প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীদের প্রমোদভ্রমণ বন্ধ হবে কি ?
প্রকাশিত হয়েছে : ১১:১৪:০৩,অপরাহ্ন ১৬ নভেম্বর ২০১৪
মাঈনুল ইসলাম নাসিম: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ‘বিশাল বহর’ নিয়ে বিদেশ সফর করেন তখন তাঁর সফরসঙ্গীদের একটি বড় অংশ ভিনদেশের মাটিতে কী করেন, কোথায় যান, কীভাবে সময় কাটান, কারা তাদের সঙ্গ দেন এবং কেন দেন – এসব নিয়ে বিস্তারিত জানার সুযোগ হয় না বাংলাদেশের খেটে খাওয়া মানুষের। সফরসঙ্গী রথী-মহারথী কিছু কর্পোরেট সাংবাদিক তাদের চাটুকারিতার পাইপলাইন ক্লিয়ার রাখতে অন্ধকার জগতের অনেক কিছুই চেপে যান বলে অভিযোগ।
আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে দেশের স্বার্থ রক্ষায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রের প্রয়োজনেই বিদেশ সফর করবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এমপি-মন্ত্রী, সরকারী আমলা, ব্যবসায়ী-সাংবাদিক এমনকি দলীয় পরিচয়ে সুবিধাভোগী নেতাদের ‘নেত্রীর সাথে’ বিদেশ ভ্রমণের হিড়িক সাম্প্রতিককালে বেড়েছে আশংকাজনক হারে। সফর চলাকালীন সময়ে অত্যন্ত স্বল্প ও সীমিত সংখ্যক দায়িত্ববান কর্মকর্তারা যখন ‘অফিসিয়াল শিডিউল’ সামাল দিতে গলদঘর্ম হন, ঠিক তখনই ডেলিগেশনের বহু লোকজন হয় শপিংমলে কেনাকাটায় ব্যস্ত থাকেন নয়তো প্রবাসী পাতি নেতাদের লংড্রাইভের যাত্রী হন।
রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা জলে ঢালার বিষয়টি নিয়ে এর আগেও বহুবার বলাবলি হয়েছে, কিন্তু ক্রমাগত পঁচনশীল কানে পানি যায়নি এক ফোটাও। এই প্রতিবেদক গত প্রায় ২০ বছর ইউরোপে স্থায়ীভাবে বসবাসকালীন সময়ে বহুবার খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন অপ্রিয় সব সত্য। কখনো নিরীহ দর্শক হিসেবে কখনো সংবাদকর্মী হিসেবে লক্ষ্য করা গেছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সরকারী সফরসঙ্গীদের অর্ধেকের বেশিই আদৌ যাননা সম্মেলন স্থলে এবং গেলেও প্রথমদিন সকালে গিয়ে শুধুমাত্র গলায় ঝোলাবার জন্য কার্ড উঠিয়ে রীতিমতো সটকে পড়েন অজানা গন্তব্যে।
ব্যবসায়ীরা নিজেদের পয়সায় প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হলেও বিদেশে এসে ‘মেইড ইন বাংলাদেশে’-এর জন্য তথা বাংলাদেশের ‘ট্রেড এন্ড কমার্স প্রমোটিং’-এ ব্যস্ত সময় পার করেননা বললেই চলে। ‘প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী’ – এই স্ট্যাটাসটির জন্যই যেন তাদের বিদেশ সফরের নামে পকেট খালি করা। দেশের স্বার্থে নিবেদিতপ্রাণ এমন দু’একজন ব্যবসায়ী এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হলেও তারা সংখ্যায় ‘মাইনোরিটি’ বৈ অন্য কিছু নন। এতো গেলো ব্যবসায়ীদের কথা, এবার আসা যাক সরকারী আমলা ও ক্যাডার রাজনীতিকদের আমলনামায়।
প্রধানমন্ত্রীর সাথে বিগত বছরগুলোতে বহুবার বিদেশ সফর করেছেন এমন একজন সরকারী প্রভাবশালী কর্মকর্তা সম্প্রতি ছুটি কাটাতে সপরিবারে ইউরোপ ভ্রমণে এসেছিলেন। একান্ত আলাপচারিতায় এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী সরকারী লোকজনের প্রতি ৩ জনের ১ জনই বেহুদা বিদেশ সফর করেন। প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে সম্যক অবগত আছেন এবং সব জেনেও কোন অ্যাকশনে তিনি যেতে পারছেন না কারণ বিশেষ সিন্ডিকেটের কাছে তিনি স্থায়ীভাবে ধরাশায়ী”। বিদেশ সফরে রাজনৈতিক বিবেচনায় অন্তর্ভুক্ত হবার বিষয়টি আরো নেক্কারজনক হিসেবে ঠেকেছে ব্যাপক অনুসন্ধানে।
সারা জীবন দলের জন্য ‘লাইফ কোরবান’ করেছেন বলেই জাতিসংঘের সাধারন অধিবেশনে ‘নেত্রীর সফরসঙ্গী’ হবেন – এ যেন কোন নতুন বিষয় নয় আজ বাংলাদেশে। ইংরেজিতে কথা বলতে পারুক আর নাই পারুক, ইউরোপীয় কোন সম্মেলনে ‘ডেলিগেট’ হবার যোগ্যতা যেন আজ বাংলার রাজপথের ‘লড়াকু সৈনিক’ হিসেবে কে কতটা সফল। চাটুকারিতা আর তোষামোদীই আজ সবার মূলমন্ত্র। আসলেই ‘সেলুকাস’ ! কি বিচিত্র আমাদের বাংলাদেশ। টুকটাক ‘হিউম্যান ট্রাফিকিং’-এর মতো লাভজনক ধান্ধাও হয় হরহামেশা প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফরকে ঘিরে।
এই প্রতিবেদক কয়েক বছর আগে সুইডেনে স্বচক্ষে দেখেছেন মহিলা লীগের নেত্রী পরিচয়ে ঢাকা থেকে আসা কয়েকজন নারীকে, যারা প্রধানমন্ত্রী স্টকহল্মে অবস্থানকালীন সময়েই গাড়িতে চেপে ইউরোপের অন্য একটি দেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন স্থায়ীভাবে বসবাসের আশায়। ঐ সময় টার্গেট মিস হয়নি কথিত নারী নেত্রীদের। পরবর্তিতে জানতে চাইলে তারা বলেছিলেন, “আমরা একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলায় আহত হয়েছিলাম, এজন্য প্রাণপ্রিয় নেত্রী আমাদেরকে সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন”। শুধু এই ক্যাটাগরির লোকজনই নন, বাংলাদেশের থানা পর্যায়েরও বহু নেতাদের প্রায়শঃই দেখা যায় বিভিন্ন দেশে প্রধানমন্ত্রীর ‘সরকারী সফরসঙ্গী’ হতে।
অবিশ্বাস্য হলেও আরও সত্য যে, প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফরকালীন দিনে যা ঘটছে এত্তোসব, রাতে কিন্তু আছে আরেক জগত। সফরসঙ্গীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের (সবাই নন) লাল-নীল বাতিতে হারিয়ে যাওয়া বহু বছর আগে থেকেই যেন অনেকটা ‘পান্তাভাত’। কর্মকর্তা-আমলা ব্যবসায়ীদের অনেককেই দেখা গেছে ‘ভিন্ন স্বাদ’-এর নেশায় মধ্যরাতে নাইটক্লাবে দৌড়ঝাপ করতে, ঘাম ঝরাতে। দেশের নিত্যদিনের ‘নিরামিষ’ স্বাদের পর একটু বৈচিত্রের সন্ধানে তারা বিদেশে এসে সবই করেন ফ্রি স্টাইলে। দুই ধরণের খেলা চলে এক্ষেত্রে।
প্রথমতঃ প্রবাসী পাতি নেতাদের মধ্য থেকে মুখচেনা কয়েকজন আছেন যারা যখন যে দেশে প্রয়োজন ‘স্যার’ বা ‘লিডার’-এর মনোরঞ্জনের জন্য তাদেরকে হোটেল রুমে শুধু বড় বড় লেবেল-বোতলই পৌঁছে দেন না, প্রয়োজনে নিজেদের গাড়ি বা ট্যাক্সিতে করে ‘নাইট’ এমনকি ‘প্রাইভেট’ আস্তানায়ও পৌঁছে দেন। প্রবাসী নেতাদের এক্ষেত্রে পকেট খালি হলেও বিনিময়ে তদবিরবাজীতে কিছু ধান্ধাও সেরে নেন তারা সুকৌশলে। প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী কর্মকর্তা-আমলা ব্যবসায়ীদের একটি অংশ রয়েছেন যারা তাদের ‘রিক্রিয়েশন ট্যুর’ সফল করতে প্রবাসী নেতাদের ধার ধারেন না।
বারবার বিদেশ সফর এবং ‘সেক্স ট্যুরিজম’-এ অভিজ্ঞ এরা নিজেদের ‘প্রাইভেসি’ সম্পর্কে দারুন সচেতন এবং নিজেদের উদ্যোগেই ট্যাক্সি ভাড়া করে ‘এনজয়’ করেন তাদের মূল্যবান(!) সময়। পাঠক, অনিচ্ছা সত্বেও আজ এমন এক সময় অবতারণা করতে হলো অপ্রিয় সব সত্যের, যখন দেশের মতো বিদেশেও আজ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন ‘বঙ্গবন্ধু কন্যা’। তাঁরই মাথায় কাঠাঁল ভেঙ্গে খাওয়া লোকদের চরিত্র কতটা ‘ফুলের মতো পবিত্র’, তা জানার অধিকার নিশ্চয়ই আপনার-আমার রয়েছে।
সফরসঙ্গী করার নামে রাজনৈতিক বিবেচনায় দলীয় লোকদের ‘পুরষ্কৃত’ করার চলমান ‘ট্রেডিশন’ এবং ব্যবসায়ীদের ‘সেক্স ট্যুরিজম’ বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি আজ কোথায় নিয়ে ঠেকাচ্ছে, তা তোষামোদীতে নিমজ্জিত চাটুকারদের মাথার ঘিলুর সাথে ‘এডজাস্ট’ হবে না, এটাই স্বাভাবিক। তারপরও সত্য বলে শত্রু হওয়া কি কম গৌরবের ?