ভূমিকম্পের ডেঞ্জার জোন সিলেট! ‘প্রায় নব্বই ভাগ ভবন মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ’
প্রকাশিত হয়েছে : ১২:৫২:৩৯,অপরাহ্ন ২৯ এপ্রিল ২০১৫
ভূমিকম্পের ডেঞ্জার জোন সিলেট। এখানে বহুতল ভবন নির্মাণে মানা হচ্ছেনা কোন নিয়মনীতি। নগরীর প্রায় ৯০ ভাগ ভবনই মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। নিয়মবর্হিভূতভাগে এই ভবন নির্মাণের তৎপরতা বন্ধে সিটি কর্পোরেশনের নেই কোন কার্যকরী পদক্ষেপ। ফলে ইট-পাথরের স্থাপত্যের এই সিলেট নগরীর ভূ-কম্পের কবলে পড়লে ধ্বংসস্তুপের নগরীতে পরিণত হবে এমনটাই আশংকা সংশ্লিষ্টদের। তাই বিপুল পরিমাণ অধিবাসীকে প্রতিনিয়তই ভূমিকম্পের আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে। বিগত ২০০৩ খৃষ্টাব্দ থেকে ২০০৮ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত সিলেটে ২০ বার ভূ-কম্পন অনুভূত হয়েছে।
ইদানিং ২০১৫ খৃষ্টাব্দের এপ্রিল মাসের শেষার্ধ্বে আবারো সিলেটে তিন তিনবার ভূ-কম্পন হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এধরণের ঘন ঘন ভূ-কম্পন একটা বড় ভূমিকম্পনের আলামত। ভূমিকম্পন প্রবল এলাকায় প্রতিশতাব্দীর মাতায় একটা প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পের আশংকা করা হয়। ১৮৯৭ খৃষ্টাব্দের ১২ জুন সিলেট-আসাম জুড়ে ভয়াবহ ভূমিকম্পন ১’শ ১১ বছর পেরিয়ে যাওয়ায় সিলেট অঞ্চল এসময়ে ভূমিকম্পের আশংকায় প্রবল হয়ে উঠেছে। সহস্রাধিক বহুতল ভবনের শহর সিলেটে কতটি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ তার কোন হিসেব নেই কর্তৃপক্ষের কাছে। ভবনের পিঠে ভবন আর ছোট পরিসরের রাস্তাঘাট হওয়ায় সর্বনাশা ভূমিকম্পের আঘাত হানলে হাজার হাজার তথা এমনকি বিপূল পরিমাণ মানুষের প্রাণহানির প্রধান কারণ হবে এই অপরিকল্পিত ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবন। এধরনের ধারণা বিভিন্ন সভা, সেমিনারে ইতিপূর্বে তুলে ধরেছেন বিশেষজ্ঞরা।
এক অনুসন্ধানে জানা যায়, ৯০ ভাগ ভবন নির্মাণের পূর্বে সয়েল টেস্ট করানো হয়না খোদ সিটি কর্পোরেশন এলাকায়। এছাড়া সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই গড়ে উঠেছে আরো ২০ ভাগ ভবন। হোল্ডিং ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার জন্যই সংশ্লিষ্ট ভবন মালিকরা ভবন নির্মাণের নকশা অনুমোদন করতে চায়না। পাশাপাশি অনেকে একতলা ভবনের অনুমোদন নিয়ে বহুতল স্থাপনা নির্মাণ করায় এ-খাতে সিটি কর্পোরেশন’র পাশাপাশি সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
একাধিক সূত্রের তথ্যমতে, সিলেট নগরীর ২০ ভাগ বাড়িওয়ালা সরকারী আইন না মেনে নগর কর্তৃপক্ষের অনুমোদন না নিয়েই বাসা-বাড়ি তৈরী করছেন। এদের বেশীরভাগই জানেন না বাড়ি নির্মাণ করতে হলে নগর কর্তৃপক্ষের অনুমতি প্রয়োজন। আবার কেউ কেউ এক তলা বাড়ির নকশা পাশ করিয়ে তিন তলা-চারতলা বাড়ি করছেন। দেশের অন্যান্য সিটি কর্পোরেশন গুলোতে আইন না মেনে অনুমোদনহীনভাবে যারা বাড়ি বা ভবন নির্মাণ করছেন তাদের বিরুদ্ধে প্রায়ই ভ্রাম্যমান আদালত দিয়ে অভিযান চালানো হয়। কিন্তু; এক্ষেত্রে সিলেট মেট্টোপলিটন নগরীতে এখনো অনুমোদনহীনভাবে অবৈধ বাড়ী নির্মাতাদের বিরুদ্ধে কোন ধরণের অভিযান লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। নগর কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত আইন এড়িয়ে বিল্ডিং কোড লঙ্ঘন করে এই নির্মাণের প্রবণতা দিনের পর দিন বাড়ছে। সিলেটে বহুতল ভবন মার্কেট, বাড়ির সত্ত্বাধিকারী-নির্মাণকারীদের ৯০ ভাগই ইউরোপ, আমেরিকা, ল্যাতিন আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসী। এদের অধিকাংশই বহুতল পাঁকা ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে সয়েল টেস্ট করানোর প্রয়োজন মনে করেনি বা প্রয়োজন মনে করছে না।
সংশ্লিষ্ট এক সুত্র এবং খুঁজ নিয়ে জানা যায়, সিলেট নগরীতে বিভিন্ন মার্কেট শুধু নয়, বিভিন্ন আবাসিক ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রেও সয়েল টেস্ট করানো হয় না। শাহজালাল উপশহর, হাউজিং এস্ট্রেট, শাহী ঈদগাহ, আম্বরখানা, পীরমহল্লা, দরগামহল্লা, মীরা বাজার, শিবগঞ্জ, দাড়িয়াপাড়া, সুবিদ বাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় নির্মিত ৯০ শতাংশ আবাসিক ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে নগর কর্তৃপক্ষের কোন অনুমোদ নেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না এলাকার বাড়ির মালিকরা। সংশ্লিষ্ট ক’জন প্রকৌশলী জানান, নগরীই শুধু নয়; সিলেট অঞ্চলের চারটি জেলাতেই একইভাবে সয়েল টেস্ট ছাড়া ও অপরিকল্পিতভাবেই পাঁকা বহুতল ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। ফলে একদিকে যেমন অপরিকল্পিত নগরায়ন গড়ে উঠছে তেমনি মানহীনভবন নির্মাণের মাধ্যমে মৃত্যুকূপে পরিণত হচ্ছে বহু আন্দোলন-সংগ্রামের সূতিকাগার এই প্রাচীন নগরীর; সিলেট।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আইআইটি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক তার এক গবেষণা পত্রে উল্লেখ করেছেন ২০১০ সাল থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে সিলেট ও আসাম অঞ্চলে বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে। ওই রিপোর্ট ভূমিকম্পের বিভিন্ন দিক গবেষণা করে আশঙ্খা প্রকাশ করে বলা হয়েছে সিলেটে নতুন ভবন নিমার্ণ সহ সার্র্বিক নগরায়নে ভূমিকম্প ঝুঁকির কথা বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না। নগরীতে প্রতি বছর ১০ভাগ হারে জনসংখ্যা বাড়ছে। পালা দিয়ে বাড়ছে বহুতল মার্কেট বিপনীবিতান। এছাড়া পুরনো অনেক দূর্বল ভবন ও রয়েছে। তাই বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে ভবন ধ্বসেই সিলেটে ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে অকল্পনীয়।
লেখক- সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী সুনির্মল সেন।