‘জীবিত অনেককেও জাহাজ থেকে ছুঁড়ে ফেলা হল’
প্রকাশিত হয়েছে : ১২:১৩:৪২,অপরাহ্ন ১৭ মে ২০১৫
নিউজ ডেস্ক::
‘দয়া করে আমাকে ওদের কাছে যাওয়ার সুযোগ করে দিন। খাবার-পানি কিছুই ওদের সাথে নেই। অনাহারে শিগগিরই হয়তো মারা যাবে ওরা।’
এভাবে স্বজনদের বাঁচানোর আকুল আবেদন জানাচ্ছিলেন ৩৭ বছর বয়সী রোহিঙ্গা হাকিম। মালয়েশিয়ায় দুই বছর ধরে কাজ করছেন তিনি। নিজের অভিজ্ঞতা দিয়েই হাকিম জানেন সাগরপথে দালালদের হাতে কতটা নির্যাতনের শিকার হতে হয় অভিবাসীদের। হয়তো তার স্মৃতিপটে ভেসে ওঠা দুই বছর আগের নির্যাতনের সেই চিত্রই তাকে আকুল করে তুলছে আরও।
দুই বছর আগে বাংলাদেশে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর ক্যাম্প ছেড়ে কক্সবাজার থেকে সাগরপথে ঝুঁকিপূর্ণভাবে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান হাকিম। সম্প্রতি মালয়েশিয়া গমনের জন্য হাকিমের সে দেখানো পথই বেছে নেয় তার পরিবারের সদস্যরা। তবে দু বছর আগে হাকিম মালয়েশিয়ায় পৌঁছাতে পারলেও সে সৌভাগ্য হয়নি তার স্বজনদের। মানব পাচারকারীদের ফেলে যাওয়া অন্য অভিবাসীদের সঙ্গেই থাইল্যান্ড উপকূলের কাছে অভিবাসীবাহী একটি নৌকায় আটকা পড়ে আছে তারা।
হাকিম জানান, ফোনে এক আত্মীয়ের সঙ্গে কথা বলে তিনি জানতে পেরেছেন ওই নৌকায় তিনশো যাত্রী ছিল। এরইমধ্যে অনাহার আর তৃষ্ণায় প্রাণ হারিয়েছে অন্তত ২৮ জন। মালয়েশিয়ার সংবাদমাধ্যম দ্য স্টার জানায়, তাদের প্রতিনিধি এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এশিয়ার প্রতিনিধিরা হাকিমের দেয়া টেলিফোন নাম্বারটিতে ফোন করে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিল। তবে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
বাংলাদেশ থেকে কেন মালয়েশিয়া গেলেন হাকিম?
দু’বছরে আগে দালালের খপ্পরে পড়া এবং বিপদ পাড়ি দিয়ে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমানোর সে দুঃসহ স্মৃতিগুলো স্টার অনলাইনকে জানান হাকিম। তিনি বলেন, ‘যখন বাংলাদেশে ছিলাম তখন ওরা আমাকে বললো মালয়েশিয়ায় গেলে আমি অনেক টাকা কামাতে পারব। এখানে এসে চাকরি করে সংসার চালানোর স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল আমাকে।’
হাকিম জানান, পাচারকারীদের যেসব এজেন্ট সাগরপথে বিপজ্জনকভাবে মালয়েশিয়া গমনের জন্য তাকে প্রলুব্ধ করেছিল এবং নৌযানে উঠতে সহায়তা করেছিল কেবল তাদের দিতে হয়েছে ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার মালয়েশিয়ান মুদ্রা।
জাহাজে অভিবাসীদের কী ধরনের নির্যাতনের শিকার হতে হয় তার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লো। তাদের অনেককে জীবিত অবস্থাতেই জাহাজ থেকে ফেলে দেয়া হল।’
রাত ১টা থেকে দুপুর ৩টা পর্যন্ত টানা পায়ে হেঁটে পথ চলা
হাকিমের সঙ্গে একই জাহাজে ছিলেন ১৮ বছর বয়সী বাংলাদেশি নাগরিক রেজাউল। বর্তমানে মালয়েশিয়ায় ওয়েটারের কাজ করে খুব কষ্ট করে জীবন যাপন করেন তিনি। নির্যাতনের বর্ণনা পাওয়া গেলো তার কাছ থেকেও। রেজাউল জানান, ‘অভিবাসীবাহী ওই জাহাজে ৯শ’ মানুষকে গাঁদাগাঁদি করে ঢোকানো হয়েছিল। হোল্ডিং ক্যাম্পে পৌঁছাতে আমাদের তিন মাস লেগে গেল। সেখানে আমাদের প্রত্যেককে ৯ হাজার মালয়েশিয়ান রিঙ্গিট করে দিতে বলা হলো। মাঝে মাঝে লোহার রড দিয়ে পেটানো হতো আমাদের আর প্রতিদিন রাত ১টা থেকে দুপুর ৩টা পর্যন্ত জঙ্গলের ভেতর দিয়ে আমাদের জোর করে হাঁটানো হত। কোন পানি পানেরও সুযোগ ছিল না।’
মেলেনি প্রত্যাশিত চাকরি; কষ্ট আর আতঙ্কের দিন যাপন
হাকিম এবং রেজাউলের মতো যেসব অভিবাসী সাগরপথে মালয়েশিয়ায় এসেছেন তাদের কেউই পাননি প্রত্যাশিত চাকরি। প্রায়ই পুলিশের ধরপাকড়ের শিকার হতে হয় তাদের। ছাড়া পেতে পুলিশকেও দিতে হয় টাকা।
ভালো নেই বৈধ ভিসায় যাওয়া মানুষেরাও
স্টার অনলাইনের প্রতিবেদনে বলা হয়, মালয়েশিয়ায় যারা বৈধ ভিসা নিয়ে প্রবেশ করে তাদের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি খুব একটা সুবিধাজনক নয়। তেমনই একজন বাংলাদেশির নাম রাশেদ। বয়স ২৪ বছর। তিনি জানান, একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করার ভিসার জন্য এক এজেন্টকে ১৫ হাজার মালয়েশিয়ান রিঙ্গিট দেয়া হলেও শেষ পর্যন্ত নির্মাণ শ্রমিকের কাজ পেয়েছেন তিনি।
রাশেদ জানান, ‘আমার চাকরিদাতারা পাসপোর্টটি রেখে দিয়েছে। আমার বর্তমান কর্মক্ষেত্রের সঙ্গে ওয়ার্ক ভিসার কোন মিল নেই। এজন্য বেশ ভোগান্তি পোহাতে হয় আমাকে।’
কোন ধরনের সাপ্তাহিক ছুটি ছাড়া প্রতিদিন ১২ ঘন্টা করে কাজ করতে হয় ৪৫ বছর বয়সী নেপালি নিরাপত্তা রক্ষী জংগা বাহাদুরকে। তিনি জানান, ওয়ার্ক পারমিট থাকার পরও প্রায়সময় তার এবং সহকর্মীদের কাছ থেকে পুলিশ টাকা নিয়ে থাকে। ‘একটি ছোট্ট ঘরে আমরা ৮০ জন মানুষ গাঁদাগাঁদি করে থাকি। এখানকার টয়লেটগুলো নষ্ট। একটি অস্থায়ী বাথরুমে গোসল করে থাকি আমরা।’ বলেন বাহাদুর।
নিজ দেশে ফিরতে চায় না রোহিঙ্গারা
তবে এতো মানবেতর জীবন যাপনের পরও নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার চেয়ে মালয়েশিয়ায় থাকাকেই মঙ্গলজনক বলে মনে করেন অনেক রোহিঙ্গা। আর সে কথাই শোনা গেলো ১৬ বছর বয়সী রোহিঙ্গা সালাউনদিন। আরও ১৩ জন নির্মাণ শ্রমিকের সঙ্গে ২.৪ মিটার চওড়া আর ৬ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি শিপিং কনটেইনারে রাত কাটাতে হয় সালাউনদিনকে। তারপরও মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ফিরে যেতে চায় না সে। ‘অন্তত এখানে আমি বাইরে যেতে পারি। পুলিশ হয়তো আমার কাছে টাকা চায় এখানে। কিন্তু আমার দেশের পুলিশ আরও অনেক খারাপ ‘ক্ষুব্ধ স্বরে বলে সালাউনদিন।