ফরিদপুরে পদ্মার চরে সৌর বিদ্যুতে আলোকিত দুই সহস্রাধিক পরিবার
প্রকাশিত হয়েছে : ১০:৩২:৪৭,অপরাহ্ন ২৩ জানুয়ারি ২০১৫
নিউজ ডেস্ক::
ফরিদপুরের মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন পদ্মার চরাঞ্চলের মানুষের একমাত্র ভরসা সৌর বিদ্যুৎ। কয়েক বছর ধরে দূর্গম এই চরাঞ্চলের দুই হাজারেরও বেশি পরিবার সৌর বিদ্যুতের সুবিধা নিয়ে তাদের জীবনমান পরিবর্তন করছে।
জেলার সদর ও চরভদ্রাসন উপজেলার পদ্মার চরাঞ্চলের সাতটি ইউনিয়নের ১শটির বেশি গ্রামে পৌঁছে গেছে সৌর বিদ্যুতের সুবিধা। একবিংশ শতাব্দীর এই আধুনিক যুগেও বিদ্যুত সরবরাহ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলের এই সুবিধা বঞ্ছিত মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়েছে সৌর প্যানেল। মাত্র সাড়ে তিন হাজার টাকায় সৌর বিদ্যুতের একটি ইউনিট দিয়ে দুটি পরিবারের বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ হচ্ছে। এই প্রযুক্তি দিয়ে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালিয়ে পড়াশোনা ও সংসারের দৈনন্দিন কাজ করছে চরাঞ্চলের মানুষ। তারা এখন ঘরে বসেই দেখছে টেলিভিশনে দেশ-বিদেশের খবর এমনকি মোবাইল ফোনের চার্জ দেয়ার বিড়ম্বনা থেকেও মুক্তি মিলেছে তাদের। কেরসিনের কুপির বদলে এখন ওই অঞ্চলের শিশু-কিশোররা বিদ্যুতের ঝলমলে আলোতে মনের আনন্দে পড়াশোনা করছে। স্থানীয় একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা একেকে সৌর বিদ্যুতের এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
নর্থচ্যানেল ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য লিপি বেগম জানান, আমরা চরের মানুষ কখনো ভাবিনি চরাঞ্চলে বিদ্যুতের ব্যবস্থা হবে। সৌর বিদ্যুৎ আমাদের অন্ধকার থেকে আলোর পথে এনেছে। এ অঞ্চলের সুবিধা বঞ্চিত শিশু-কিশোররা কেরসিনের কুপির পরিবর্তে এখন সৌর বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হচ্ছে।
নর্থচ্যানেল চরের মধ্যে তিনটি একচালা টিনের ঘরে শেফালী বেগমের সংসার। এর মধ্যে দুটি থাকার ও একটি রান্নাঘর। তাঁর স্বামী নিজাম শেখ দিনমজুর। তাঁদের মেয়ে শারমিন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। শারমিন বলে, ‘আগে একটু রাত হলেই পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে হতো। এখন সোলার বিদ্যুৎ নেওয়ার পর অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করতে পারছি।’
একই গ্রামের নাসরিন বেগম জানান, কেরোসিন তেল কিনতে না পারলে সন্ধ্যার আগে খাওয়া দাওয়া শেষ করে সারা রাত অন্ধকারে শুয়ে থাকতে হতো। এখন তেল কিনতে হয় না। রাতে বাচ্চারা পড়াশোনা করতে পারছে, কাঁথা সেলাইসহ নানা ধরনের কাজও করা যাচ্ছে।
গ্রামের মসজিদের ইমাম মাওলানা শরিফুল ইসলাম বলেন, আগে মাইকে আযান দিতে পারতাম না। এ বিদ্যুৎ নেওয়ার পর সে সমস্যার সমাধান হয়েছে। শিশুরা রাতে মাদ্রাসায় পড়াশোনা করতে পারছে।
নর্থ চ্যানেল ইউনিয়নের ইমারত মাতুব্বরের ডাঙ্গি গ্রামের বিলকিস বেগম জানান, দুই বছর আগে বাড়িতে সোলার বিদ্যুৎ নেওয়ার পর থেকে চোর-ডাকাত, সাপের ভয় নেই। রাইতে অসুস্থ মানুষ এক ঘর থেকে আরেক ঘরে আগে যেতে পারতো না, সৌর বিদ্যুতের কারনে রাতে এখন চলাফেরায় কোনো সমস্যা হয়না।
মুদির দোকানদার শেখ বাদশা বলেন, সোলার বিদ্যুৎ নেওয়ার পর এখন রাত ১১-১২টা পর্যন্ত দোকান করতে পারছি। আয়রোজগারও আগের থেকে অনেক বেশি হয়। ফরিদপুরের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আমরা কাজ করি (একেকে) জার্মানির সহায়তায় দুইটি উপজেলার চরাঞ্চলে সোলার প্যানেল বসানোর কাজ করছে। এ পর্যন্ত ২ হাজার ৬৫টি পরিবারকে সৌরবিদ্যুতের সংযোগ দিয়েছে সংস্থাটি।
একেকের নির্বাহী পরিচালক আবদুল জলিল জানান, একটি সোলার সিস্টেমের পেছনে খরচ হয় ২৫ হাজার ৫শ টাকা। জার্মান দাতা সংস্থা আন্দ্রেরী হিলপির সহযোগিতায় মাত্র তিন হাজার ৫শ টাকার বিনিময়ে গ্রামের মানুষকে তারা এই প্যানেল দিচ্ছেন। সংযোগ দেওয়ার আগে ব্যবহারকারীদের তিন দিনের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। তিনি বলেন, তিন বছর মেয়াদী এই প্রকল্পের দ্বিতীয় দফার মেয়াদ চলতি বছরের ডিসেম্বরে শেষ হবে।
সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য শহীদ মোল্লা বলেন, আগে এলাকার মানুষ বিকেলে রান্না করত এবং সন্ধ্যার মধ্যে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তো। সৌর বিদ্যুৎ ব্যবস্থা চালু হওয়ায় শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করতে পারছে। এ ছাড়া টেলিভিশন দেখারও সুযোগ পাচ্ছে।
ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক সরদার সরাফত আলী দূর্গম চরাঞ্চলে মানুষের সৌর বিদ্যুতের সুবিধা প্রসঙ্গে বলেন, চর এলাকায় বিদ্যুৎ পৌছানো ব্যয়বহুল, তাই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতায় পদ্মার চরের মানুষের মাঝে সৌর প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুত সরবরাহ করা হয়েছে। এতে ওই অঞ্চলের মানুষের জীবন মানের পরিবর্তন ঘটছে। তিনি আরো বলেন, যে সকল পরিবার এখনো সৌর বিদ্যুতের সুবিধা পায়নি, শীঘ্রই তাদেরও সৌর বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হবে।