‘নাস্তিক’ নিধনে তৎপর আত্মগোপনে থাকা জঙ্গিরা
প্রকাশিত হয়েছে : ৮:৫৬:৩৮,অপরাহ্ন ০৬ এপ্রিল ২০১৫
নিউজ ডেস্ক::
গ্রেফতারের পর জামিনে মুক্তি নিয়েই লাপাত্তা হয়ে গেছেন বেশিরভাগ জঙ্গি সদস্য। আত্মগোপনে গিয়ে অনেকেই কথিত ‘নাস্তিক’ নিধনে জঙ্গি গ্রুপগুলোর স্লিপার সেলের কিলিং মিশনে অংশ নিচ্ছে বলে তথ্য রয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে। ২০১৩ সালে ব্লগার রাজীব হত্যার পর থেকে এ পর্যন্ত যে ২৩ জঙ্গি সদস্য গ্রেফতার হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি জসিম উদ্দিন রাহমানীসহ সাতজন রয়েছেন কারাগারে। অপর ১৬ জনই জামিনে মুক্তির পর গা ঢাকা দিয়েছেন।
গোয়েন্দারা জানান, কথিত নাস্তিক নিধনের নামে ২০১৩ সালের ১৪ জানুয়ারি রাজধানীর উত্তরায় ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিনের ওপর হামলা চালায় আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের স্লিপার সেলের সদস্যরা। ঘাড়ে ও পিঠে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে হত্যার চেষ্টা চালায় তারা। গুরুতর আহত হলেও ওই যাত্রায় তিনি প্রাণে বেঁচে যান। পরে তিনি জার্মানিতে চলে যান। বর্তমানে তিনি সেখানেই আছেন। আসিফ মহিউদ্দিন হত্যা চেষ্টা মামলাটির তদন্তে তার স্বজনদের সহযোগিতা পাচ্ছেন না বলে অসন্তোষ প্রকাশ করেন তদন্ত কর্মকর্তা ও গোয়েন্দা পুলিশের ইন্সপেক্টর নিবারণ চন্দ্র বর্মণ।
আসিফ মহিউদ্দিনের ওপর হামলার ঠিক একমাস পর ১৪ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পল্লবী থানার মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনের পলাশ নগরের বাসার সামনে ব্লগার রাজীব হায়দারকে কুপিয়ে হত্যা করে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের জঙ্গিরা। ব্লগার রাজীব হায়দার হত্যা মামলাটির বিচার শুরু হয়েছে গত মাসে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, আসিফ মহিউদ্দিনের ওপর হামলা ও ব্লগার রাজীব হায়দারকে হত্যার পর গোয়েন্দারা উগ্র ধর্মীয় মতবাদে বিশ্বাসী জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, হরকাতুল জিহাদ ও আইএস-এর ২৩ জঙ্গিকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দারা। কিন্তু স্বল্প সময়ের ব্যবধানে তাদের বেশিরভাগই জামিনে মুক্তি নিয়ে আবার জঙ্গি গ্রুপগুলোর সমন্বিত কিলার বাহিনী ‘স্লিপার সেলে’র সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে।
জামিনে মুক্তি নিয়েই জঙ্গিরা ২০১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর রাজধানীর রামকৃষ্ণ মিশন রোডে গোপীবাগের ৬৪/৬ নম্বর চারতলা বাড়ির দ্বিতীয় তলার বাসায় কথিত পীর লুৎফর রহমানসহ ছয়জনকে গলা কেটে হত্যা করে। এরপর ২০১৪ সালের ২৭ আগস্ট রাতে পূর্ব রাজাবাজারের বাসায় চ্যানেল আই’র কাফেলা অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীকে গলা কেটে হত্যা করে জঙ্গিরা।
সর্বশেষ গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে আটটার সময় সময় ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায়কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি’র মোড়ে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করে জঙ্গিরা। তার এক মাসের ব্যবধানে গত ৩০ মার্চ রাজধানীর বেগুনবাড়ির দিপীকার মোড়ে প্রকাশ্য দিবালোকে ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকেও একই কায়দায় কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
গোয়েন্দা সূত্রগুলো আরও জানান, নতুন জঙ্গিদের কাছে ‘বড় ভাই’ হিসেবে পরিচিত রেদোয়ানুল আজাদ রানা, আবু নায়না ও আবদুল্লাহ সব সময়েই থেকেছেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এ পর্যন্ত কখনই এই তিন জঙ্গির নাগাল পাননি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে রানাকে ধরিয়ে দিতে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হলেও তার আগেই তিনি দেশ ছেড়ে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমিয়েছেন বলে গোয়েন্দারা তথ্য পেয়েছেন। সেখান থেকেই এখন অনুসারীদের কথিত নাস্তিক নিধনে ইন্ধন যোগাচ্ছেন।
ব্লগার অভিজিৎ ও ওয়াশিকুর হত্যাকাণ্ডের পর গ্রেফতারকৃত সবাইকে গোয়েন্দা পুলিশ এর আগে গ্রেফতার করেছিল। পরে তারা জামিনে মুক্তি নিয়ে দুই ব্লগারকে হত্যা করে বলে জানান ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম। তিনি জানান, ব্লগার অভিজিৎ ও ওয়াশিকুর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া শাফিউর রহমান ফারাবী ও আরিফুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। গ্রেফতারের আগে তারা হিযবুত তাহরীর ও জেএমবি’র সঙ্গে যুক্ত থাকলেও পরে তারা প্রত্যেকেই আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে।
মনিরুল বলেন, সর্বশেষ ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া জিকরুল্লাহ ও আরিফুর রহমানের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী আরও কয়েকজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা আবু তাহেরসহ তাদের সবাইকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। দ্রুত স্থান বদলানোর কারণে তাদের গ্রেফতার করা সম্ভব হচ্ছে না।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গত বছর ফেব্রুয়ারিতে ত্রিশালে তিন জঙ্গি সালাউদ্দিন ওরফে সালেহীন, রাকিব হাসান ওরফে হাফেজ মাহমুদ ও জাহিদুল ইসলাম ওরফে বোমারু মিজানকে ছিনিয়ে নেওয়ার অপারেশনে অংশ নেওয়া জঙ্গি ফারুক হোসেন ওরফে আনোয়ার হোসেন ও জাকারিয়াসহ অন্যরা বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হয়েছিল। পরে জাকারিয়া ছাড়া আর কাউকেই পুলিশ ও গোয়েন্দারা এখনও ধরতে পারেনি।
র্যাবের গোয়েন্দা ইউনিটের একটি সূত্র জানায়, আদালত থেকে জামিনে অনেক জঙ্গি বেরিয়ে গেছে। কারাগার থেকে বেরিয়ে তারা আর আগের ঠিকানায় অবস্থান করে না। এজন্য তাদের নজরদারি করাটা একটু কঠিন হয়ে যায়। গত কয়েক বছরে ১৯২ জন জঙ্গি জামিনে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসে। তাদের মধ্যে প্রায় একশ’ জঙ্গির কোনও হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ জানান, পলাতক জঙ্গিদের ধরতে সবসময় র্যাব তৎপর রয়েছে।