জিহাদকে উদ্ধারে রুদ্ধশ্বাস অভিযান
প্রকাশিত হয়েছে : ১০:২৩:৫৬,অপরাহ্ন ২৬ ডিসেম্বর ২০১৪
অনলাইন ডেস্ক: অন্যদিনের মতো শুক্রবার বিকালে শাহজাহানপুর বালুর মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে খেলছিল সাড়ে ৩ বছরের শিশু জিহাদ। হঠাৎ মাঠের পাশে প্রায় সাতশ’ ফুট গভীর পরিত্যক্ত একটি ১৭ ইঞ্চি ব্যাসার্ধের পানির পাইপের মধ্যে পড়ে যায় সে। মুহূর্তের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায় খেলার সঙ্গী বিল্লাল, মুনসুর আর সেতুদের ছোটাছুটি। ঘটনার আকস্মিকতায় তারাও হতভম্ব হয়ে যায়। খেলার সঙ্গী পড়ে গেছে খোলা পাইপের ভেতর। তার ভেতর থেকে ভেসে আসছে বাঁচাও-বাঁচাও ক্ষীণ শব্দ। খেলার সঙ্গীকে বাঁচাতে ছোট্ট এ শিশুরাও শুরু করে চিৎকার, কান্নাকাটি। ততক্ষণে আশপাশের লোকজন জড়ো হন ঘটনাস্থলে। প্রাথমিকভাবে দড়ি ফেলে ওই পাইপের ভেতর থেকে শিশুটিকে উদ্ধারের চেষ্টাও করেন তারা। জিহাদের বাবা নাসির উদ্দিন মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের নিরাপত্তাকর্মী। তার মা খাদিজা বেগম। বড় বোন স্বর্ণা স্থানীয় একটি স্কুলের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী। মেজ ভাই জিশান (৬) প্রথম শ্রেণীতে পড়ে। তারা শাহজাহানপুর কলোনির ৪১নং ভবনের দোতলায় বসবাস করে।
এদিকে এ ঘটনার খবর পেয়ে একে-একে ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট আসে। ছুটে আসেন র্যাব ও পুলিশের সদস্যরা। উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা নিয়ে হাজার-হাজার মানুষ জড়ো হন সেখানে। ছোট্ট এ শিশুটির জীবন বাঁচাতে প্রার্থনা করেন সবাই। ঘটনাস্থলের পাশে একটি ইসলামী সভায় শিশুটির জন্য বিশেষ মোনাজাতের আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন ওই উদ্ধার অভিযান সরাসরি সম্প্রচার করায় দেশের কোটি-কোটি মানুষ রাত জেগে শ্বাসরুদ্ধকর ওই অভিযান প্রত্যক্ষ করে। সারা দেশের মানুষ ছোট্ট এ শিশুটির জন্য প্রার্থনা করেন। সর্বশেষ প্রায় ১২ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়েও রাত ৩টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত শিশুটিকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তবে রাত দেড়টার দিকে বিশেষভাবে লোহার পাইপ দিয়ে তৈরি ক্যাচারের মুখে ওয়াসার শক্তিশালী ‘বোর হোল’ ক্যামেরার মাধ্যমে শিশুটির অবস্থান চিহ্নিত করা গেছে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলেছেন, শিশুটি বেঁচে আছে এবং ওই ক্যাচারের মাধ্যমে পাঠানো জুস গ্রহণ করেছে জিহাদ। এর আগে পরিত্যক্ত ওই পাইপটি কেটে কেটে ক্রেনের মাধ্যমে টেনে তোলার চেষ্টা করা হয়। ওই চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর রাত ১টার দিকে লোহার পাইপ দিয়ে ক্যাচার তৈরি করে তা পাইপের ভেতরে পাঠানো হয়। ওই ক্যাচারের সম্মুখভাগে একটি ক্যামেরাও পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন উদ্ধার অভিযানে থাকা ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক রফিকুল ইসলাম। এর আগে বশির আহমেদ নামে এক ব্যক্তি শিশুটিকে উদ্ধারের জন্য ওই পাইপের ভেতর নামার ইচ্ছা প্রকাশ করলে প্রথমে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা রাজি হন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে বশির আহমেদকে পাইপের ভেতর নামতে বাধা দেয়া হয়। বশির আহমেদ সাভারে রানা প্লাজা ধসের পর উদ্ধার অভিযানে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেছিলেন। বর্তমানে তিনি এশিয়ার সর্ববৃহৎ শপিংমল যমুনা ফিউচার পার্কের একটি দোকানে কাজ করেন।
যেভাবে ঘটনা : জিহাদের খেলার সঙ্গী মুনসুর জানায়, জিহাদসহ তারা চারজন গোল্লাছুট খেলছিল। বিল্লাল হঠাৎ ধাওয়া দিলে জিহাদ দৌড় দেয়। এ সময় সে মাঠের শেষদিকে ওই পাইপের ভেতর পড়ে যায়। প্রত্যক্ষদর্শী শাহজাহানপুর বালুর মাঠের পাশের মুদি দোকানি সিরাজ মিয়া যুগান্তরকে জানান, তখন বিকাল সাড়ে ৩টা হবে। হঠাৎ কয়েকটি শিশুর চিৎকারে তিনি পরিত্যক্ত ওই পাইপের কাছে ছুটে যান। পাইপের ভেতর থেকে কান্নার শব্দ শুনতে পাওয়ার পর তার আর ঘটনা বুঝতে দেরি হয়নি। সিরাজ মিয়া জানান, তখনও পাইপের ভেতর থেকে শিশুটির বাঁচাও-বাঁচাও ক্ষীণ শব্দ ভেসে আসছিল। সিরাজ মিয়া বলেন, উপস্থিত লোকজন দড়ি ফেলে ওই শিশুটিকে উদ্ধারে চেষ্টা চালান। কিন্তু এত গভীর পাইপের নিচ পর্যন্ত পাঠানোর মতো দড়ি না পাওয়ায় তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
ঘটনার অপর প্রত্যক্ষদর্শী আরিফুল ইসলাম জানান, প্রায় আধ ঘণ্টা পর ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ঘটনাস্থলে এসে উদ্ধার অভিযান শুরু করেন। রাত ৮টার দিকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা অঞ্চলের সহকারী পরিচালক রফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে জানান, শিশুটিকে তারা জীবিত উদ্ধারে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সন্ধ্যা সাড়ে ৯টার দিকেও তিনি শিশুটির কান্নার আওয়াজ শুনেছেন। তাদের ডাকে শিশুটি সাড়াও দিয়েছে। শিশুটিকে ওপর থেকে কয়েক দফা জুস দেয়া হয়েছে এবং সে তা গ্রহণ করেছে। তাকে বাঁচিয়ে রাখতে ওপর থেকে পাইপের মাধ্যমে অক্সিজেনও সরবরাহ করা হচ্ছে বলে জানান রফিকুল ইসলাম।
রশি ফেলে শিশুটিকে উদ্ধারের চেষ্টা : ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) মেজর সাকিল নেওয়াজ জানান, রাত ৮টার দিকে তারা ওপর থেকে চার বার রশি ফেলে শিশুটিকে ওপরে তুলে আনার চেষ্টা চালিয়েছেন। দু’বার রশি ধরেও পরে সে ছেড়ে দেয়। পরে রশির মুখে বস্তা বেঁধে ফের তাকে টেনে তোলার চেষ্টা করা হলেও তাতে কাজ হয়নি। দড়ি দিয়ে বিশেষভাবে তৈরি দোলনা পাঠিয়েও জিহাদকে ওপরে তোলার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কিছুতেই কোন কাজ হয়নি। মেজর শাকিল নেওয়াজ জানান, দীর্ঘক্ষণ অন্ধকার পাইপের ভেতর থাকায় আতংকে শিশুটি দুর্বল হয়ে পড়ায় রশি ধরে রাখতে পারছে না। আর এ কারণে বারবার চেষ্টা করেও তাকে ওপরে তুলে আনা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি জানান, ১৭ ইঞ্চি ব্যাসের ওই পানির পাইপটি কত গভীরে আছে তা কেউ নিশ্চিত করে জানাতে না পারলেও প্রায় ৭০০ ফুট গভীর হবে বলে তারা ধারণা করছেন। ওই ৭০০ ফিট গভীর পাইপের ৬০০ ফিট স্থানে পানি তোলার জন্য স্থাপন করা একটি ছোট্ট মোটরের ওপর শিশুটি রয়েছে বলে তারা ধারণা করছেন।
রাত সাড়ে ৮টার দিকে পরিত্যক্ত ওই পানির পাইপটি টেনে তুলে ফেলার জন্য ফায়ার সার্ভিসের ভারি ক্রেন আনা হয়। রাত সাড়ে ১১টার দিকে তিনটি লোহার পাইপ দিয়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি ক্যাচারের মাধ্যমে শিশুটিকে ওপরে তোলার কাজ শুরু হয়। কিন্তু এ চেষ্টাও বিফলে যায়। ঠিক ওই সময়ে ঘটনাস্থলে আসে বুয়েটের একটি প্রতিনিধি দল। ওই প্রতিনিধি দলের সঙ্গে পরামর্শের পর লোহার তিনটি পাইপ একত্র করে ‘ক্যাচার’ তৈরি করে পানির পাইপের ভেতর পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। ওই ক্যাচারের মুখে একটি শক্তিশালী ক্যামেরা স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়।
শিশুটিকে উদ্ধারে স্বেচ্ছাসেবীরা : শিশু জিহাদকে উদ্ধারের জন্য পানির ওই পাইপের ভেতর নামার ইচ্ছা প্রকাশ করেন বশির আহমেদ নামে এক ব্যক্তি। বশির আহমেদ সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর উদ্ধার অভিযানে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেছিলেন বলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের জানান। ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তাদের বশির বলেন, জীবন বিপন্ন জেনেও তিনি শিশুটিকে উদ্ধারের শেষ চেষ্টা করতে চান। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সহায়তায় তিনি দু’দফা ওই পাইপের ভেতর প্রবেশেরও চেষ্টা করেন। প্রথম দিকে বাধা না দিলেও কয়েক মিনিট পর তাকে পাইপের ভেতর প্রবেশে বাধা দেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা।
এ সময় ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) মেজর সাকিল নেওয়াজ যুগান্তরকে জানান, জেনেশুনে কাউকে নিশ্চিত বিপদের মুখে ফেলে দিতে পারি না। শিশুটিকে বাঁচাতে গিয়ে আরেকজনের জীবন নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া যায় না। পরে বশির আহমেদ জানান, বর্তমানে তিনি এশিয়ার সর্ববৃহৎ শপিংমল যমুনা ফিউচার পার্কের একটি দোকানে কাজ করেন। এর কিছু সময় পর জিয়াউর রহমান নামে আরেক যুবক ওই শিশুটিকে উদ্ধারের জন্য পাইপের ভেতর নামার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তবে তাকেও পাইপের ভেতর নামার অনুমতি দেয়নি ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা।
ওয়াসার ‘বোর হোল’ ক্যামেরা স্থাপনে এক ঘণ্টা : রাত সাড়ে ১১টার দিকে শিশু জিহাদকে উদ্ধারে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি ক্যাচারের সঙ্গে ওয়াসার শক্তিশালী ‘বোর হোল’ ক্যামেরা পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। শিশুটির প্রকৃত অবস্থান এবং কেমন আছে তা জানতে ওই ক্যামেরা পাঠানোর কথা বলেন বিশেষজ্ঞরা। তবে ক্যামেরা স্থাপন এবং তা ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত করতে এক ঘণ্টারও বেশি সময় ব্যয় হয়। রাত ১টার দিকে ক্যামেরাসহ বিশেষভাবে তৈরি ক্যাচার পাইপের ভেতর প্রবেশ করা হয়। রাত দেড়টায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ক্যামেরাটি শিশুটির অবস্থান চিহ্নিত করেছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা ক্যামেরার মাধ্যমে শিশুটিকে জীবিত দেখতে পেয়েছেন। শিশু জিহাদ ক্যাচারের মাধ্যমে পাঠানো জুস নিয়ে তা পান করছে বলেও তারা দেখতে পেরেছেন।
পাম্প হাউস নিয়ে বিতর্ক : এদিকে শাহজাহানপুর বালুর মাঠের পাশে পরিত্যক্ত ওই পাইপটি কোন সংস্থার তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। ঢাকা ওয়াসার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) কামরুল আলম চৌধুরী রাতে বলেছেন, এটি রেলওয়ের জমিতে তৈরি করা ওয়াসার পাম্প। সংশ্লিষ্ট জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী তাকে বলেছেন, ওই এলাকায় তাদের পরিত্যক্ত কোনো পাইপ নেই। প্রায় ৮ বছর আগে রেলওয়ে শাহজাহানপুর কলোনিতে পানি সরবরাহের জন্য এই পাম্পটি বসানো হয়। তবে পানি না উঠায় বছর খানেক আগে এ পাম্পটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে পাশেই নতুন করে আরেকটি পাম্প বসানোর কাজ চলছে। কিন্তু ওই পাইপের মুখ বন্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু কারা কিভাবে মুখ খুলে ফেলেছে তা তারা জানেন না।
প্রধানমন্ত্রীর মনিটরিং : জিহাদ উদ্ধার অভিযানের শুরু থেকেই মনিটরিং করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা পেয়েই ঘটনাস্থলে ছুটে যান স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তার সঙ্গে ছিলেন ডিএমপি কমিশনার বেনজির আহমেদসহ ওয়াসা, সিটি কর্পোরেশন, ফায়ার সার্ভিস ও রেলওয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুরো উদ্ধার অভিযান পর্যবেক্ষণ করছেন এবং প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন।
হিমশিম খাচ্ছে র্যাব-পুলিশ : অভিযানে অংশ নেয়া র্যাব-পুলিশের সদস্যরা জানিয়েছেন, উৎসুক জনতার কারণে পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে র্যাব ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বেশ কয়েক দফা লাঠিচার্জ করেও ব্যর্থ হয়েছেন।
রেলওয়ের প্রকৌশলী বরখাস্ত : পরিত্যক্ত পাইপের মুখ খোলা থাকা এবং এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিকভাবে কর্তব্যে অবহেলার জন্য রেলওয়ের উপ-সহকারী প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলমকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এছাড়া কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে এ পাইপ বসানোর কাজে নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে।