চিঠির বিদায় সম্ভাষনে লেখা হয় ‘From your Valentine’
প্রকাশিত হয়েছে : ৭:০৮:০০,অপরাহ্ন ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫
সাদিকুর রহমান তাজিন::
প্রতি বছর সারা বিশ্বে ১৪ই ফেব্রুয়ারি পালিত হয়। ‘ভালবাসা দিবস’ বা ‘ভ্যালেনটাইন’স ডে’তে সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ তাদের প্রিয়জনকে উপহার ও শুভেচ্ছা বিনিময়ের মাধ্যমে দিনটি উদযাপন করে থাকেন। কিন্তু দিবসটি পালনের মূলে রয়েছে প্রায় সাড়ে সতেরশো বছর পূর্বের একজন রোমান ক্যাথলিক ধর্মযাজক সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের কথা।
প্রায় ২৭০ সালের তখনকার দিনে ইটালীর রোমে শাসন করতেন রাজা ক্লডিয়াস-২। তখন রাজ্যে চলছিলো সুশাসনের অভাব, আইনের অপশাসন, অপশিক্ষা, স্বজন-প্রীতি, দূর্নীতি এবং কর বৃদ্ধি। এতে সাধারণ জনগন ফুঁসছিলো। রাজা ক্লডিয়াস-২ তার সুশাসন ফিরিয়ে থানার জন্য রাজ দরবারে তরুণ-যুবকদের নিয়োগ দিলেন। আর যুবকদেরকে দায়িত্বশীল ও সাহসী করে গড়ে তোলার লক্ষে তিনি রাজ্যে যুবকদের বিয়ে নিষিদ্ধ করলেন। কারন, রাজা বিশ্বাস করতেন বিয়ে মানুষকে দূর্বল ও কাপুরুষ করে।
বিয়ে নিষিদ্ধ করায় পুরো রাজ্য অসন্তোষ সৃষ্টি হলো। এ সময় সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নামক জনৈক যাজক গোপনে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করলেন; তিনি পরিচিতি পেলেন ‘ভালবাসার বন্ধু বা ‘Friend of Lovers’ নামে। কিন্তু তাকে রাজার নির্দেশ অমান্য করার কারনে রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে আটক করা হল। জেলে থাকাকালীন ভ্যালেন্টাইনের সাথে পরিচয় হয় জেল রক্ষক আস্ট্রেরিয়াসের সাথে। আস্ট্রেরিয়াস জানতো ভ্যালেন্টাইনের আধ্যাত্মিক ক্ষমতা সম্পর্কে। তিনি তাকে অনুরোধ করেন তার অন্ধ মেয়ের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিতে। ভ্যালেন্টাইন পরবর্তীতে মেয়েটির দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেন।
এতে মেয়েটির সাথে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। রাজা তার এই আধ্যাতিকতার সংবাদ শুনে তাকে রাজ দরবারে ডেকে পাঠান এবং তাকে রাজকার্যে সহযোগীতার জন্য বলেন। কিন্তু ভ্যালেন্টাইন বিয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা না তোলায় সহযোগীতায় অস্বীকৃতি জানান। এতে রাজা ক্ষুদ্ধ হয়ে তার মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করেন। মৃত্যু দন্ডের ঠিক আগের মূহুর্তে ভ্যালেন্টাইন কারারক্ষীদের কাছে একটি কলম ও কাগজ চান। তিনি মেয়েটির কাছে একটি গোপন চিঠি লিখেন এবং শেষাংশে বিদায় সম্ভাষনে লেখা হয় ‘From your Valentine’ এটি ছিলো এমন একটি শব্দ যা হৃদয়কে বিষাদগ্রাহ করে।
অতঃপর ১৪ ই ফেব্রুয়াররি , ২৭০ ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। সেই থেকে সারা বিশ্বে মানবতার প্রতি দায়িত্বশীলতা ও ভালবাসার জন্য আত্মোৎসর্গে করায়, সেন্ট ভ্যালন্টাইনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পালিত হয় ‘বিশ্ব ভালবাসা দিবস’।
দিবসটি নিয়ে অনেকেই অনেক মতবাদ দিয়েছেন। কারও কাছে এর মহাত্ম বিশাল। কেউ আবার কর্পোরেট ফ্যান্টাসি বলে উড়িয়ে দেন। যে যাই বলুক- সভ্যতার হাত ধরে ভালোবাসা দিবস আজ সারা বিশ্বের প্রেমিক- প্রেমিকার কাছে মহা উৎসবের আয়োজনে পরিণত হয়েছে। আজ ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে বা বিশ্ব ভালোবাসা দিবস’।
প্রতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি পালন করা হয় এই দিনটি। মনের মানুষকে নতুন করে ভাবতে, কাছে পেতে, ভালোবাসতে ভালোবাসা দিবসের তাৎপর্য লিখে প্রকাশ করা যাবে না। ভালোবাসা দিবসের ইতিহাস এ দিনে প্রিয় মানুষটিকে নিয়ে ডেটিং-এ হারিয়ে যেতে চায় সবাই। উপহার আর ভালোবাসার নানা চমকে মুগ্ধ করে রাখতে চান সঙ্গীকে। আবার একঘেয়েমিতার দাম্পত্যেও ভালোবাসা দিবস আসে চৈত্রের খরায় এক পশলা বৃষ্টি হয়েই। মনের কোণে জমা সব হতাশা দূর করে সজীব হয়ে ওঠে স্বামী- স্ত্রীর সম্পর্ক।
পাশাপাশি যিনি প্রেমে পড়বেন বলে ভাবছেন তিনিও ভালোবাসা দিবসে বুকে বেশ বল পান, নতুন পরিকল্পনা সাজান পছন্দের মানুষকে বশে আনার। তবে অনেকেই হয়তো জানেন না কি করে এলো এই ভালোবাসা দিবস? ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় এই দিবসের উৎপত্তি বা প্রচার নিয়ে নানা মতানৈক্য। একেক ইতিহাসবিদ একেক রকম গল্প লিখেছেন ভ্যালেন্টাইন ডে’র ইতিহাস নিয়ে। কারওটা পড়লে আবার মনে হয়ে বুঝি রূপকথাই। তবে একটা বিষয়ে সকলেই একমত। তা হলো ধর্মযাজক সেন্ট ভ্যালেন্টাইন। রোম শহরের এই যাজকের নামানুসারেই সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে দিবসটি। অনেক মতানৈক্যের মধ্যে সবচাইতে বেশি গৃহীত এবং জনপ্রিয় ইতিহাস মতে, ২৬৯ খৃষ্টাব্দের কথা।
সাম্রাজ্যবাদী, রক্তপিপাষু রোমান সম্রাট ক্লডিয়াসের দরকার এক বিশাল সৈন্যবাহিণীর। এক সময় তার সেনাবাহিনীতে সেনা সংকট দেখা দেয়। কিন্তু কেউ তার সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে রাজি নয়। সম্রাট লক্ষ্য করলেন যে, অবিবাহিত যুবকরা যুদ্ধের কঠিন মুহূর্তে অত্যধিক ধৈর্যশীল হয়। ফলে তিনি যুবকদের বিবাহ কিংবা যুগলবন্দী হওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করেন। যাতে তারা সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে অনীহা প্রকাশ না করে। তার এ ঘোষণায় দেশের যুবক- যুবতীরা ক্ষেপে যায়। যুবক সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নামের এক ধর্মযাজকও সম্রাটের এ নিষেধাজ্ঞা কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। প্রথমে তিনি সেন্ট মারিয়াস নামের এক রমনীকে ভালবেসে বিয়ের মাধ্যমে রাজার আজ্ঞাকে প্রত্যাখ্যান করেন। পাশাপাশি তার গীর্জায় গোপনে বিয়ে পড়ানোর কাজও চালাতে থাকেন। একটি রুমে বর-বধূ বসিয়ে মোমবাতির স্বল্প আলোয় ভ্যালেন্টাইন ফিস ফিস করে বিয়ের মন্ত্র পড়াতেন। কিন্তু এ বিষয়টি এক সময়ে সম্রাট ক্লডিয়াসের কানে গেলে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। ২৭০ খৃষ্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি সৈন্যরা ভ্যালেন্টাইনকে হাত- পা বেঁধে টেনে- হিঁচড়ে সম্রাটের সামনে হাজির করলে তিনি তাকে হত্যার আদেশ দেন। তারপরেই ভালোবাসা দিবসের আরেকটি গ্রহণযোগ্য ইতিহাসে পাওয়া যায় ২৭০ খ্রষ্টাব্দে গোটা ইউরোপে ছিলো খৃষ্টান ধর্মের জয়জয়কার। তখনও ঘটা করে পালিত হতো রোমীয় একটি রীতি। মধ্য ফেব্রুয়ারিতে গ্রামের সকল যুবকরা সমস্ত মেয়েদের নাম চিরকুটে লিখে একটি পাত্রে বা বাক্সে জমা করত।
অতঃপর ঐ বাক্স হতে প্রত্যেক যুবক একটি করে চিরকুট তুলত, যার হাতে যে মেয়ের নাম উঠত, সে পূর্ণবৎসর ঐ মেয়ের প্রেমে মগ্ন থাকত। আর তাকে চিঠি লিখত, এ বলে ‘প্রতিমা মাতার নামে তোমার প্রতি এ পত্র প্রেরণ করছি।’ বৎসর শেষে এ সম্পর্ক নবায়ন বা পরিবর্তন করা হতো। এ রীতিটি কয়েকজন পাদ্রীর গোচরীভূত হলে তারা একে সমূলে উৎপাটন করা অসম্ভব ভেবে শুধু নাম পাল্টে দিয়ে একে খৃষ্টান ধর্মায়ণ করে দেয় এবং ঘোষণা করে এখন থেকে এ পত্রগুলো ‘সেন্ট লেনটাইন’-এর নামে প্রেরণ করতে হবে। কারণ এটা খৃষ্টান নিদর্শন, যাতে এটা কালক্রমে খৃষ্টান ধর্মের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যায়। আরেকটি ইতিহাস বলে ঘটনাটি ঘটেছিলো আজ থেকে বহুকাল পূর্বের রোম শহরে। তার সম্রাট তখন দ্বিতীয় ক্লডিয়াস। এক ধর্মযাজক ছিলেন সেন্ট ভ্যালেনটাইন নামে। তিনি ছিলেন শিশুপ্রেমিক, সামাজিক ও সদালাপী এবং খৃষ্টধর্ম প্রচারক। আর রোম সম্রাট ছিলেন বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজায় বিশ্বাসী। ঐ সম্রাটের পক্ষ থেকে তাকে দেব-দেবীর পূজা করতে বলা হলে ভ্যালেন্টাইন তা অস্বীকার করায় তাকে কারারুদ্ধ করা হয়। সেন্ট ভ্যালেন্টাইন কারারুদ্ধ হওয়ার পর প্রেমাসক্ত যুবক- যুবতীদের অনেকেই প্রতিদিন তাকে কারাগারে দেখতে আসত এবং ফুল উপহার দিত। তারা বিভিন্ন উদ্দীপনামূলক কথা বলে সেন্ট লেন্টাইনকে উদ্দীপ্ত রাখত। এক কারারক্ষীর এক অন্ধ মেয়েও ভ্যালেন্টাইনকে দেখতে যেত। অনেকক্ষণ ধরে তারা দু’জন প্রাণ খুলে কথা বলত।
এক সময় ভ্যালেন্টাইন তার প্রেমে পড়ে যান। সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের আধ্যাত্মিক চিকিৎসায় অন্ধ মেয়েটি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পায়। ভ্যালেন্টাইনের ভালবাসা ও তার প্রতি দেশের যুবক-যুবতীদের ভালবাসার কথা সম্রাটের কানে গেলে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে ২৬৯ খৃষ্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি তাকে মৃত্যুদন্ড দেন। সেই থেকে ভ্যালেন্টাইনের ভালোবাসাকে সম্মান জানাতে পালিত হয়ে আসছে ভ্যালেন্টাইন ডে। বাংলাদেশে ভ্যালেন্টাইন ডে ১৯৯৩ সালের দিকে বাংলাদেশে বিশ্ব ভালবাসা দিবসের আর্বিভাব ঘঠে। যায়যায় দিন পত্রিকার সম্পাদক শফিক রেহমান। তিনি পড়াশোনা করেছেন লন্ডনে। পাশ্চাত্যের ছোঁয়া নিয়ে দেশে এসে লন্ডনী সংস্কৃতির প্র্যাকটিস শুরু করেন। তিনি প্রথম যায়যায় দিন পত্রিকার মাধ্যমে বিশ্ব ভালবাসা দিবস বাংলাদেশিদের কাছে তুলে ধরেন। তেজগাঁওয়ের একটি রোডের নামকরণও করেছিলেন লাভ রোড। সবাইকে বিশ্ব ভালবাসা দিবসের শুভেচ্ছা ও আন্তরিক অভিনন্দন। সর্বপ্রানে লাগুক ভালবাসার ছোয়া।
লেখক : কবি, গল্পকার, সমাজকর্মী