মুখ থুবড়ে পড়েছে দোয়েল
প্রকাশিত হয়েছে : ৯:১৭:২৮,অপরাহ্ন ২২ ডিসেম্বর ২০১৪
তথ্য-প্রযুক্তি ডেস্ক:: অর্থাভাব, অনিয়ম, দুর্নীতি আর নিম্নমানের যন্ত্রাংশ ব্যবহারের কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে দোয়েলের অগ্রযাত্রা। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে এবং ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে প্রকল্পটি শুরু হলেও ব্যর্থতা দেখলো আড়াই বছরেই। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, কর্মকর্তাদের অদক্ষতা, প্রকল্পে দুর্নীতি, নিম্নমানের যন্ত্রাংশ ব্যবহার এবং প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে ব্যর্থ হয়ে গেছে এই উদ্যোগ। আর বাংলাদেশ টেলিফোন শিল্প সংস্থার (টেশিস) এক শীর্ষ কর্মকর্তা ও তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, কেবল আর্থিক সঙ্কটই এই প্রকল্পের ব্যর্থতার জন্য দায়ী নয়, বরং এই প্রকল্পটিকে ব্যর্থ করার জন্যই হাতে নেয়া হয়েছিল। প্রকল্পটি ব্যর্থ হলেও লাভবান হয়েছেন কিছু কর্মকর্তা। তারা অবিলম্বে অডিটের মাধ্যমে এই অনিয়মের হিসাব বের করার জন্য মন্ত্রণালয় ও সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান টেলিফোন শিল্প সংস্থা (টেশিস) সাশ্রয়ী মূল্যে সবার হাতে ল্যাপটপ তুলে দিতেই ২০১১ সালে যাত্রা শুরু করেছিল দোয়েলের। দেশজুড়ে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা এবং মূল্য কম থাকায় মানুষের মাঝেও দেখা দিয়েছিল ব্যাপক আগ্রহ। তবে আড়াই বছর যেতে না যেতেই মুখ থুবড়ে পড়েছে সরকারের এই প্রকল্প। বরং কর্মকর্তাদের অদক্ষতা, প্রকল্পে দুর্নীতি, নিম্নমানের যন্ত্রাংশ ব্যবহার এবং প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে ব্যর্থ হয়ে গেছে এই উদ্যোগ। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকল্পটি যেভাবে শুরু হয়েছিল তা সফল হওয়া ছিল সময়ের ব্যাপার। কিন্তু পরবর্তী সময়ে প্রকল্পকে এগিয়ে নিতে যথাযথ আর্থিক সহায়তা পাওয়া যায়নি। যদিও সাবেক কর্মকর্তাদের অভিযোগ অদক্ষ কর্মকর্তাদের দিয়ে প্রকল্প পরিচালনা এবং আর্থিক দুর্নীতির কারণেই প্রকল্পটি ব্যর্থ হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, দোয়েল প্রকল্প ব্যর্থ হওয়ার পেছনে কেবল অর্থ সঙ্কটই প্রধান কারণ না। দুর্নীতি ও অনিয়মই এই প্রকল্পকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে। তবে প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়লে এর সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু কর্মকর্তা ঠিকই লাভবান হয়েছে বলে ওই কর্মকর্তা জানান।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কর্মকর্তাদের অদক্ষতার কারণে প্রকল্পটিতে সাফল্য আসছে না। সংকট রয়েছে যন্ত্রাংশের। প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে; দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) যা অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়া গ্রাহক অসন্তুষ্টি তো রয়েছেই।
স্বল্পমূল্যে স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীসহ সবার হাতে ল্যাপটপ তুলে দিতে বিগত মহাজোট সরকার দোয়েল ল্যাপটপ তৈরির প্রকল্পটি শুরু করে। ডিজিটাল বাংলাদেশ ও ভিশন ২০২১ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০০৯ সালের জুনে সরকার নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ল্যাপটপ উৎপাদনের ঘোষণা দেয়। এ জন্য ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীন টেলিফোন শিল্প সংস্থার তত্ত্বাবধানে প্রাথমিকভাবে ১৪৮ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), মালয়েশিয়ার প্রতিষ্ঠান থিম ফিল্ম ট্রান্সমিশন ও বিদেশি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ও সাহায্যে কাজ শুরু হয়। ল্যাপটপ তৈরির দায়িত্ব দেয়া হয় রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান টেলিফোন শিল্প সংস্থাকে (টেশিস)। গাজীপুরের টেশিস কারখানায় পরীক্ষামূলকভাবে এর উৎপাদন শুরু হয় ২০০৯ সালের ১০ জুলাই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালের ১১ অক্টোবর দেশীয় ব্র্যান্ড ‘দোয়েলের’ বিতরণ ও বাজারজাত কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন।
চার ধরনের ল্যাপটপের দাম ধরা হয় ১০ থেকে ২৮ হাজার টাকা। প্রাথমিক পর্যায়ে স্বল্পমূল্যের এসব ল্যাপটপ সরকারি সংস্থাগুলোয় সরবরাহ করা হয়। পরে সাধারণ জনগণের জন্য বাজারজাত করা হয়। তবে শুরুতেই এর নানা দুর্বলতা ধরা পড়ে। অপারেটিং সিস্টেমের পাশাপাশি এর ব্যাটারি নিয়েও অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে দোয়েল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে থাকে গ্রাহক। এর মধ্যেই দেখা দেয় যন্ত্রাংশের ঘাটতি। অভিযোগ ওঠে নিম্নমানের যন্ত্রাংশ দিয়ে দোয়েল বাজারজাত করার। ফলে চালুর ছয় মাসের মধ্যে উৎপাদন বন্ধ করে দেয় টেশিস।
টেলিফোন শিল্প সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটির এ পর্যন্ত মাত্র ৩০ হাজারের মতো দোয়েল ল্যাপটপ বিক্রি হয়েছে। এর বেশির ভাগই কিনেছে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা। এছাড়া দুটি বিক্রয় কেন্দ্রে খুচরা বিক্রয় কার্যক্রম চলছে। একটি বিক্রয় কেন্দ্র ঢাকায় ও অন্যটি খুলনা শহরে অবস্থিত। কিন্তু যথাযথ প্রচারণা ও বিপণনের অভাবে এ সম্পর্কে ল্যাপটপ ব্যবহারকারীরা তেমন কিছু জানেন না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ পর্যন্ত ৪২ হাজার ১৯৫টি ল্যাপটপের যন্ত্রাংশ আমদানি করেছে টেশিস। এর মধ্যে সংযোজন করা হয়েছে ৩৭ হাজার ল্যাপটপের যন্ত্রাংশ। আর বিক্রি হয়েছে মাত্র ৩০ হাজারটি। সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ই নিয়েছে সাড়ে ১৬ হাজার ল্যাপটপ। সেনাবাহিনীও বেশকিছু ল্যাপটপ নিয়েছে। তবে সাত হাজার ল্যাপটপ বিক্রি করতে পারেনি টেশিস। স্ট্যান্ডার্ড মডেলের পাঁচ হাজার ল্যাপটপ সংযোজন করলেও বিক্রি হয়েছে মাত্র ৬৮৪টি। আবার অ্যাডভান্স-১৬১২ই মডেলের দুই হাজার ল্যাপটপ সংযোজন করা হলেও বিক্রি হয়েছে মাত্র ১৮৩টি।
টেশিস সূত্রে জানা যায়, দোয়েল ল্যাপটপ ৪টি মডেলে তৈরি করা হতো। তবে বর্তমানে এর তিনটি মডেল বিক্রি করা হচ্ছে। এর মধ্যে বেসিক (০৭০৩) মডেলের ল্যাপটপটির দাম ১৫ হাজার টাকা। স্ট্যান্ডার্ড (২৬০৩) ল্যাপটপের মূল্য ২০ হাজার টাকা এবং অ্যাডভান্সড (১৬১২) ল্যাপটপের মূল্য ২৮ হাজার ৫০০ টাকা। তবে প্রাইমারি মডেলের ১০ হাজার টাকা মূল্যের যে ল্যাপটপটি ছিল, এই মডেলের ল্যাপটপ এখন উৎপদান করছে না টেশিস। এছাড়া বেসিক মডেলের ল্যাপটপটির মার্কেট চাহিদাও খুব কম। কারণ এর অপারেশনাল ক্যাপাসিটি খুবই সীমিত। কেননা এখন কম্পিউটার ব্যবহারকারীরা প্রযুক্তিতে অনেক অগ্রসর। ফলে সীমিত অপারেশনাল প্রযুক্তি দিয়ে মার্কেটে ভালো করতে পারছে না এই মডেলটি।
টেশিস সূত্রে জানা যায়, দোয়েলকে পুনরায় উড়াতে অর্থ সংস্থানের জন্য টেশিস দেশি অথবা বিদেশি কোম্পানির জন্য টেন্ডার দেয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। বিষয়টি এখন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে জানিয়ে টেশিসের পক্ষ থেকে বলা হয়, এটি ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের প্রয়োজন রয়েছে। চীনের বেশ কয়েকটি কোম্পানি দোয়েলে বিনিয়োগের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে। চীন, তাইওয়ান ও হংকং এর অন্তত পাঁচটি কোম্পানি ইতোমধ্যে তাদের প্রস্তাব জমা দিয়েছে। এই পাঁচ কোম্পানির মধ্যে ৮০ শতাংশ লাভে শতভাগ অর্থ ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে চায়। আর সরকার কোন বিনিয়োগ ছাড়াই বাকি ২০ শতাংশ লাভ পাবে। তবে যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করে কোন কোম্পানিকে চূড়ান্ত করা হবে।
জানতে চাইলে তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মোস্তফা জব্বার বলেন, দোয়েল প্রকল্পটি করানোই হয়েছিল ফেইল (ব্যর্থ) করানোর জন্য। কারণ ল্যাপটপের প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য যে অনুষঙ্গ প্রয়োজন হয় তা দোয়েল প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় ছিল না। তিনি বলেন, যে প্রকল্পে কমিশন খাওয়া হয়, পিপিপি’র নামে লুটপাট চলে সেই প্রকল্প বেশি দূর এগুতে পারে না, পারেওনি। এছাড়া দোয়েল পণ্য বাজারজাতকরণের জন্য কোন ডিলার, ডিস্ট্রিবিউটর এবং শোরুম নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, মানুষ এটা কেন কিনবে? এই তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ বলেন, ব্যবসা কখনো অনুদান দিয়ে হয় না, সরকার দোয়েলকে পুঁজি দিয়েছে কিন্তু ওই পুঁজি ফিরিয়ে নেয়ার কোন ব্যবস্থা করেনি। ফলে যারা এই প্রকল্পটি চালিয়েছে তারা জেনে করেছে যে, প্রকল্পের জন্য সরকার যে টাকা দিয়েছে তা ফিরিয়ে দিতে হবে না। আর সেই টাকা নিয়ে নিলেও কোন কিছু হবে না।
প্রকল্পের বিষয়ে জানতে চাইলে টেলিফোন শিল্প সংস্থার (টেশিস) ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুসনুল মাহমুদ খান কিছু বলতে রাজি হননি। বরং তিনি বলেন, শিগগিরই দোয়েল প্রকল্পে নতুন এমডি (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) আসছে, তার সাথেই কথা বইলেন।