জাহালমকে জেল খাটিয়ে দুদক এখন দায় চাপাচ্ছে ব্যাংকগুলোর ওপর
প্রকাশিত হয়েছে : ১২:১৪:৩৭,অপরাহ্ন ০৬ মার্চ ২০১৯
নিউজ ডেস্ক:: নিরীহ জাহালম বিনা দোষে তিন বছর জেল খেটেছেন। কিন্তু এখন আর এর দায় নিতে চাইছে না দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ; বরং দায় চাপাচ্ছে ব্যাংকগুলোর ওপর।দুদক বলছে, জাহালমের জেল খাটার দায় সোনালী ব্যাংকসহ অন্য ব্যাংকগুলোর। কেননা ব্যাংকগুলোই টাকা আত্মসাতের প্রকৃত আসামি ঠাকুরগাঁওয়ের আবু সালেকের পরিবর্তে টাঙ্গাইলের জাহালমকে আসামি হিসেবে চিহ্নিত করে। তবে স্বীকার করছে যে জাহালমকে আবু সালেক বলে আসামি করার ক্ষেত্রে সংস্থাটি বিভ্রান্ত ছিল।
জাহালম কীভাবে মামলায় যুক্ত হলেন এবং তাঁর কারাভোগসহ ওই ঘটনার বর্ণনা হলফনামা আকারে যে প্রতিবেদন তৈরি করছে দুদক, তাতে এসব কথা উঠে এসেছে। ২৬টি মামলায় নিরীহ পাটকল শ্রমিক জাহালমের তিন বছর জেলে থাকার ঘটনায় দায় কার—বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে আজ বুধবার এই হলফনামা দাখিল এবং এ বিষয়ে শুনানি হওয়ার কথা।
জাহালমের জেল খাটার দায় নিজের ঘাড়ে না নেওয়ার কারণ হিসেবে দুদক ২০০৪ সালের দুদক আইনের ৩১ নম্বর ধারাকে সামনে এনেছে এবং হলফনামায় তা উল্লেখ করেছে। ‘সরল বিশ্বাসে কৃত কাজকর্ম রক্ষণ’ শিরোনামের ওই ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইন বা আইনের বলে প্রণীত বিধি বা আদেশের অধীন দায়িত্ব পালনকালে সরল বিশ্বাসে কৃত কোনো কাজের ফলে কোনো ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে, সে জন্য কমিশন, কোনো কমিশনার, অথবা কমিশনের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা বা অন্য কোনো আইনগত কার্যধারা গ্রহণ করা যাবে না।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এ বিষয়ে বলেন, ব্যাংক যা–ই বলুক, দুদকের নিজস্ব তদন্তেই সব হওয়ার কথা। ব্যাংক নিজেকে বাঁচাতে ভুল তথ্য দিতেই পারে। যাচাই–বাছাই না করে দুদক কোনো তদন্ত শেষ করতে পারে না। আর বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রপতি ছাড়া সবাইকে তার কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হয়।
দুদকের হলফনামা
হলফনামায় বলা হয়েছে, ব্যাংকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনের তথ্য-উপাত্ত ও ব্যাংক কর্মকর্তাদের সাক্ষ্যর ভিত্তিতে দুদক নিরীহ পাটকলশ্রমিক জাহালমের বিরুদ্ধে প্রথমে অভিযোগপত্র দেয়। তবে দুদক অধিকতর তদন্ত করে দেখেছে যে জাহালমকে আসামি করা হয় সাক্ষীদের জবানবন্দির ভিত্তিতে। সেই সাক্ষীদের পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদ করলে তাঁরা দুদককে জানান, ছবির সঙ্গে মিল থাকায় জাহালমকে তাঁরা আবু সালেক বলে চিহ্নিত করেন এবং এতে বিভ্রান্ত হয়েই জাহালমকে আবু সালেক বলে অভিযোগপত্র দেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সোনালী ব্যাংক, দি সিটি ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ও ব্র্যাক ব্যাংককে পক্ষভুক্ত করলে অনেক কিছুই বেরিয়ে আসবে বলে দুদকের হলফনামায় উল্লেখ করা হয়।দুদক সূত্রে জানা গেছে, মোট ১৮টি ব্যাংক এখানে সম্পৃক্ত। তবে আপাতত পাঁচটিকে পক্ষভুক্ত করার আবেদন করা হয়েছে।
এ বিষয়ে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ গতকাল বলেন, ‘ব্র্যাক ব্যাংক ও স্থানীয় চেয়ারম্যানরা ভুল গ্রাহককে চিহ্নিত করেছে। আমরা গ্রাহককে চিহ্নিত করিনি। তবে এ ঘটনায় সোনালী ব্যাংকের একজন কর্মচারী পলাতক আছে, কয়েকজনকে শাস্তি দেওয়া হয়।’
জাহালম যেভাবে জেলে
জানা গেছে, পাঁচ বছর আগে দুদকের একটি চিঠির মাধ্যমে জাহালমের ঝামেলা শুরু। জাহালমের বাড়ি টাঙ্গাইলের ঠিকানায় দুদকের একটি চিঠি যায়। সেই চিঠিতে ২০১৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে নয়টায় জাহালমকে হাজির হতে বলে দুদক। চিঠিতে বলা হয়, ভুয়া ভাউচার তৈরি করে সোনালী ব্যাংকের ১৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত আবু সালেক নামের এক লোক, যাঁর সোনালী ব্যাংক ক্যান্টনমেন্ট শাখায় হিসাব রয়েছে।
আবু সালেকের ১০টি ব্যাংক হিসাবের ভুয়া ঠিকানাগুলোর একটিতেও জাহালমের গ্রামের বাড়ির কথা নেই। রয়েছে পাশের আরেকটি গ্রামের একটি ভুয়া ঠিকানা। কিন্তু সেটাই কাল হয়ে দাঁড়াল জাহালমের জীবনে। নির্ধারিত দিনে জাহালম হাজির হন দুদকের ঢাকার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। জাহালম নিজেকে জাহালম বললেও কেউই তাঁর কথা বিশ্বাস করেননি। পরে দুদক জাহালমকে আবু সালেক চিহ্নিত করে ২৬টি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। ২০১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি জাহালমকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়।
‘৩৩ মামলায় “ভুল” আসামি জেলে: “স্যার, আমি জাহালম, সালেক না…” শিরোনামে ২৮ জানুয়ারি প্রথম আলোতে প্রতিবেদন ছাপা হয়। প্রতিবেদনটি সেদিন আদালতের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অমিত দাশগুপ্ত। শুনানি নিয়ে আদালত স্বতঃপ্রণোদিত রুল দেন।
জাহালমের ঘটনার বর্ণনা হলফনামা আকারে দাখিলের জন্য সেদিন দুদকের আইনজীবী চার সপ্তাহ সময় চাইলে আদালত তা মঞ্জুর করেন। এরপর গতকাল ওই হলফনামা তৈরি করে দুদক।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনের তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে দুদক প্রথম এজাহার করে—এ কথা উল্লেখ করে আইনজীবী খুরশীদ আলম খান গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং সোনালী ব্যাংকের মতো একটি সরকারি ব্যাংক যখন আমাকে কিছু তথ্য-উপাত্ত পাঠাবে, অবশ্যই তা আমাকে আমলে নিতে হবে। এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার দুদকের কোনো আইনগত এখতিয়ার নেই।’ তিনি বলেন, এখানে ব্যাংক খুবই গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ। ব্যাংকগুলো এসে তাদের কথা বলুক।
ওই ঘটনায় দুদকের দায় থাকা না–থাকার বিষয়ে খুরশীদ আলম খান সাংবাদিকদের বলেন, বিচারাধীন বিষয়ে মন্তব্য করা ঠিক না। এ ঘটনায় দুদকের দায় কতটুকু কিংবা দায় আদৌ আছে কি না, তা আদালত নির্ধারণ করবেন। কারণ, দুদক সরল বিশ্বাসে কাজ করেছে। দুদক আইনের ৩১ ধারায় বলা হয়েছে, দুদক যদি সরল বিশ্বাসে কাজ করে থাকে, তাহলে দায়মুক্তি পাবে। সে জন্য এই ব্যাংকগুলোকে পক্ষভুক্ত করে ব্যাংকসহ দুদকের বক্তব্য একসঙ্গে শোনা দরকার।
দুদক এ ক্ষেত্রে দায়মুক্তির পথ খুঁজছে কি না—এমন প্রশ্নে আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘অবশ্যই না। আদালত আদেশ দিয়েছেন, আমরা পালন করেছি।ব্যাংকের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অনুসন্ধান, এজাহার ও অভিযোগপত্র হয়েছে। দুদকের স্ব–উদ্যোগে যদি এটা হতো, তাহলে এই প্রশ্নের যুক্তি ছিল।যেহেতু ব্যাংক দুদককে তথ্য দিয়েছে আর ব্যাংকের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই সব হয়েছে,এখন আদালত নির্ধারণ করবেন দুদকের দায় আছে কি না বা থাকলে কতটুকু।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান এ বিষয়ে বলেন, ‘নিরীহ জাহালমের কারাবাসের জন্য যে যুক্তিতে এবং দুদক আইনের যে ধারার বলে দায় এড়াতে চাইছে দুদক, তা অত্যন্ত অগ্রহণযোগ্য। দুদকের এই যুক্তি ‘সরল বিশ্বাস’ ধারণার সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। দুদকের দায়িত্ব হচ্ছে যথাযথ তদন্ত করে দোষী ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করা। জাহালমের ক্ষেত্রে দুদকের তিনটি ঘটনা হয়ে থাকতে পারে। এগুলো হচ্ছে—দুদকের তদন্তপ্রক্রিয়ার দুর্বলতা, কর্মকর্তাদের অবহেলা এবং প্রকৃত আসামির সঙ্গে যোগসাজশ।