অবরোধের ৩ মাস : প্রভাব নেই বৃহত্তর সিলেটের ১৩ শুল্ক স্টেশনে
প্রকাশিত হয়েছে : ৮:০৭:৫০,অপরাহ্ন ১০ এপ্রিল ২০১৫
নাসির উদ্দিন::
ঢাকা-চট্রগ্রামের পর আমদানি-রফতানির উল্লেখযোগ্য অঞ্চল সিলেট। দেশের মোট চাহিদার সিংহভাগ কয়লা ও বোল্ডার /পাথর সিলেটের বিভিন্ন শুল্ক স্টেশন দিয়েই আমদানি করা হয়। এছাড়াও চুনাপাথর ও নানা ধরনের কাঁচামালও ১৩টি শুল্ক স্টেশন দিয়ে আমদানি করা হয়ে থাকে। আমদানির পাশাপাশি রপ্তানি করা হয় খাদ্য সামগ্রীসহ প্রায় ১৩টি পণ্য।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ডাকা টানা অবরোধে সিলেট অঞ্চলের শুল্ক স্টেশনগুলোর আমদানি-রফতানিতে বড় ধরণের কোনো প্রভাব পড়েনি বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। স্বাভাবিক ছিল পণ্য আমদানি-রফতানি। তবে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, আমদানিকৃত মালামাল বিপণনের ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও সমস্যর সৃষ্টি হয়। ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে সিলেটের ১৩টি শুল্ক স্টেশনে আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২৯৬ কোটি ৮লাখ ৭০ হাজার টাকা। এর বিপরীতে মোটর রাজস্ব আদায় করা হয় ২৩২ কোটি ৯৬ লাখ ৮১ হাজার টাকা। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বছরখানেক ধরে ভারত থেকে কয়লা আমদানি বন্ধ থাকার কারণে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা কিছু কম হয়।
সিলেট কাস্টমসের সহকারি কমিশনার ওমর মোবিন জানিয়েছেন, সিলেট অঞ্চলের ১৩টি শুল্ক স্টেশন দিয়ে পণ্য আমদানি-রফতানি করা হলেও মূলত তামাবিল ও শেওলা (সুতারকান্দি) শুল্ক স্টেশন দিয়ে সবচেয়ে বেশি কয়লা পাথর আমদানি করা হয়। আর এ দু’টি থেকেই সরকারের মোটা অংকের রাজস্ব আদায় করা হয়ে থাকে। কিন্তু ভারতের অভ্যন্তরীণ সমস্যা থাকার কারণে প্রায় এক বছর ধরে এ দু’টি শুল্ক স্টেশন দিয়ে কয়লা আমদানি বন্ধ রয়েছে। ফলে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কিছুটা হলেও ব্যাহত হয়েছে।
তবে তিনি জানান, চলমান অবরোধের শুরুতে আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে কিছুটা প্রভাব পড়লেও এবছরের মার্চ মাস থেকে তা স্বাভাবিক হয়ে আসে। বিশেষ করে সিলেটের তামাবিল সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন ৫/৬শ পণ্যবাহী গাড়ি আসা যাওয়া করে। শেওলা ও অন্যান্য স্টেশন দিয়ে আরো দেড় থেকে দুই শতাধিক গাড়ি চলাচল করে।তবে অবস্থা কিছুটা অস্বাভাবিক থাকায় পণ্যবাহী গাড়ির যাতায়াত কিছুটা কমেছে।
সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্যে জানা গেছে, সিলেটের তামাবিল ও শেওলা শুল্ক স্টেশন থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে শুল্ক আদায় হয় ৫ কোটি ২৩ লাখ ৬ হাজার ৫২৭ টাকা। ফেব্রুয়ারি মাসে তা আরো কিছুটা কমে ৪ কোটি ৮৫ লাখ ৮১ হাজার ৮০৬ টাকায় এসে দাঁড়ায়। আবার অবরোধের প্রভাব কিছু কমে এলে এ বছরের মার্চ মাসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বেড়ে দাঁড়ায় ১১ কোটি ৩৮ লাখ ২৮ হাজার ৬৭৩ টাকায়।
সিলেট জেলায় তামাবিল, শেওলা, ভোলাগঞ্জ, জকিগঞ্জ, ছাতক, চেলা, ইছামতি, বড়ছড়া, বগলী, চারাগাঁও। মৌলভীবাজার জেলায় মুড়ি (বেতুলী), চাতলাপুর ও হবিগঞ্জ জেলায় বাল্লা শুল্ক স্টেশন দিয়ে পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়।
এসবের মধ্যে রয়েছে আমদানি পণ্য: কয়লা, পাথর, চুনাপাথর, ক্লিংকার, সাতকরা, শুঁটকি, টমেটো, আদা, পিঁয়াজ, পান, রো-হাইস্কিল, হ্যালমেট, বে-লীফ, আঙ্গুর, আম, কলা, আনারস, লিচু ও ভাঙ্গা কাঁচ।
রফতানি পণ্যের মধ্যে আছে: খাদ্যসামগ্রী, তুলা, প্লাস্টিকসামগ্রী, সিমেন্ট, মেলামাইন,ক্লোরিন গ্যাস, আসবাবপত্র, বিভিন্ন ধরণের মাছ, খৈল, ডিউরেবল প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন পণ্য। শেওলা শুল্ক স্টেশনের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট আসলাম হোসেন বলেন, অবরোধের মধ্যেও পণ্য আমদানি-রপ্তানি স্বাভাবিক রয়েছে। তবে শুরুর দিকে কিছুটা প্রভাব পড়লেও এখন সে অবস্থা নেই। সিলেট কয়লা আমদানিকারক গ্রুপের সভাপতি সালাহ উদ্দিন ফালাহ জানান, অবরোধের কারণে এসকল পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। তবে আমদানির পর পণ্য সামগ্রী বিপণন বা বাজারজাত করতে গিয়ে কিছুটা সমস্যা পড়তে হয় তাদের।
তামাবিল শুল্ক স্টেশনের স্থানীয় কয়লা পাথর ব্যবসায়ী মিনহাজ উদ্দিন জানান, অবরোধকারীরা যানবাহনে আগুন দেওয়ার কারণে চালকরা ঝুঁকি নিতে চান না। একারণে আমদানিকৃত পাথর গুদামে অবিক্রিত পড়ে থাকায় ক্ষতির মুখে পড়েছেন তারা। তবে এখন অবরোধের প্রভাব কমে এলেও অধিক ভাড়া দিয়ে মালামাল পরিবহন করতে হচ্ছে। শেওলা শুল্ক স্টেশনের শরিফ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী কয়লা আমদানিকারক সেলিম আহমদ। তিনি বলেন, অবরোধে শুল্ক স্টেশন বন্ধ হয় না।তবে আমদানি করা পণ্য পরিবহনে সমস্যায় পড়তে হয়েছে। প্রথম দিকে এই জটিলতা বেশি থাকলেও এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় অবরোধের প্রভাব কমেছে।
তামাবিল রেজা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী ইলিয়াস হোসেন লিপু বলেন, অবরোধ হলেও শুল্ক স্টেশনগুলোতে তেমন প্রভাব পড়ে না। তবে আমদানিকৃত মালামাল বিক্রি করতে না পারা এবং বিক্রি করলেও পরিবহন ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় আমরা ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত। তামাবিল চুনাপাথর, কয়লা ও পাথর আমদানিকারক ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম নবী ভূঁইয়া বলেন, শুল্প স্টেশনে অবরোধ ও হরতালের প্রভাব পড়েনি। তবে এ কারণে আমদানিকৃত কয়লা ও পাথর পরিবহনের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে হয়েছে।
তিনি বলেন, সেভেন সিস্টার্স বলে পরিচিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভাল কয়লা আসামের। কিন্ত এক বছর ধরে ভারতের আসাম রাজ্য থেকে কয়লা আমদানি বন্ধ রয়েছে। তবে সেভেন সিস্টার্স—এক নাগাল্যান্ড থেকে কিছু কিছু কয়লা আমদানি অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধির কারণে কোটি কোটি টাকার পাথর অবিক্রিত অবস্থায় রয়েছে।
সিলেট জেলা ট্রাক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আবু সরকার বলেন,অবরোধের আগুনে পুড়ে ট্রাকচালক বকুল দেবনাথ মারা যাওয়ার পর থেকে চালকদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। চালকরা দিনে আনে দিনে খায়। এরপরও ঝুঁকি নিয়ে মালামাল পরিবহন করছেন।
সিলেটের কাস্টমস কমিশনার ড. একেএম নুরুজ্জামান বলেন, আমদানি-রপ্তানিতে কিছুটা হলেও প্রভাব পড়েছে। তবে কয়লা আমদানির ক্ষেত্রে অবরোধ নয়, ভারতের অভ্যন্তরীণ সমস্যার প্রভাব ছিল। তবে সারাদেশের রাস্তাঘাট অনিরাপদ থাকায় মানুষের চলাচল কিছুটা বাধাগ্রস্ত ছিল।বৃহত্তর সিলেটের স্থলবন্দর বা শুল্ক স্টেশনগুলো শুধু নয়, দেশের অন্যান্য স্থলবন্দরও এসবের বাইরে ছিল না।