ওয়ান-ইলেভেনের সেই খলনায়করা কে কোথায়?
প্রকাশিত হয়েছে : ১২:২৮:২১,অপরাহ্ন ১৯ এপ্রিল ২০১৫
নিউজ ডেস্ক::
ভালো নেই ওয়ান-ইলেভেনের সেই শাসকরা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন তারা। দুই নেত্রীসহ শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতারের এই কুশীলবরা এখন নিজেদের মতো করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। বেশির ভাগই আছেন বিদেশে। ব্যক্তিগত কাজে নিজেদের জড়িয়ে রেখেছেন। আছেন চুপচাপ। এই কুশীলবদের আইনের আওতায় আনার কথা বিভিন্ন সময়ে উঠলেও তা আর হয়ে ওঠেনি। এর মধ্যে প্রধান কুশীলব ফখরুদ্দীন আহমদ ও মইন উ আহমেদ যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে সেখানেই নিজেদের কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যস্ত। মৃত্যুবরণ করেছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। প্রায় ছয় বছর বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে ফিরে ঢাকায় রেস্টুরেন্ট খুলেছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী। সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) চৌধুরী ফজলুল বারীও আছেন যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসে।
জানা যায়, ওয়ান-ইলেভেন সময়ের রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ তিন বছর আগে মারা গেছেন। ২০১২ সালের ১০ ডিসেম্বর ৮১ বছর বয়সে থাইল্যান্ডে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। শেষ সময়ে তিনি বয়সের ভারে মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেছিলেন। দিন কাটিয়েছেন গুলশানের বাসভবনে। রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক কোনো অনুষ্ঠানেই যোগ দেননি। সাবেক এই রাষ্ট্রপতির স্ত্রীর প্রতিষ্ঠিত অতীশ দীপঙ্কর বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানাসংক্রান্ত জটিলতায় তার ছেলেকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে তার জীবদ্দশায়।
২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমদ দেশ ছেড়ে যান যুক্তরাষ্ট্রে। অবশ্য তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ছিলেন আগেও। এ দফায় দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্র গিয়ে বাড়ি কেনেন মেরিল্যান্ড স্টেটের পটোম্যাকে। সেখানে তার দুটি বাড়ির একটিতে থাকেন সস্ত্রীক ও অন্যটিতে থাকে তার কন্যার পরিবার। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়ায় ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যাডিজ বিষয়ে ভিজিটিং স্কলার হিসেবে গবেষণা ও শিক্ষকতা করেছেন। সেখানে তিনি বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী পদমর্যাদার প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে শিক্ষার্থীদের ‘উন্নয়নশীল দেশের গণতন্ত্রের বিকাশ’ সম্পর্কে ধারণা দেন। সেই সঙ্গে সামাজিক ব্যবসা ও ক্ষুদ্র ঋণ বিষয়েও শিক্ষার্থীদের পড়ান প্রায় ২০ বছর বিশ্বব্যাংক ও পাঁচ বছর পিকেএসএফে দায়িত্ব পালন করা ফখরুদ্দীন।
এ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশি বেশ কয়েকজন বিভিন্ন সময়ে কাজ করেছেন। ফখরুদ্দীন আহমদ মাঝে কিছু দিন মালয়েশিয়ায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং অধ্যাপক হিসেবেও কাজ করেছেন। জেনারেল মইন উ আহমেদ সেনাপ্রধান পদে অবসর নেন ২০০৯ সালের মাঝামাঝি। সে বছরেরই ১৪ জুন তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। প্রথমে ফ্লোরিডায় ছোট ভাই ও ছেলের কাছে থাকতেন। পরে তার ক্যান্সার ধরা পড়লে চিকিৎসার জন্য নিউইয়র্কের কুইন্সে থাকা শুরু করেন। এর মধ্যেই তার যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব হয় বা গ্রিনকার্ড পান। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবেই বিশেষ সুবিধায় নিউইয়র্কের একটি হাসপাতালে ব্লাড ক্যান্সারের চিকিৎসা নেন। তার স্পাইনাল কর্ডের পাঁচটি স্থানে ক্ষত হওয়ায় বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশনও করা হয়। এখনো তাকে কেমোথেরাপি দেওয়া হয়।
এতদিন ধরে কোথাও কোনো উল্লেখযোগ্য সামাজিক অনুষ্ঠানে তাকে দেখা না গেলেও চলতি এপ্রিলের ৩ ও ৪ তারিখ বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন অব ফ্লোরিডার আয়োজনে উত্তর আমেরিকা রবীন্দ্র সম্মিলনে ছিল তার সরব উপস্থিত। সম্মিলনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিষয়ে বক্তব্য দেওয়ার পাশাপাশি হাসিমুখে কুশল বিনিময় করেছেন অতিথিদের সঙ্গে। ওয়ান-ইলেভেন সরকারের আমলে দেশের দুর্নীতি-অনিয়ম দূর করার অভিযানের জন্য গঠিত ‘গুরুতর অপরাধ দমন সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি’র প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী। সাভারের নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী তখন মেজর জেনারেল থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হন।
পরে ২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের হাইকমিশনারের দায়িত্ব নিয়ে চলে যান অস্ট্রেলিয়া। চার দফায় তার মেয়াদ বাড়ানোয় প্রায় ছয় বছর দায়িত্ব পালন করেন। পরে গত বছরের শেষে ঢাকায় ফিরে আসেন। এখন ঢাকার তেজগাঁওয়ে একটি ফাইভ স্টার মানের রেস্টুরেন্ট পরিচালনায় ব্যস্ত তিনি। ওয়ান-ইলেভেনের আরেক আলোচিত-সমালোচিত সামরিক কর্মকর্তা (চাকরিচ্যুত) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল চৌধুরী ফজলুল বারী এখন যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসে অবস্থান করছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ সময়ে ব্রিগেডিয়ার বারী ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশ দূতাবাসে সামরিক অ্যাটাশে পদে চাকরি নিয়ে চলে যান। পরে আওয়ামী লীগ সরকার তাকে দেশে ফেরার নির্দেশ দিলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রেই বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন। তখন পরিবার-পরিজন নিয়ে এক প্রকার বিপদেই পড়েন। যদিও এখন তার স্ত্রীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের বৈধ অভিবাসী স্ট্যাটাস আছে।
তবে প্রথমে এক বাংলাদেশির মালিকানাধীন ডমিনাস পিজা স্টোরের ডেলিভারিম্যানের কাজ করতেন। এখন একটি ওষুধ কোম্পারিনর ডেলিভ্যারিম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। ওয়ান-ইলেভেনের সময় প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদফতরের (ডিজিএফআই) পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিন সব রকম আর্থিক সুবিধা গ্রহণপূর্বক ২০০৯ সালের ১৭ মে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন। পরে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পরিচয়ে দেশত্যাগ করেন। এখন তিনি দুবাইয়ে। সেখানেই চাকরি করছেন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায়। আর্থিকভাবে ভালোই আছেন।
ওয়ান-ইলেভেনের আগে আগে উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) হাসান মশহুদ চৌধূরী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জাতীয় সংসদে চরম সমালোচিত হয়ে ২০০৯ সালের ২ এপ্রিল পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তিনি এখন ঢাকায় ডিওএইচএসের বাসায়ই থাকছেন। নিয়মিত হাঁটাহাঁটি, ব্যায়াম করেন বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে। বিভিন্ন সংসদীয় কমিটি তাকে দুদকের বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির কৈফিয়ত দিতে ডাকলেও তিনি সেখানে উপস্থিত হননি। আছেন নীরবেই। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরজুড়ে মেজর জেনারেল (অব.) এম এ মতিন উপদেষ্টা ছিলেন। গুরুতর অপরাধ দমন সংক্রান্ত জাতীয় সমন্বয় কমিটির প্রধান হিসেবে রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে তিনি অভিযান পরিচালনা করেন। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রামে নিজ বাড়িতে বসবাস করছেন। একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল পরিচালনা করছেন। ওয়ান-ইলেভেন জমানায় রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব হিসেবে বঙ্গভবনে দায়িত্ব পালন করা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আমিনুল করিমকেও অকালীন অবসরে যেতে হয়েছে। তবে তিনি কোনো আর্থিক সুযোগ-সুবিধা পাননি। বঞ্চনার শিকার হয়েছেন তার স্বজনরাও।
বিদেশি কূটনীতিক: ওয়ান-ইলেভেনের আগে ও পরে ঢাকায় দায়িত্ব পালন করা বেশ কয়েকজন কূটনীতিকের বাংলাদেশের রাজনীতিতে নাক গলানোর অভিযোগ ওঠে। সে সময়ের মার্কিন রাষ্ট্রদূত পেট্রেসিয়া এ বিউটেনিস ২০০৭ সালের জুনে ঢাকার দায়িত্ব শেষ করে ফিরে যান। পরে তিনি শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের মার্কিন রাষ্ট্রদূত হন। এখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের মানব পাচর দফতরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক। বিউটেনিসের পরপরই ঢাকায় আসা জেমস এফ মরিয়ার্টিও অবসরে গেছেন। ঢাকায় ওই সময়কার ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী এখন পেরুতে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত। মাঝে তিনি ব্রিটিশ সরকারের ফরেন ও কমনওয়েলথ অফিসের ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউশনের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আনোয়ার চৌধুরীর পরে দায়িত্ব পালন করা স্টিভেন ইভান্সও দায়িত্ব পালন শেষে লন্ডনে পররাষ্ট্র দফতরে কাজ করছেন। সে সময় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী হিসেবে আলোচিত ভূমিকা রাখা রেনাটা ডিজালিয়েন এখন মিয়ানমারে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি।
সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন।