গুলশান বৈঠকের হোতাদের খুঁজছে সরকার
প্রকাশিত হয়েছে : ৮:৩০:৫৭,অপরাহ্ন ০৭ ডিসেম্বর ২০১৪
ঢাকা: বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে যেসব সাবেক ও বর্তমান সরকারি কর্মকর্তারা বৈঠক করেছিলেন, তাদের খুঁজছে সরকার। আজ রোববার সচিবালয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেক বলেছেন, সরকারের কোনো কর্মকর্তা আইন ভেঙে এই ধরণের বৈঠকে অংশগ্রহণ করতে পারেন না। তাই গুলশান বৈঠকের মূল হোতাদের খুঁজছে সরকার।
উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) রাতে গুলশানের কার্যালয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাবেক ও বর্তমান সরকারি কর্মকর্তার সাক্ষাতের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে তুমুল অলোচনা সমালোচনা চলছে। যদিও বিএনপি এই ঘটনা শুরু থেকেই অস্বীকার করে আসছে।
এই ঘটনায় ইসমাত আরা সাদেক বলেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এ ধরনের আচরণ কাম্য নয়। তারা রাজনৈতিক ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করতে এবং যোগাযোগ করতে পারেন না। শৃঙ্খলা ভাঙতে পারেন না। রাজনৈতিকভাবে সম্পৃক্তও হতে পারেন না। তাই সরকারি কর্মচারী আচরণবিধি অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায় তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কারা এতে অংশ নিয়েছিলেন তাদেরও খুঁজে বের করা হবে।
একই সঙ্গে ঘটনাটি আদৌ ‘সত্য’ কিনা তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন তিনি। তবে সরকার এটিকে হালকাভাবে নেয়নি বলে তিনি জানান।
এর আগে গতকাল শনিবার তিনি বলেছিলেন, খালেদা জিয়ার সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাদের বৈঠকের খবর তদন্ত করবে সরকার। ওই বৈঠক নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের সত্যতা পেলে সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কিন্তু এখন পর্যন্ত এই ঘটনায় কোনো তদন্ত কমিটি গঠন হয়নি। এ বিষয়ে আজ রোববার ইসমাত আরা বলেন, ওই ঘটনায় এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোনো তদন্ত কমিটি হয়নি। তবে কমিটি গঠনের আগে যেসব প্রাথমিক কাজ করা প্রয়োজন তা করা হচ্ছে।
এদিকে একটি সূত্র জানিয়েছে, সিসিটিভি ফুটেজের মাধ্যমে ওই দিন খালেদা জিয়ার সাথে বৈঠকে অংশগ্রহনকারীদের সনাক্তের চেষ্টা চলছে। সেদিন রাতে যারা বৈঠক করেন তারা খালেদা জিয়ার সঙ্গে গ্রুপ ছবিও তোলেন বলে জানা গেছে। সিসিটিভিতে এদের গুলশান কার্যালয়ে যাওয়ার বিষয়টি পরিস্কার হয়। তবে পুলিশ সিসিটিভির ফুটেজ দেখে এখন পর্যন্ত ১৬ জনের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে। তারা হলেন অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব এ কে এম জাহাঙ্গীর হোসেন, সিনিয়র সহকারী সচিব (ওএসডি) এহসানুল হক, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (বর্তমানে প্রেষণে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে) বদিউল কবির, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ইব্রাহীম মিয়াজী, পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ে কর্মরত নুরুল ইসলাম, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবদুল মান্নান, কেয়ারটেকিং বিভাগের ফরাস হুমায়ুন কবীর, তথ্য মন্ত্রণালয়ের অফিস সহকারী শহীদুল হক, এজি অফিসের কর্মচারী আবদুল মান্নান, পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের এও নুরুল ইসলাম, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির পিও তৌফিকুল ইসলাম, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, তথ্য অধিদপ্তরের অফিস সহকারী বিল্লাল হোসেন, আইএমইডির চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী মুজিবুল হক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের এও মামুন।
এই গোপন বৈঠকের মূল কারণ হিসেবে ‘প্রশাসনে দলীয়করণ’-কে দায়ী করেছেন প্রশাসনের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তারা। তারা জানান, গত শতকের শেষ দশকের মাঝামাঝি থেকে মূলত জনপ্রশাসনে দলীয়করণ শুরু হয়। এখন তা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। নতুন সরকার এসে আগের সরকারের সুবিধাভোগী হিসেবে কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চিহ্নিত করে বঞ্চিত করে রাখে। পরের সরকারও একই পথ অনুসরণ করে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের সময়ে বঞ্চিত (ওএসডি) কর্মকর্তারাই বেগম জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, বৃহস্পতিবারের ‘গুলশান বৈঠক’-এর পর প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী যেন ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে না পারেন সেজন্য সরকার তাদের কঠোর নজরদারিতে রেখেছে। সচিবালয়ে কোনো ধরনের দাবি-দাওয়াকে কেন্দ্র করে একসঙ্গে ৫ জনের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী একত্র হলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, সচিবালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা এবং তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের দুটি গ্রুপ রয়েছে। এ দুটি গ্রুপের একটির নেতৃত্ব দেন মাহে আলম, খালেক ও বখতিয়ার এবং অন্য গ্রুপের নেতৃত্ব দেন সরকার তোহা, নুরুল ইসলাম ও ইব্রাহীম মিয়াজী। দুই গ্রুপকেই ইন্ধন জোগান বিএনপিপন্থি অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন আমলা। মহাজোট সরকারের আমলে বিভিন্ন দাবি-দাওয়াকে কেন্দ্র করে এ দুই গ্রুপ একাধিকবার সোচ্চার হওয়ার চেষ্টা করলেও সরকারের কঠোর নজরদারির কারণে তারা ব্যর্থ হন। দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বের কারণে তারা গত ৬ বছরে চোখে পড়ার মতো কোনো কর্মসূচি পালন করতে পারেননি। যদিও মহাজোট সরকারের শেষ সময়ে সচিবালয়ে ওএসডি ও পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তাদের শোডাউন করতে দেখা যায়। পরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণে তা ভেস্তে যায়।
বৃহস্পতিবার রাতে খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রশাসনের বিএনপি-জামায়াতপন্থিদের ঐক্যবদ্ধ করা। প্রশাসনে বিএনপি-জামায়াতপন্থি দুটি গ্রুপকে ঐক্যবদ্ধ করে খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করানোর দায়িত্ব দেওয়া হয় সাবেক কয়েকজন আমলাকে। সে অনুযায়ী তারা বৃহস্পতিবার উভয় গ্রুপের নেতাদের ডেকে নিয়ে খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে যান। কার্যালয়ে যাওয়ার পর তাদের মধ্যে কারা নেতৃত্ব থাকবেন তা নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। তোহা গ্রুপ ও মাহে আলম গ্রুপ তর্কে জড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে ক্ষুব্ধ এক গ্রুপের লোকেরাই বৈঠকের কথা ফাঁস করে দেন মিডিয়ার কাছে।
এর আগে ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির বাতিল হওয়া নির্বাচন সামনে রেখে ২০০৬ সালের ২৪ নভেম্বর রাতে উত্তরায় মাহমুদুর রহমানের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ‘আর্টিসান সিরামিক’-এ পুলিশসহ জনপ্রশাসনের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা গোপনে বৈঠক করেন। খবর পেয়ে গণমাধ্যমের কর্মীরা সেখানে গেলে বৈঠকে যোগ দেওয়া অনেক কর্মকর্তা মুখ ঢেকে ও দৌড়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। এ দৃশ্য ওই রাতে বেসরকারি কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচার করা হয়। এমনকি পর দিন বিভিন্ন সংবাদপত্রে ওই ছবি প্রকাশিত হয়। এ ঘটনায় আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে ‘উত্তরা ষড়যন্ত্রের’ ঘটনায় রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা চলছে।
গভীর রাতের ওই বৈঠকের পর সরকারের অনেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের অনেক নেতা এ বিষয়ে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে দোষারোপ করে মন্তব্য করেছেন।
সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে বিএনপির ‘ষড়যন্ত্র’ নতুন কিছু নয় মন্তব্য করে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, সরকার উচ্ছেদের ষড়যন্ত্রে উসকানি’ দেওয়ার মামলায় খালেদা জিয়াই হবেন প্রধান আসামি। সরকার এটা হালকাভাবে নেবে না। এটা সার্ভিসের শৃঙ্খলার ব্যাপার। তাই একে সহজভাবে নেব না। এ ব্যাপারে যা করার তাই করব। এসময় তিনি সচিবদের উপর সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনেন।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এ বৈঠকের ব্যাপারে বলেছেন, জনগণের সাড়া না পেয়ে বিএনপি আন্দোলনে ব্যর্থ হচ্ছে। তাই তারা রাতের অন্ধকারে বৈঠক করে ষড়যন্ত্রের পাঁয়তারা করছে।
খালেদা জিয়ার সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাদের কথিত বৈঠককে ‘গুলশান ষড়যন্ত্র’ আখ্যায়িত করে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেছেন, গোয়েন্দাদের মাধ্যমে জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নেওয়া হবে।
বৈঠকের ঘটনার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে প্রশাসনের বর্তমান যেসব কর্মকর্তা বৈঠক করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সাধারণত কোনো বৈঠক বা কর্মসূচি থাকলে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সাংবাদিকদের প্রবেশে বিধি-নিষেধ থাকে না। কিন্তু বৃহস্পতিবার রাতের সচিবদের নিয়ে বৈঠকের খবর জানতে পেরে সাংবাদিকরা কার্যালয়ের সামনে জড়ো হলে তাদের ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।
তবে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাদের বৈঠক হয়নি বলে দাবি করেছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
তিনি দাবি করেন, বৃহস্পতিবার রাতে কয়েকটি টেলিভিশন গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে একটি বৈঠক চলার খবর প্রচারিত হয়, যাতে প্রশাসনের একদল কর্মকর্তাও রয়েছেন এই খবরটি আদৌ সত্য নয়, এর কোনো সত্যতা নেই। সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এই সংবাদটি জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার জন্য অপপ্রচার করা হচ্ছে।