পলাতক ফাঁসির আসামি খোকন রাজাকার ‘সুইডেনে’
প্রকাশিত হয়েছে : ১১:৫০:০৭,অপরাহ্ন ১৩ নভেম্বর ২০১৪
স্টকহোম: ফরিদপুরের নগরকান্দার রাজাকার কমাণ্ডার পলাতক ফাঁসির আসামি জাহিদ হোসেন খোকন সুইডেনের স্টকহোমে রয়েছেন বলে জানিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশি রাহাত নেওয়াজেশ।।
তিনি বলছেন, স্টকহোমে বড় ছেলে ও মেয়ের সঙ্গে বহাল তবিয়তেই আছেন খোকন। আনুষ্ঠানিক কোনো তথ্য না থাকলেও ট্রাইব্যুনালের একজন প্রসিকিউটরও একই কথা বলেছেন।
খোকন স্টকহোমের একটি মেট্রো স্টেশনের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন- এমন একটি ছবিও এসেছে সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট ফেইসবুকে। তবে পুলিশ বলছে, তাদের হাতে খোকন রাজাকারের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো তথ্য নেই।
একাত্তরে হত্যা, গণহত্যা ও ধর্ষণের মতো যুদ্ধাপরাধের দায়ে নগরকান্দা পৌরসভার সাবেক মেয়র ও বিএনপি নেতা খোকনকে বৃহস্পতিবার মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
২০১২ সালে এ মামলার তদন্ত শুরু হলে আত্মগোপনে যান পৌর মেয়র হিসাবে শপথ নেওয়া খোকন।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাকে গ্রেপ্তারে ব্যর্থ হওয়ায় আদালতের নির্দেশে তাকে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। তাতেও সাড়া না পেয়ে তার অনুপস্থিতিতেই বিচার শেষ করে ট্রাইব্যুনাল।
১৯৯৩ সাল থেকে সুইডেন প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিক আমিনুল এহসান বলেন, “জাহিদ হোসেন খোকন সুইডেনে তার মেয়ের সাথে থাকছেন। তার জামাই বদিউজ্জামান বদির সাথে ব্যক্তিগত চেনা জানা থাকায় বেশ কয়েকবার তাদের বাসায়ও গিয়েছি। খোকন সাহেবকে আমি সেখানেই দেখেছি।”
খোকনের বড় ছেলে খায়রুজ্জামান লিংকনও স্টকহোমে থাকেন। সুইডেন যুবদলের সাধারণ সম্পাদক তিনি।
খোকনের স্ত্রী আম্বিয়া বেগম, মেজ ছেলে লেলিন ও ছোট ছেলে পলিন দেশে থাকলেও নগরকান্দা পৌর শহরে নিজেদের তিন তলা বাড়িতে থাকেন না। নগরকান্দায় এই পরিবারটি বিপুল পরিমাণ জমিজমার মালিক বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানান।
আমিনুল এহসান বলেন, “সুইডেনে আসার পর প্রথম প্রথম খোকন সাহেব টুকটাক লোকজনের সাথে মেলামেশা করতেন। কিন্তু এখন খুব একটা বের হন না। তিনি যেহেতু বুঝতে পেরেছেন যে একটা সমস্যা চলছে, এ কারণে নিজেকে কিছুটা গুটিয়ে রেখেছেন।”
ফরিদপুরের নগরকান্দার মোতালেব মিয়া ও জয়নব বেগমের দুই ছেলে দুই মেয়ের মধ্যে জাহিদ হোসেন খোকন দ্বিতীয়। তার বড় ভাই জাফর হোসেনও একাত্তরে একজন রাজাকার কমান্ডার ছিলেন, যিনি চাঁদহাটের যুদ্ধে ধরা পড়ে জনতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের পিটুনিতে নিহত হন।
ট্রাইব্যুনালের মামলায় প্রসিকিউশনের প্রথম সাক্ষী মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেমের জবানবন্দি থেকে জানা যায়, ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে ওই এলাকায় জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী ছিলেন মাওলানা মোহাম্মদ আলী। জাহিদ হোসেন খোকন ও তার বড় ভাই জাফর হোসেন সে সময় মোহাম্মদ আলীর পক্ষে কাজ করেন।
একাত্তর সালের ২১ এপ্রিল নগরকান্দায় পাকিস্তানি বাহিনী এলে খোকন ও তার ভাই জাফর তাদের অভ্যর্থনা জানায়। এরপর জাফরের নেতৃত্বে একটি এবং মাওলানা আবুল কালামের নেতৃত্বে আরেকটি মুজাহিদ বাহিনী গঠন করা হয়।
এ দুই বাহিনী পরে নগরকান্দার হিন্দুদের এবং আওয়ামী লীগ নেতা ও সমর্থকদের বাড়ি-ঘর লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, নারী ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধে লিপ্ত হয় বলে আদালতকে জানান কাশেম।
স্থানীয়দের তথ্য অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় খোকন ছিলেন আনসার সদস্য। আনসার বাহিনীর প্রশিক্ষণ কাজে লাগিয়ে নগরকান্দার রাজাকার বাহিনীকে সুসংগঠিত করে তোলেন খোকন ও তার ভাই জাফর।
আর এ কাজে তারা জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের কাছ থেকেও সহযোগিতা পেতেন। পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে সে সময় খাড়াদিয়ায় নিজস্ব বাহিনী গড়ে তোলেন বাচ্চু, যা ‘খাড়াদিয়ার মিলিটারি’ নামে পরিচিতি পায়।
যুদ্ধাপরাধের দায়ে বাচ্চু রাজাকারকেও মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত। খোকনের মতো তিনিও পলাতক।
প্রসিকিউশনের তদন্ত সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ২৯ মে চাঁদহাটে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের বড় ধরনের যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে জাফর নিহত হলে তার ভাই খোকন নগরকান্দা রাজাকার বাহিনীর প্রধান হন।
নগরকান্দা সদরের কোদালিয়া-শহীদনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা মো. রফিকুজ্জামান অনু বলেন,“জাহিদ হোসেন খোকন বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ্যেই বলেছেন যে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার কমান্ডার ছিলেন। এ নিয়ে তার মধ্যে এক ধরনের গর্ববোধও ছিল।”
স্বাধীনতার পর খোকন আত্মগোপনে যান এবং ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর খোকন এলাকায় ফেরেন।
সাংবাদিক ও কলাম লেখক আবু সাঈদ খানের লেখা মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস- তৃতীয় খণ্ডে বলা হয়, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে জাহিদ হোসেন খোকনের বিরুদ্ধে দালাল আইনে একটি মামলাও দয়ের করা হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধের আগে জামায়াতঘনিষ্ঠ জাহিদ হোসেন খোকন বিএনপির রাজনীতিতে জড়ান জিয়াউর রহমানের আমলে। সর্বশেষ তিনি নগরকান্দা পৌর বিএনপির সহ-সভাপতি হন। সেই সূত্রে ২০১১ সালে নগরকান্দা পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন তিনি।
এরই মধ্যে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে তদন্ত শুরু হলে খোকন আত্মগোপনে যান। ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরুর পর সরকার তাকে মেয়র পদ থেকে বরখাস্ত করে।
খোকনের মামলায় ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল বলেন, “আমাদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো তথ্য নেই। তবে যতদূর জানতে পেরেছি, সে বর্তমানে সুইডেনে আছে।”
ফরিদপুরের পুলিশ সুপার জামিল হাসান জানান, রায় ঘোষণার পর তারা খোকনের অবস্থান জানার চেষ্টা করেছেন।
“তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। সম্ভবত তিনি দেশের বাইরে রয়েছেন।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, খোকন রাজাকার দেশের বাইরে থাকলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।
এদিকে প্রবাসী সাংবাদিক ফজলুল বারী বৃহস্পতিবার ফেইসবুকে একটি ছবি পোস্ট করেছেন। তিনি লিখেছেন, গত ২০ ফেব্রুয়ারি সুইডেনের ব্রিড্যানগভাগেন মেট্রো স্টেশনে খোকন রাজাকারের ওই ছবি তোলেন রাহাত নেওয়াজেশ।
স্টকহোমের ব্রিড্যানগভাগেনে মেয়ের বাসায় খোকন থাকেন জানিয়ে ফজলুল বারী লিখেছেন, “গত মেয়র নির্বাচনে অংশগ্রহণ, শপথ নেবার পর কার কার সহায়তায় সে কীভাবে পালিয়েছে, সে জবাব কে দেবে?”