দল আর পদ নিয়ে সঙ্কটে রওশন
প্রকাশিত হয়েছে : ৬:৪২:২৭,অপরাহ্ন ০৯ ডিসেম্বর ২০১৪
নিউজ ডেস্ক::
ঘটনাচক্রে বিরোধী দলের নেতার আসনে বসা। হঠাৎ করেই দলের ক্ষমতার কেন্দ্রে আসেন। রাজনীতি থেকে অনেকটাই আড়ালে থাকা রওশন এরশাদের নবরূপে আবির্ভাব নিয়ে আলোচনা ছিল সর্বত্র। আলোচনা ছিল অপ্রত্যাশিত এক বিরোধী দলকে ঘিরে। ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের পর ১১ মাসেরও বেশি সময় পার হয়েছে। এ সময়ে কেমন করেছে বিরোধী দল। কেমনইবা বিরোধী নেতার পারফরমেন্স। এমন আলোচনা খোদ জাতীয় পার্টির মধ্যেই। দলীয় সূত্র বলছে, হঠাৎই ক্ষমতার কেন্দ্রে আসা রওশন এরশাদের সামনে এখন নানামুখী সঙ্কট। দল আর পদ নিয়ে অনেকটা বেকায়দায় তিনি। তার এই পারফরম্যান্সে চরম নাখোশ তাকে এ পদে বসানো কুশীলবরাও।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, চতুর্মুখী সঙ্কটে রয়েছেন নাটকীয়ভাবে ক্ষমতার কেন্দ্রে আসা বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ। কারণ রাজনীতি থেকে অনেকটাই আড়ালে থাকা সাবেক এ ফার্স্ট লেডি তার রুটিন কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছেন। সরকারের ইচ্ছায় বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচিত হলেও গত দশ মাসে দল ও সংসদে তিনি সরব হতে পারেননি। রওশনের এমন নীরবতায় দলের নেতাকর্মীদের মাঝে নেমে এসেছে চরম হতাশা। কারণ যেভাবেই হোক তিনি বিরোধীদলীয় নেতার আসনে যাওয়ায় দল কিছুটা হলেও শক্তিশালী হবে- এমন প্রতাশ্যা ছিল নেতাকর্মীদের। কিন্তু নেতাকর্মীদের সেই স্বপ্ন এখন যেন ফিকে হতে বসেছে।
জানা গেছে, ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের পর গত দশ মাসে সংসদের তিনটি অধিবেশনে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে নিজের শক্তিশালী অবস্থান জানান দিতে পারেননি রওশন এরশাদ। বর্তমান অধিবেশন শুরু হলেও এখনো যোগ দিতে পারেননি তিনি। এছাড়া এ সময় দলের অনেক কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হলেও মাত্র তিনটিতে উপস্থিত ছিলেন তিনি। বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবেও মাত্র তিনটি দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পেয়েছেন। আর গত দশ মাসে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে একবার ও ব্যক্তিগত চিকিৎসার জন্য একবার বিদেশ ভ্রমণ করেছেন তিনি।
রওশনের একাধিক ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন, তিনি ভোরে ঘুম থেকে উঠে নামাজ আদায়ের পর ওজিফা পড়েন। এরপর ১ ঘণ্টা হাঁটেন। ছেলে সাদ এরশাদ ঢাকায় অবস্থান করলে তার সঙ্গেই থাকেন। আর সংসদ অধিবেশন থাকলে অধিবেশন শুরুর আধঘণ্টা আগে বাসা থেকে বের হন। সপ্তাহে তিনদিন নিয়মিত সংসদে যান। এছাড়া সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা এবং সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত খুব ঘনিষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন। তবে আগ থেকেই সচেতনভাবে মিডিয়া এড়িয়ে চলার অভ্যাস এখনো রয়েছে তার। আর রওশনকে যারা বিরোধী নেতার আসনে বসিয়েছেন তাদের অনেকের সঙ্গেই এখন রওশনের সেই সম্পর্কে ভাটা পড়েছে।
এদিকে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে রওশন কেমন আর গত দশ মাসে সংসদে তার কি পারফরম্যান্স ছিল এমন সরব আলোচনা এখন খোদ জাতীয় পার্টির মধ্যেই। নেতাদের মূল্যায়ন, অতি আদরে লালিত-পালিত বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবেও রওশন কোনো কাজ করতে পারেননি। বিশেষ করে নেতাকর্মীদের আশা ছিল রাজপথে সরকারবিরোধী আন্দোলনে যাওয়ার প্রয়োজন না থাকায় এ সুযোগে তিনি অন্তত দলকে শক্তিশালী করতে ভূমিকা রাখবেন। বাইশ বছর ক্ষমতার বাইরে নেতাকর্মীদের কিছুটা হলেও বিভিন্ন চাকরি বাকরিতে প্রমোট করবেন। কিন্ত বাস্তবে কিছুই হয়নি। বরং তিনি বিরোধীদলীয় নেতা হওয়ার পর ভঙ্গুরপ্রায় দল জাতীয় পার্টিতে আরো নতুন করে কয়েকটি ধারা সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে রাতারাতি দলের মহাসচিব পরিবর্তন, সংরক্ষিত মহিলা সংসদ মনোনীত ও সর্বশেষ বিরোধীদলীয় উপনেতা নিয়ে স্বামী এরশাদের সঙ্গে যোজন যোজন দূরত্ব সৃষ্টি করেছেন তিনি। এছাড়া রুহুল আমিন হাওলাদারকে সরিয়ে মহাসচিব হিসেবে নিয়োগ দেয়ার পর এরশাদের সঙ্গে জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে। তাই নতুন এ সমীকরণের ফলে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছে বলেও নানা গুঞ্জন রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলে রওশনপন্থী হিসেবে পরিচিত এক প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, রওশন এরশাদের নবরূপে আবির্ভাব নিয়ে আলোচনা ছিল সর্বত্র। প্রত্যাশা ছিল তার নেতৃত্বে গড়ে উঠেবে এক ভিন্ন ধাঁচের বিরোধী দল। কিন্তু গত দশ মাসে ম্যাডামের ভূমিকায় সে আশায় গুড়েবালি পড়েছে। কারণ তিনি কি দলের উপকার করবেন বরং দশ মাসে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে নিজের অবস্থান জানান দিতে ব্যর্থ হয়ে হঠাৎ করেই ক্ষমতার কেন্দ্রে আসা রওশন এরশাদ নিজেই এখন নানামুখী সঙ্কটে রয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত দশ মাসে জাতীয় পার্টির প্রায় দেড় শতাধিক ছোট বড় দলীয় কর্মসূচি পালিত হয়েছে। এরমধ্যে রাজধানীতে হয়েছে অর্ধেকেরও বেশি কর্মসূচি। কিন্তু দলের সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য ও বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে রওশন মাত্র তিনটি কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি দলের একটি প্রেসিডিয়াম বৈঠক, জাতীয় ছাত্র সমাজের কাউন্সিল ও দলের মহানগর উত্তরের আয়োজনে একটি ইফতার কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছেন। কিন্তু ৩১ অক্টোবর মহানগর উত্তরের আয়োজনে ঈদ পুনর্মিলনী ও ১২ নভেম্বর চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত দলের মহাসমাবেশে যোগ দেয়ার কথা থাকলেও কোনোটিতে যাননি তিনি। এছাড়া দশম সংসদ দশ মাস অতিক্রম করলেও রওশন এরশাদ প্রটোকল অনুযায়ী ঢাকায় বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে রুটিন বৈঠকও করতে পারছেন না।
গত দশ মাসে তিনি মাত্র পাঁচটি দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এর মধ্যে ১ এপ্রিল যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক উন্নয়নবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী অ্যালান ডানকান ও চীনের দু’টি প্রতিনিধি দল তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। এছাড়া গত ১৬ জানুয়ারি বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণ, ২৭ জুন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ও সর্বশেষ গত মাসে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ও যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাইয়ের সঙ্গে তিনি সাক্ষাৎ করেছেন। তবে এর আগে জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা এবং ওআইসির মহাসচিব আয়াদ আমিন মাদানি সম্প্রতি ঢাকা সফরে এলেও জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের সঙ্গে তাদের কোনো সৌজন্য সাক্ষাৎ হয়নি। তবে দুই মাস আগে সৌদি সরকারের আমন্ত্রনে ওমরা পালন করতে সৌদি আরব ও গত সপ্তাহে ব্যক্তিগত চিকিৎসা করাতে সিঙ্গাপুর গেছেন রওশন এরশাদ।
এ ব্যাপারে বিরোধীদলীয় নেতার রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ বলেন, বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে ম্যাডাম তার সবগুলো রুটিন ওয়ার্ক করার চেষ্টা করেন। তবে ব্যক্তিগত কিছু সমস্যার কারণে তিনি দলীয় কর্মসূচিতে কিছুটা কম অংশগ্রহণ করেন।