শিরিন গুল এক আফগান সিরিয়াল কিলার
প্রকাশিত হয়েছে : ৬:২৯:৫০,অপরাহ্ন ০২ মার্চ ২০১৫
আন্তর্জাতিক ডেস্ক:: এক যুগ ধরে অন্ধকার কারাগারে পড়ে থাকার পরেও ঠিক করে বলতে পারেন না, তিনি আদৌ ২৭ জন নিরপরাধ পুরুষকে খুন করেছেন কি না! কখনও হাসেন, কখনও আবার মুখ ফিরিয়ে নেন। প্রেমিকের কথা বলতে গিয়ে কখনও রেগে বলেন, সে শুধু মহিলাদেরই নয় বরং বাচ্চাদেরও যৌন হয়রানি করেছে । আবার পরমুহূর্তে অকপটে স্বীকার করেন, এত সুন্দর কোনও মানুষ তাঁর জীবনে আর আসেনি!
আফগানিস্তানের সব চেয়ে নৃশংস খুনির তকমা নিয়ে এক যুগ ধরে জালালাবাদের কারাগারে আছেন শিরিন গুল। তাঁর মাথায় ‘সিরিয়াল কিলারে’র তকমা। অপরাধের প্রসঙ্গ উঠলেই বলেন প্রেমিক রহমাতুল্লাহের কথা। তাঁর স্বামীকেও খুন করেছে রহমাতুল্লাহ। শিরিনের পরিবেশন করা চা আর কাবাব খেয়ে গেছে ২৭ জন। ঘরের মধ্যে বসে বাগানে কোদালের কোপে মাটি কেটে কবর তৈরির শব্দ শুনতেন। জানতেন, তিনি মানুষ হত্যায় সাহায্য করছেন। মাঝে মাঝে পাল্টা প্রশ্ন করেন, তিনি নিজে খুন করেননি। নেশাগ্রস্ত মানুষটাকে ভয় পেয়েছিলেন মাত্র! ভয় পাওয়া কি অপরাধ?
শিরিন গুলের জন্ম নাংআরহার প্রদেশের শেওয়া জেলায়। ছোট বেলায় তার বাবা-মা মারা যায়। বয়স যখন ১১ তখন আফগানিস্তানের কমিউনিস্ট সরকারের এক কর্নেলের সঙ্গে তার বিয়ে দেয়। প্রবীন স্বামী বেশ মারধর করতেন শিরিনকে। তালেবানদের সঙ্গে কাজ করা রহমাতুল্লাহ পারিবারিক সম্পর্কের কারণে প্রায়ই তাদের বাসায় আসতো। রহমাতুল্লাহ যখনই বাসায় আসতো শিরিনের জন্য উপহার নিয়ে আসতো। এক পর্যায়ে দুজনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পথের কাঁট স্বামীকে সরাতে রহমাতুল্লাহর সহযোগিতায় খাবারে বিষ মিশিয়ে তাকে হত্যা করেন শিরিন।
২০০৪ সালে প্রথম অপরাধ কবুল করেন শিরিন। জানান, যৌনতার প্রলোভন দেখিয়ে বাড়িতে তিনি পুরুষদের ডেকে আনতেন। পরে রহমাতুল্লাহ, তার ছেলে আর তাদের কয়েক জন সঙ্গী মিলে খাবারে বিষ মিশিয়ে খুন করতেন সবাইকে। তাদের কাবুল আর জালালাবাদের বাড়ি দু’টোর বাগানেই পোঁতা আছে দেহগুলো। তারপর নিহত অতিথিদের গাড়ির নম্বরপ্লেট পাল্টে পাকিস্তান সীমান্তের তালেবান অধ্যুষিত এলাকায় বিক্রি করা হতো। অপরাধ প্রমাণ হওয়ার পরে শিরিন, রহমাতুল্লাহ, তার ছেলে সামিউল্লাহসহ ছ’জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল আফগান আদালত। শিরিন ছাড়া বাকি পাঁচ জনকেই ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। অপরাধ স্বীকার করার জন্য আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে ২০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন।
জালালাবাদের নানগরহার জেলের মহিলা কারাগারের বেশির ভাগ বন্দি চুরি-ছিনতাই বা বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে অভিযুক্ত। খুনের অপরাধীও আছে। জেলের ওয়ার্ডেন কর্নেল আব্দুল ওয়ালি হাসারকের কথায়, “শিরিনের মতো আমি কাউকে দেখিনি।” যদিও শিরিন আর পাঁচ জনের মতোই থাকেন। কম্বল, বিছানা সবই ভাগাভাগি করে নেন সঙ্গীদের সঙ্গে। খানিকটা বাড়তি সম্মানও পান। তবে সেটা সম্মান নাকি ভয়ের নামান্তর তা বোঝা মুশকিল। সাত বছর আগে জেলেই গর্ভবতী হয়েছিলেন তিনি। এখন তার সঙ্গেই অন্ধকারে পড়ে আছে তার সাত বছরের মেয়ে। মেয়েকে আদর করতে করতেই বলেন, ‘আমার চরিত্র খারাপ। তবে অনেক সময় আমি ভাল ব্যবহার করি।’ রাখঢাক না করেই বলেন, তাঁর মাথার অসুখ আছে। কোনটা ঘটেছে আর কোনটা ভাবছেন, সেটা অস্পষ্ট।
একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্য মেহনাজ সাদাতির কথায়, “উনি যেন সিনেমার চরিত্র।” সাদাতি মনে করেন, যে দেশ চার দশক ধরে যুদ্ধে দীর্ণ, যেখানে জীবন-মৃত্যু পাশাপাশি চলে, সেখানে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে শিরিনদের সঙ্গেও যে অন্যায় হয়, তার বিচার চাইবে কে? তিনি পাশে দাড়িয়েছেন শিরিনের। জানিয়েছেন, এই মামলার বেশিরভাগ নথিই উধাও হয়ে গিয়েছে। আর শিরিনের সম্পর্কে যতটা জানা গিয়েছে সবই জেলবন্দি হওয়ার পর বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে তাঁর কথোপকথন থেকে অনুমিত। এখন তাঁর স্মৃতি আর বিভ্রান্তি একাকার। কখনও তিনি খুনির পক্ষ নেন, কখনও আবার নিরপরাধ, অসহায় আর ভীত এক মহিলার বয়ানে কথা বলেন।
তবে এই ১২ বছরে তিনি এক বারও বলেননি তাঁর সঙ্গে ঘটে যাওয়া অপরাধের কথা। বলেননি তাঁর মেয়ের শৈশবহীন জীবনের কথা।