ওভারকোট | সৈয়দ আহসান কবীর
প্রকাশিত হয়েছে : ১২:৪২:৫১,অপরাহ্ন ১৯ জানুয়ারি ২০১৫
ওভারকোট পরা লোকটি অনেকক্ষণ পিছু নিয়েছে। এত ঠাণ্ডা পড়েনি যে ওভারকোট পরতে হবে। তারপরও পরেছে। মাথায় ঝাকড়া চুল, মুখ গোঁফ-দাড়িতে ঢাকা। ছিপছিপে গড়নের মাঝ বয়সী লোকটিকে দেখে বোঝা যাচ্ছে না কোনও মতলব আছে কি-না। নওরীন খুব চিন্তায় পড়ে।
ক্যাম্পাসে ফাহিমের সাথে শেয়ার করবে ভেবেছিল। কিন্তু ওর মেজাজ খুব চড়া। হুটহাট রেগে যায়। তাই শেয়ার করেনি। মনে হচ্ছে ভুল হয়েছে। সরাসরি প্রশ্ন করে বসলেই হয়। কিন্তু মন সায় দিচ্ছে না।
লোকটি কেমন যেন রহস্যময়। সাথে আর কেউ আছে কিনা বোঝার চেষ্টা করল নওরীন। কোনও গং মেম্বার হলে মোবাইলে দু-একবার কথা বলতে দেখা যেত। কিন্তু তেমন কিছু চোখে পড়ল না। শুধুই দূরত্ব রেখে অনুসরণ করছে লোকটি।
সকালে বাসের জন্য যখন অপেক্ষা করছিল তখন লোকটিকে প্রথম দেখে নওরীন। ওভারকোট পরা লোকটি বাস স্টপেজের পাশের একটি টি-স্টল থেকে স্থির চোখে তার দিকে তাকিয়ে চা খাচ্ছিল। বাসে না ওঠা পর্যন্ত তাকিয়ে ছিল। আমলে নেয়নি সে। বাস থেকে নেমে সোজা কলেজ ক্যাফেটরিয়ায়, তারপর লাইব্রেরি ঘুরে ফাহিমকে সাথে নিয়ে সোজা ফটিকের টি-স্টলে। ক্যাম্পাসের এই একটি জায়গা ওর খুব ফেবারিট। চায়ে চুমুক দিয়ে চোখ তুলতেই লোকটিকে দেখতে পেল। আশ্চর্য হয়নি সে। এখানেও কাজ থাকতে পারে লোকটির। কিন্তু নীলক্ষেতে বই কেনার সময় আবারও দেখতে পেয়ে সন্দেহের জাল ছড়িয়ে পড়ল নওরীনের মনে। তারপর থেকে ফিরে ফিরে দেখছিল। লোকটি তার পেছনে আছেই। নওরীনের সন্দেহ লোকটির কাছে স্পষ্ট। কিন্তু কোনও ছলনার আশ্রয় নিচ্ছে না। সিগারেট টানতে টানতে ধীর গতিতে এগুচ্ছে।
কাজ সেরে ফাহিমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিল নওরীন। হঠাৎ লোকটিকে নিয়ে চিন্তা ঢুকল। কী চায় সে।
বেলা বারোটা। সূর্যের দেখা নেই। হালকা কুয়াশা, তেমন ঠাণ্ডাও নেই। লোকজন শীতের হালকা পোশাকে দিব্বি হেঁটে চলছে। কিন্তু লোকটি নির্বিকার। ওভারকোট নিয়ে তার কোনও মাথা ব্যথা নেই।
বাসের চিন্তা ছেড়ে রিক্সা নিল নওরিন। খানিকটা এগুনোর পর ফিরে দেখল ওভারকোট আসছে অন্য রিক্সায়। সমান তালে ধোঁয়া উড়ছে। ঠাণ্ডা ধিরস্থির চেহারা। বুদ্ধিদীপ্ত দার্শনিক গোছের মানুষ যেমন হয়।
৫ নম্বর রোডে এসে রিক্সা থামল। সামান্তার সাথে পরবর্তী এসায়েন্টমেন্টের আলোচনা আছে। শেষ বাসাটা ওদের। বাসার সামনে নামলেই পারত। কিন্তু আগেই রিক্সা ছেড়ে দিল। লোকটি হয়ত কিছু বলতে চাইছে। যদি সে রকম কিছু হয়, সুযোগ নিতে পারেন তিনি। দুর্ঘটনার কথাও ভেবেছে নওরিন। কিন্তু সৌম্য চেহারার এই লোকটি তেমন নয় মনে হচ্ছে। ধীর পায়ে হাঁটছে নওরিন। নাহ! লোকটি এগুচ্ছে, কিন্তু যা ভেবেছিল তা ঘটল না।
আধঘণ্টার মধ্যে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে নওরিন পত্রিকা অফিসের দিকে পা বাড়াল। বিকেলে ওখানে সাব এডিটিংয়ের কাজ করে। আজ আগেই অফিসে এলো। গেইট দিয়ে ঢোকার আগে আড় চোখে দেখে নিল সে। মোড়ের চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে নির্বিকারে ধোঁয়া ওড়াচ্ছে লোকটি।
এ সময়ে অফিসে সায়েম ছাড়া কেউ থাকে না। সায়েম ক্লাসে ফোরে পড়ে। পড়ার পাশাপাশি অফিসের ফায়ফরমায়েস খাটে। নওরীনই কাজটি জুটিয়ে দিয়েছিল।
চেয়ারে বসে বারবার লোকটির চেহারা ভেসে উঠছে। কী চায় লোকটি?
মায়ের একমাত্র মেয়ে নওরীন। অভাবের মাঝেও মধ্যবিত্তদের সন্তানের মত করেই মা তাকে বড় করে তুলেছে। বাবাকে দেখেনি কখনও। ছোট থেকেই বাবা কী জিনিস তা জানতে পারেনি। বাবা সম্বন্ধে মা কোনও উত্তর দেয় না। একদিন জিজ্ঞেস করায় মা কেঁদে ফেলেছিলেন। তারপর আর কখনও জিজ্ঞেস করা হয়ে ওঠেনি নওরীনের। কৈশোরে কবিতা আবৃত্তিতে প্রথম হলে মা বলেছিলেন, ‘তোমার বাবাও বেশ আবৃত্তি করতেন, লিখতেনও।’ তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলেই বলেছিলেন, ‘তখন বুঝিনি।’
কথাটার মানে সে সময় না বুঝলেও এখন বেশ অনুধাবন করতে পারে নওরীন। হয়ত মায়ের কারণেই তাদের মাঝে কোনও ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু এ নিয়ে মাথা ঘামায়নি নওরীন। তবে বাবার প্রতি একটি চাপা ক্ষোভ কাজ করে তার, ‘যা-ই হোক না কেন আমি তো তার মেয়ে একটি বারের জন্য হলেও’…
নাহ! কাজে মন বসছে না। কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। লাঞ্চের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ইচ্ছা করছে না। চা খেলে হতো। সায়েমকে মোড়ের চায়ের দোকান থেকে আদা চা আনতে বলল নওরীন। অফিসের রং চা ভালো লাগে না।
ফিরে এলো সায়েম। হাতে একটা নীল খাম। বলল, ‘আফা একডা ব্যাডাই আফনেরে দিতে কইছে। আমার পকেটোর সিল দেইখ্যা জিগাইল এই আফিসে কাম করি কিনা। তারপরে কী জ্যান লেইখ্যা হাত্তে দিয়া কইল আফনেরে দিয়া দিতো’…
প্রায় ছোঁ মেরে খামটি নিল নওরীন। বেশ চমৎকার হাতের লেখা খামের ওপর জ্বলজ্বল করছে। প্রেরকের নাম নেই। শুধু লেখা, ‘কিছু বলার ছিল।’ খামটি খুলতেই সিগারেটের কাগজে লেখা, ‘নিকোটিনের থাবা থেকে টেনে নেওয়ার কেউ কাছে নেই আমার। তবে সিসার গ্যাস চেম্বারে রচিত হচ্ছে স্বপ্নছায়া। জানি তোমার সম্মানে সম্মানিত হবে জাতি। তোমার চলার পথে আকাশের তারা হতে আজ আমার কোনও বাধা নেই।’
শেষের ঠিক আগের কথাটি নওরীনের খুব পরিচিত। দ্বিতীয় জন্মদিনে স্থানীয় একটি পত্রিকায় তার বাবা তাকে উইশ করতে লিখেছিল। বারো বছর বয়সে কে যেন তাদের বাসায় কুরিয়ারে পুরাতন পত্রিকাটি পাঠিয়েছিলেন। মা পড়ে অনেক কেঁদেছিলেন।
মুহূর্তেই ছুটে যায় নওরীন। টি-স্টল ফাঁকা। কেউ কোথাও নেই। শেষ বিকেলের পথে মেঘ হয়ে ভেসে যাচ্ছে একটি রিক্সা।