‘বঙ্গবন্ধু বিচ’ নামকরণে দোষী কে, শাস্তি কী?
প্রকাশিত হয়েছে : ৯:৩৩:১৪,অপরাহ্ন ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
কক্সবাজারে সুগন্ধা সৈকতের নাম ‘বঙ্গবন্ধু বিচ’ করার ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তাকে শাস্তিস্বরূপ ভর্ৎসনা করে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়েছে। তবে একজন কর্মকর্তাই নন বরং যেসকল কর্মকর্তা ফাইলে সই করেছেন তারা প্রত্যেকেই দায়ী এবং এক্ষেত্রে শুধুমাত্র ভর্ৎসনাতেই শাস্তি শেষ হওয়া উচিৎ নয়, গুরু শাস্তি হওয়া দরকার বলে মনে করছেন সাবেক আমলারা।
মো. আবদুল্লা আল আমীন
গত ৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা সন্তান সংসদ নামের একটি সংগঠনের সভাপতি মো. সোলায়মান মিয়া মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে দেয়া এক চিঠিতে কক্সবাজারের সুগন্ধা সমুদ্র সৈকতের নাম ‘বঙ্গবন্ধু বিচ’ এবং সুগন্ধা ও কলাতলী বিচের মাঝখানের জায়গাটিকে বীর ‘মুক্তিযোদ্ধা বিচ’ নামকরণের দাবি জানান।
ওই দিনই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক সচিবকে মার্ক করে চিঠিতে স্বাক্ষর করেন।
এর ১০ দিনের মাথায় গত ১৯ ফেব্রুয়ারি এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব মো. সাহেব উদ্দিন চিঠি পাঠান।
সুগন্ধা বিচকে বঙ্গবন্ধু বিচ নামকরণের নির্দেশনার বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। জাতির পিতার সম্মানে ক্ষুদ্র এই পয়েন্টের নামকরণ নিয়ে দেশজুড়ে সমালোচনার জন্ম নেয়।
এর প্রেক্ষিতে গত রোববার (২৫ ফেব্রুয়ারি) একই কর্মকর্তা স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে নামকরণের নির্দেশনা বাতিল করা হয়।
নতুন বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, পূর্বে পাঠানো (১৯ ফেব্রুয়ারি) নির্দেশনার ওপর কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ না করার জন্য নির্দেশনাক্রমে অনুরোধ করা হলো। একইসঙ্গে পূর্বে পাঠানো পত্রটি বাতিল হলো।
পরদিন সোমবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এ ঘটনায় জড়িত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়েছে। আমরা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
বিচের নাম পরিবর্তনের দায় কার?
নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্তের পর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ১৩তম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নামকরণের বিষয়ে সুপারিশ করা হয়। তবে এই খবরটি মিথ্যা এবং বানোয়াট বলে জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন বিভাগের যুগ্ম সচিব রথীন্দ্র নাথ দত্ত।
তিনি জানান, সংসদীয় কমিটির কোনো সভায় থেকে এই ধরনের সিদ্ধান্ত আসেনি। অতিরিক্ত সচিব নিজেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এ ধরণের ঘটনায় কে বা কারা দায়ী সেই প্রশ্নের জবাবে সাবেক শিক্ষা সচিব নজরুল ইসলাম খান সময় সংবাদকে বলেন, ‘মন্ত্রী যখন চিঠিতে সচিবকে মার্ক করেছেন, এরপর ফাইল নিচের দিকের কোনো কর্মকর্তা উপস্থাপন করেছেন। নিশ্চয়ই ফাইল উপস্থাপনের পর বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা ওই ফাইলে স্বাক্ষর করেছেন এবং কোনো এক পর্যায়ে ফাইলটি অনুমোদিত হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘ফাইলে যদি মন্ত্রী অনুমোদন দিয়ে থাকেন, তবে তিনিও এ বিষয়ে দায়ী। আর যদি মন্ত্রীর নিচের কোনো কর্মকর্তা ফাইলে অনুমোদন দেন তবে এর জন্য দায়ী হবেন ফাইলের উপস্থাপক থেকে অনুমোদনকারী পর্যন্ত সকলেই।’
সাবেক এ আমলা বলেন, ‘শুধুমাত্র সচিবকে মার্ক করার জন্য মন্ত্রীকে দায়ী করা যায় না। কারণ যেকোনো আবেদনেরই একটি ব্যবস্থা নিতে হবে। মন্ত্রী যেহেতু চিঠিতে ব্যবস্থা নিতে বলেননি, শুধু মার্ক করেছেন সেক্ষেত্রে ফলাফল কী হবে সেটা আইনি বিচার-বিশ্লেষণের পর সিদ্ধান্ত হবে। ফলাফল পজিটিভ কিংবা নেগেটিভ যেকোনো কিছুই হতে পারে। সুতরাং চিঠিতে স্বাক্ষরকারী নন বরং ফাইলে স্বাক্ষরকারী এবং অনুমোদনকারীরাই দায়ী হবেন।’
তবে নিচের দিকের কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে উপরের দিকে যারা ফাইলে সই করেছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
ফাইলে স্বাক্ষরের বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. এনায়েত হোসেন বলেন, ‘ফাইলে কে কে স্বাক্ষর করেছেন সেই বিষয়ে আমি জানি না। মন্ত্রী মহোদয় পর্যন্ত ফাইল এসেছিল কি না সেই বিষয়েও আমি জানি না। তবে এ ঘটনায় দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তি প্রক্রিয়াধীন আছে।’
ফাইল উপস্থাপনের পর কাকে মার্ক করা হয়েছিল সেই বিষয়ে জানতে সহকারী সচিব মো. সাহেব উদ্দিনকে একাধিকবার কল দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন বিভাগের যুগ্ম সচিব রথীন্দ্র নাথ দত্ত সময় সংবাদকে বলেন, ‘ফাইলে কে কে স্বাক্ষর করেছেন সেই বিষয়টি আমি বলতে পারব না। তবে এ বিষয়ে ঘটনার সময় যিনি সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন তাকে ভর্ৎসনা করে কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করা হয়েছে।’
তিনি আরও জানান, ওই সময়ে মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন বিভাগের অতিরিক্ত সচিব কামরুন নাহার সচিবের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছিলেন। তাকেই দেয়া হয়েছে কারণ দর্শানোর নোটিশ।
তবে কারণ দর্শানোর নোটিশ পর্যন্তই শাস্তি শেষ নয় বলেও জানান তিনি।
বঙ্গবন্ধুর নামে কোনো কিছু করতে গেলে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের অনুমোদন প্রয়োজন। তবে এ বিষয়ে অনুমোদন নেয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান।
বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের অনুমোদন ছাড়া ফাইলটি কীভাবে অনুমোদন পেল এবং ফাইলটি কি নিজেই অনুমোদন দিয়েছিলেন নাকি মন্ত্রীর অনুমোদন নেয়া হয়েছিল সে বিষয়ে কামরুন নাহারের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে বলেন, আমি কিছুক্ষণ পরে বিষয়টি নিয়ে কথা বলব। তবে এরপর তাকে কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
নজরুল ইসলাম খান বলেন, এ ধরনের ঘটনায় শুধুমাত্র একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়া ঠিক নয়। যেসকল কর্মকর্তা ফাইলে সই করেছেন তাদের প্রত্যেককেই শাস্তির আওতায় আনা উচিত। ভর্ৎসনাসহ কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদানই শাস্তির শেষ নয়। কারণ দর্শানোর পর কর্তৃপক্ষ যদি দায়ীদের গুরু শাস্তি দিতে চায় সেক্ষেত্রে তদন্ত কমিটি গঠন করবে। আর যদি লঘু শাস্তি দিতে চায় সেক্ষেত্রে ভর্ৎসনা করে ছেড়ে দিতে পারে।
ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা এড়াতে গুরু শাস্তি হওয়া উচিত বলেও মত দেন সাবেক এই আমলা।
এর আগে গত জুলাই মাসে সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা লঙ্ঘন করায় ওএসডি হন এই মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব খাজা মিয়া। তিনি দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে নিজ এলাকা নড়াইল-১ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাওয়ার ঘোষণা দিয়ে প্রচারণা চালান। অথচ তার চাকরির মেয়াদ তখনও ছিলো এক বছর। গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুযায়ী কোনো সরকারি কর্মকর্তার অবসর নেয়ার পর তিন বছর পার হওয়ার আগে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ নেই।
এদিকে ছোটখাটো বিষয়ে জাতির পিতাকে জড়িয়ে পক্ষান্তরে তার মহত্ত্বকে ছোট করা হচ্ছে বলে সামাজিক মাধ্যমে সমালোচনা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগের ভেতরেও অস্বস্তি আছে। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা সময় সংবাদকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সবাই নিজেকে বঙ্গবন্ধুর সৈনিক প্রমাণে উঠে পড়ে লেগেছে। প্রশাসনে এটা আরও বেশি দেখা যাচ্ছে। প্রশাসনের কিছু কিছু কর্মকর্তার অতি উৎসাহী বক্তব্য নিয়ে আগেও সমালোচনা হয়েছে। এগুলো বন্ধ হওয়া দরকার।