মানুষের দেহরস অপর কোনো মানুষের স্পর্শে এলে সেই ব্যক্তিও আক্রান্ত হতে পারেন। এমনকি আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুর পরও ভাইরাসটি বেশ কয়েকদিন টিকে থাকে। আক্রান্ত ব্যক্তির সরাসরি সংস্পর্শে না আসলে এই রোগে সংক্রমিত হবার ভয় নেই।
উল্লেখ্য, এর আগে ২০০২ এবং ২০০৩ সালের মাঝে কঙ্গোতে একবার ইবোলা ভাইরাসের আক্রমণ হয়। সেবারও আক্রান্তদের ৯০ ভাগই মৃত্যুমুখে পতিত হয়। ১৯৭৬ সালের পর এপর্যন্ত ইবোলা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে নিহতের পরিমাণ শতকরা ৬০ থেকে ৬৫ ভাগ।